উপার্জন বেশ ভালো হলেও ব্যয়বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে সঞ্চয় তেমন একটা হবে না। শরীর খুব একটা ... বিশদ
এই মানুষটিকে নিয়ে লিখেছেন সঞ্জয় চট্টোপাধ্যায়।
ছেলেটি ছিল অত্যন্ত গরিব, দলিত পরিবারের। ভারতে তখন ব্রিটিশ শাসন চলছে। সেই সময় সমাজে জাতপাতের ভেদাভেদ ছিল অত্যন্ত প্রকট। ছেলেটি দলিত ছিল বলে ক্লাসে উচ্চবর্ণের ছাত্রদের সঙ্গে তার বসার অনুমতি ছিল না। তাকে বসতে হত ক্লাসের বাইরে। মেঝেতে পেতে বসার জন্য সে বাড়ি থেকে বস্তা নিয়ে যেত। তেষ্টা পেলে জলের পাত্র ছোঁয়ারও অধিকার ছিল না। কিছুটা দূরত্ব রেখে উচ্চবর্ণের কেউ এসে জল ঢেলে দিত। ছেলেটির জন্য এই কাজটি করতেন স্কুলের চাপরাশি। তিনি স্কুলে না এলে সেদিন ছেলেটি আর জল পেত না। পরে বড় হয়ে এই অবস্থাকে সে বর্ণনা করেছিল ‘পিওন নেই, জল নেই’ বলে। কে জানত? এই ছেলেটিই একদিন ভারতবর্ষের সংবিধানের রূপকার হবে!
ছেলেটির পুরো নাম— ডঃ ভীমরাও রামজি আম্বেদকর। ১৮৯১ সালের ১৪ এপ্রিল (অর্থাৎ আজকের দিনে) তিনি অধুনা মধ্যপ্রদেশের এক সেনা শিবিরে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন পরিবারের কনিষ্ঠ সন্তান। তাঁর বাবা রামজি মালোজি সাকপাল সেনাবাহিনীতে সুবেদার ছিলেন। ১৮৯৪ সালে রামজি সাকপাল অবসর নেন। তার দু’বছর পর পুরো পরিবার সাতারায় চলে যায়। এর কিছুদিন পর মা ভীমাবাই মারা যান। আম্বেদকররা তাই মাসির কাছে মানুষ হতে থাকেন। আম্বেদকর যে গরিব মাহার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, তখন সমাজে তা অস্পৃশ্য জাতি হিসেবে গণ্য হত। চিরকাল তাই তিনি সামাজিক বৈষম্যতা, হিন্দুধর্মের চতুর্বর্ণ পদ্ধতি এবং অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে লড়াই করে গিয়েছেন। অম্পৃশ্যদের সামাজিক অধিকার প্রতিষ্ঠা ও সামাজিক স্বাধীনতার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করেছেন। তিনি ছিলেন ভারতের জাতীয়তাবাদী এবং দলিত আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা। ছেলেবেলা থেকেই তিনি ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র। সামাজিক বৈষম্যের শিকার হলেও শিক্ষাদীক্ষায় তিনি সমসাময়িক সকলকে ছাপিয়ে যেতে সমর্থ হন। কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় এবং লন্ডনের স্কুল অব ইকনমিক্স থেকে তিনি আইনের ডিগ্রি লাভ করেন। আইন, অর্থনীতি এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞানে তাঁর গবেষণা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে এক ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে রয়ে গিয়েছে। ভারতের ইতিহাস তাঁকে একজন জনপ্রিয় রাজনৈতিক নেতা, দার্শনিক, চিন্তাবিদ, নৃতত্ত্ববিদ, অর্থনীতিবিদ, ঐতিহাসিক এবং রাষ্ট্রবিপ্লবী হিসেবে মনে রেখেছে। ১৯৫৬ সালে তিনি বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেন। বৌদ্ধ আন্দোলনকারী হিসেবেও তাঁর বিরাট ভূমিকা ছিল। ‘বাবাসাহেব’ নামেই তিনি জনপ্রিয় ছিলেন।
তাঁর আসল পদবি ছিল আম্বাভাদেকর। তা এসেছিল গ্রামের (মহারাষ্ট্রের রত্নগিরি জেলার আম্বাভাদে) নাম থেকে। তাঁর ব্রাহ্মণ শিক্ষক মহাদেব আম্বেদকর তাঁর প্রতি অত্যন্ত স্নেহপরায়ণ ছিলেন। তিনিই খুশি হয়ে স্কুলের খাতায় তাঁকে নিজের পদবি (আম্বেদকর) দেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী ও কৃতী ছাত্র। ১৯০৭ সালে আম্বেদকর প্রবেশিকা পরীক্ষায় সাফল্যের সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়ে প্রথম অস্পৃশ্য হিসেবে বম্বে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ১৯১২ সালে তিনি বম্বে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতি এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতক হন। এলফিনস্টোন কলেজে পড়ার সময় বরোদার মহারাজা তৃতীয় সায়াজি রাও গায়কোয়াড়ের কাছ থেকে তিন বছরের জন্য তিনি মাসিক (১১.