উপার্জন বেশ ভালো হলেও ব্যয়বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে সঞ্চয় তেমন একটা হবে না। শরীর খুব একটা ... বিশদ
তোমরা নিশ্চই রেলগাড়িতে চেপে মাঝেমধ্যেই এদিক ওদিক বেড়াতে যাও! আর মাত্র মাসদুয়েকের মধ্যে তোমাদের স্কুলে গরমের ছুটিও শুরু হয়ে যাবে। সেইসময় তোমরা রেলগাড়িতে চেপেই কেউ কেউ মামাবাড়ি যাবে, অনেকে আবার অন্য কোথাও ঘুরতে যাবে নিশ্চয়! কু ঝিকঝিক এই শব্দটি শুনলেই কেমন যেন ছুটির ঘণ্টা বেজে গেল বলেই মনে হতে থাকে, তাই না? তবে আজ তোমাদের এমন একটা রেলগাড়ির গল্প শোনাব, যেখানে কোনও কু ঝিকঝিক শব্দ হয় না। মানে কু ঝিকঝিক শব্দের উৎস যেখানে, এই রেলগাড়িতে সেই ইঞ্জিনটিই নেই। ইঞ্জিন ছাড়াই ছুটে বেড়াচ্ছে একটি আস্ত রেলগাড়ি। তোমরা নিশ্চয় ভাবছ, ইঞ্জিন নেই। তাও রেলগাড়ি ছুটছে? এ কীভাবে সম্ভব? অবশ্যই সম্ভব। সম্প্রতি ভারতীয় রেল এমনই এক অভিনব ট্রেন তৈরি করেছে। যাতে কোনও ইঞ্জিনই নেই। অথচ এই ট্রেন ছুটছে আমাদের দেশের বাকি রেলগাড়িগুলির থেকে সবচেয়ে দ্রুত গতিতে। ট্রেনটির নাম বন্দে ভারত এক্সপ্রেস। আর ডাকনাম ট্রেন-১৮। ২০১৮ সালে তৈরি হয়েছিল বলেই এরকম নাম। পরে অবশ্য জমা পড়া অনেক নামের মধ্যে থেকে বন্দে ভারত এক্সপ্রেসের নামই চূড়ান্ত করা হয়। আপাতত এই ট্রেনটি শুধুমাত্র নয়াদিল্লি এবং বারাণসীর মধ্যে চলাচল করছে। মাঝে কানপুর এবং এলাহাবাদে স্টপেজও দিচ্ছে। গত ১৫ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সবুজ পতাকা নেড়ে নয়াদিল্লি থেকে এই ট্রেনের উদ্বোধনও করে দিয়েছেন। আমাদের রেলমন্ত্রী পীযূষ গোয়েল ইতিমধ্যেই জানিয়েছেন, আগামীদিনে কলকাতা থেকে পাটনা এবং কলকাতা থেকে ভুবনেশ্বরের মধ্যেও এই বন্দে ভারত এক্সপ্রেস চালানো হবে। কী ভাবছ? ব্যাগ গোছাতে শুরু করবে কি না? করতেই পারো। কারণ দেশের এই প্রথম সেমি হাইস্পিড ট্রেন ভারতীয় রেলের গর্ব।
কেন? এই ট্রেনটি তৈরি হয়েছে সম্পূর্ণ দেশীয় প্রযুক্তি ব্যবহার করে। তোমাদের মধ্যে অনেকেই নিশ্চয় চেন্নাইয়ে গিয়েছ? সেখানে ইন্টিগ্রাল কোচ ফ্যাক্টরি (আইসিএফ) নামে রেলের একটি কারখানা আছে। সেই কারখানাতেই মাত্র ১৮ মাস সময়ের মধ্যে তৈরি হয়েছে এই বন্দে ভারত এক্সপ্রেস। একমাত্র এই ট্রেনেই বিদেশের কোনও রাষ্ট্র থেকে কোনওরকম প্রযুক্তিগত সহায়তা নেওয়া হয়নি। আমাদের দেশের ইঞ্জিনিয়াররাই এই কৃতিত্বের অধিকারী। ট্রেনটি তৈরি করতে খরচ হয়েছে প্রায় ৯৭ কোটি টাকা। কেন এই ট্রেনকে দেশের প্রথম সেমি হাইস্পিড ট্রেন বলা হচ্ছে? কারণ এই বন্দে ভারত এক্সপ্রেস ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ১৬০ কিলোমিটার গতিতে চলার ক্ষমতা রাখে, যা এই মুহূর্তে আমাদের দেশের অন্য কোনও ট্রেনের নেই। আর যে কারণে নয়াদিল্লি থেকে বারাণসী যেতে যেখানে এমনিতে সময় লেগে যায় প্রায় ১১-১২ ঘণ্টা, সেখানে এই বন্দে ভারত এক্সপ্রেসে চেপে দিল্লি থেকে বারাণসী পৌঁছে যাওয়া যাচ্ছে আট ঘণ্টা সময়ের মধ্যেই। তবে আপাতত ট্রেনটিকে ছোটানো হচ্ছে গড়ে ঘণ্টায় ১৩০ কিলোমিটার গতিতেই, যা কিনা এই মুহূর্তে শতাব্দী এক্সপ্রেসের গতিবেগ। কারণ সেমি হাইস্পিডের গতিতে ছোটাতে গেলে আরও কিছু পরিকাঠামোর প্রয়োজন। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ট্রেনটির গোটা রুটে ফেন্সিংয়ের ব্যবস্থা করা। কারণ এত দ্রুতগতিতে ছুটে চলা ট্রেনের যাত্রাপথে যদি কোনও বাধা চলে আসে (গবাদি পশু, মানুষ, গাড়ি), তাহলে সেগুলির ক্ষতি তো হবেই, এত স্পিডে ছুটে চলার জন্যই বড়সড় দুর্ঘটনার সম্মুখীন হবে বন্দে ভারত এক্সপ্রেস। সেই আশঙ্কার কথা মাথায় রেখে, সব পরিকাঠামোগত কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত একে শতাব্দী এক্সপ্রেসের গতিতেই চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে রেলমন্ত্রক। তোমাদের আরও একটি কথা চুপিচুপি বলে দিই, এই শতাব্দী এক্সপ্রেসের পরিবর্তেই কিন্তু বন্দে ভারত এক্সপ্রেস বা ট্রেন-১৮ চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে ভারতীয় রেল। অর্থাৎ ধীরে ধীরে শতাব্দী এক্সপ্রেস সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেওয়া হবে। তার বদলে ছুটে চলবে ট্রেন-১৮।
এবার বন্দে ভারত এক্সপ্রেসের ডিজাইন সম্পর্কে শোনো। ইঞ্জিন ছাড়াই কীভাবে একটি গোটা ট্রেন চলতে পারে, এবং তা দেখতেও বা কেমন, তা নিয়ে নিশ্চই তোমরা খুব চিন্তায় পড়েছ? একটু সহজ করে বলি। তোমরা কলকাতায় মেট্রোরেলে চড়ো তো? পুরনো মেট্রো নয় কিন্তু। নতুন যেসব মেট্রো এসেছে কলকাতায়, সেগুলি। বন্দে ভারত এক্সপ্রেস দেখতে অনেকটা সেরকম। অর্থাৎ এই ট্রেনটিকে সামনে এবং পিছনে দুদিকেই ইচ্ছেমতো ‘মুভ’ করানো যায়। সবমিলিয়ে এই ট্রেনে রয়েছে মোট ১৬টি কোচ। পুরোটাই তৈরি হয়েছে স্টেইনলেস স্টিল দিয়ে। সম্পূর্ণ ট্রেনটি এসি। পুরোটাই চেয়ারকার। অর্থাৎ বসে যেতে হবে। শোয়ার কোনও ব্যবস্থা নেই। এসি চেয়ারকার রয়েছে ১২টি। প্রতিটি চেয়ার কার কোচে বসতে পারবেন ৭৮ জন করে যাত্রী। এগ্জিকিউটিভ চেয়ার কার রয়েছে দুটি। যেখানে প্রতি কোচে ৫২ জন করে যাত্রীর জায়গা হবে। এগ্জিকিউটিভ চেয়ার কারের বসার আসনগুলিকে আবার ইচ্ছেমতো ঘোরানোও যায়। দরজা খোলা-বন্ধের ব্যবস্থাও স্বয়ংক্রিয়। অর্থাৎ তুমি যদি সামনে গিয়ে দাঁড়ও, ব্যস, দরজা খুলে যাবে মুহূর্তেই। তুমি কোন স্টেশন থেকে উঠেছ, পরবর্তী স্টেশনের নাম কী, সেটি কতক্ষণের মধ্যে পৌঁছবে সমস্ত তথ্য তোমায় দেখিয়ে দেবে কোচে লাগানো টিভি, যা চালানো হবে জিপিএস ব্যবস্থার মাধ্যমে। পুরো ট্রেনেই এলইডি আলোর ব্যবস্থা। এছাড়াও প্রতি কোচেই তোমাদের সকলের সুরক্ষার জন্য সিসিটিভি ক্যামেরা লাগানো রয়েছে। এমন ব্যবস্থা করা হয়েছে, যাতে কোনওরকম ঝাঁকুনি ছাড়াই দ্রুত ট্রেনের গতি বৃদ্ধি এবং হ্রাস করা সম্ভব। আরও একটি তথ্য দিয়ে রাখি তোমাদের। এই ট্রেন-১৮, অর্থাৎ বন্দে ভারত এক্সপ্রেস কিন্তু সুরক্ষার দিক দিয়েও একেবারেই নিরাপদ। দেশীয় প্রযুক্তির ব্যবহার হলেও তা সবই আন্তর্জাতিক মানের। এবং অত্যাধুনিক। ফলে ট্রেন যখন দুরন্ত গতিতে ছুটে চলবে, তখন অযথা ভয় পাওয়ার কিচ্ছু নেই। নিশ্চিন্তে বাইরের দৃশ্য দেখতে দেখতে যেয়ো। তবে হ্যাঁ, টিকিটের দাম একটু বেশি। শতাব্দী এক্সপ্রেসের তুলনায় এর ভাড়া অন্তত ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত বেশি। এরপরেও যদি তোমাদের বাবা-মা টিকিটের ঠিকঠাক দাম তোমাদের কাছে জানতে চান, তখন কী করবে? দেখে নাও ঠিক কত দাম দিয়ে টিকিট কাটতে হবে তোমাদের। নয়াদিল্লি থেকে বারাণসী পর্যন্ত রেলপথের দূরত্ব মোট ৭৭৬ কিলোমিটার। এই পুরো পথ যেতে এসি চেয়ার কারের জন্য ভাড়া পড়বে মাথাপিছু এক হাজার ৭৬০ টাকা। যার মধ্যে বেস ফেয়ার যাত্রীপিছু এক হাজার ২৪০ টাকা। কেটারিং চার্জ ৩৪৪ টাকা। এর সঙ্গে পাঁচ শতাংশ জিএসটি যুক্ত হবে। অন্যদিকে, এগ্জিকিউটিভ ক্লাসের জন্য তোমাদের খরচ পড়বে যাত্রীপিছু তিন হাজার ৩১০ টাকা। যার মধ্যে বেস ফেয়ার দুহাজার ৬১৭ টাকা। কেটারিং চার্জ ৩৯৯ টাকা। এর সঙ্গে একইভাবে যুক্ত হবে পাঁচ শতাংশ জিএসটি। আর যদি তোমরা কানপুর এবং এলাহাবাদে নামতে চাও, তাহলে ভাড়া আরও একটু কম পড়বে। তবে টিকিটের দামের মধ্যেই ধরা আছে খাবারের মূল্যও। যাত্রীপিছু এর চার্জের হিসেব তোমরা পেয়েই গেলে। খাবারের বৈচিত্র্যে যাত্রীরা কার্যত পাঁচতারা হোটেলের স্বাদই পাবেন বলে জানিয়েছে খাবার পরিবেশনের দায়িত্বে থাকা আইআরসিটিসি (ইন্ডিয়ান রেলওয়ে কেটারিং অ্যান্ড ট্যুরিজম কর্পোরেশন)।
শুধুমাত্র একটি বিষয় তোমরা একটু মাথায় রাখতে বলো তোমাদের বাবা-মা কিংবা অভিভাবকদের। এই ট্রেনে কিন্তু কোনওরকম কনসেশন নেই। অর্থাৎ টিকিট কাটায় কোনওরকম ছাড় মিলবে না। বড়দের জন্যও নেই। ছোটদের (চাইল্ড কনসেশন) জন্যও নেই। অবশ্য তোমরা তো এখন বড় হয়েই গিয়েছ, তাই না?
ছবি: রেলমন্ত্রকের সৌজন্যে