৫০ পাউন্ড) বৃত্তি পান। এই বৃত্তির সুবাদে স্নাতকোত্তর স্তরে অধ্যাপনার জন্য ১৯১৩ সালে (২২ বছর) তিনি নিউইয়র্কের কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যান। ১৯১৫ সালের জুনে তিনি অর্থনীতিতে এমএ হন। অর্থনীতি ছাড়া তাঁর অন্যান্য বিষয় ছিল সমাজবিজ্ঞান, ইতিহাস, দর্শনশাস্ত্র এবং নৃতত্ত্ববিজ্ঞান। এই সময় তাঁর গবেষণালব্ধ প্রবন্ধ ‘প্রাচীন ভারতের ব্যবসা-বাণিজ্য’ প্রকাশিত হয়। ১৯১৬ সালে তাঁর দ্বিতীয় গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ ‘ন্যাশনাল ডিভিডেন্ড অব ইন্ডিয়া— আ হিস্টোরিক অ্যান্ড অ্যানালিটিক্যাল স্টাডি’ প্রকাশিত হয়। প্রখ্যাত নৃতত্ত্ববিদ অধ্যাপক আলেকজান্ডার গোল্ডেনউইজার কর্তৃক আয়োজিত সেমিনারের আগে তিনি ‘কাস্টস ইন ইন্ডিয়া: দেয়ার মেকানিজম, জেনেসিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট’ বিষয়ক পত্র পাঠ করেন। উচ্চস্তরে আইনের পাঠ নেওয়ার জন্য তিনি ১৯১৬ সালের অক্টোবরে লন্ডনের ‘Gray's Inn’-এ ভর্তি হন। পাশাপাশি, লন্ডনের স্কুল অব ইকনমিক্সে তাঁর গবেষণা শুরু করেন। তিন বছরের বৃত্তির মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ায় ১৯১৭ সালের জুন মাসে তিনি ভারতে ফিরে আসতে বাধ্য হন। তাঁর সংগ্রহে থাকা মূল্যবান বইগুলি যে জাহাজে পাঠিয়েছিলেন, এক জার্মান সাবমেরিনের আক্রমণে সেটি ডুবে যায়। অপরদিকে, তাঁর গবেষণামূলক কাজ চার বছরের মধ্যে জমা দিয়ে দেশে ফিরে আসার জন্য তাঁকে সুযোগ দেওয়া হয়। অবশেষে, ১৯২৭ সালে তিনি অর্থনীতিতে পিএইচডি হন।
বম্বে হাইকোর্টে আইনজীবী হিসেবে কাজ করার সময়েই অস্পৃশ্যদের শিক্ষিত করে তোলা এবং তাদের উন্নয়নের লক্ষ্যে কাজ শুরু করেন আম্বেদকর। তাই তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ‘বহিষ্কৃত হিতকারিণী সভা’। তাঁর ‘সত্যাগ্রহ’ এক গণআন্দোলনের রূপ নেয়। দলিতদের অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইকে গতি দিতে তিনি তিনটি পাক্ষিক পত্রিকা শুরু করেছিলেন। সেগুলি হল— মূক নায়ক, বহিষ্কৃত ভারত এবং ইক্যুয়ালিটি জনতা। সাধারণ মানুষ যাতে ভেদাভেদ ভুলে সর্বত্র পানীয় জল সংগ্রহ করতে পারেন, তার জন্য উদ্যোগী হন। ছেলেবেলায় তিনি যে ভেদাভেদের শিকার হয়েছিলেন, তা যেন ভবিষ্যৎ প্রজন্মের আর কাউকে মোকাবিলা করতে না হয়, এর জন্য তিনি জনমত গঠনে সফল হন। তিনি প্রাচীন হিন্দু গ্রন্থ ‘মনুস্মৃতি’-র বিধানের বিরোধিতা করেন। প্রতিবাদ স্বরূপ ১৯২৭ সালের ২৫ ডিসেম্বর তিনি ও তাঁর অনুগামীরা মনুস্মৃতির কপি পোড়ান। সেই থেকে আম্বেদকরের অনুগামী এবং দলিতদের কাছে এই দিনটি ‘মনুস্মৃতি দহন দিন’ হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। ১৯৩০ সালে নাসিকে আম্বেদকরের নেতৃত্বে প্রায় ১৫ হাজার স্বেচ্ছাসেবক কালারাম মন্দির সত্যাগ্রহে অংশ নেন। যদিও এই শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণকারীদের মন্দিরে ঢোকার সুযোগ মেলেনি। মন্দিরের দরজা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় প্রথমবার দেব দর্শনের সুযোগ থেকে তাঁরা বঞ্চিত হন। আম্বেদকর বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে এবং মুসলিম সমাজে মহিলাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবিতেও সরব হয়েছিলেন।
আম্বেদকর ১৯৩৫ সালে বম্বের সরকারি আইন কলেজের অধ্যক্ষ পদে নিযুক্ত হন। দু’বছর তিনি এই দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৩৬ সালে তিনি নিজের রাজনৈতিক দল ‘ইন্ডিপেনডেন্ট লেবার পার্টি’-র প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৩৭ সালে বম্বের নির্বাচনে ১৩টি সংরক্ষিত এবং ৪টি অসংরক্ষিত আসনের মধ্যে তাঁর দল যথাক্রমে ১১ এবং ৩টিতে জয়ী হয়। ১৯৩৬ সালের ১৫ মে তাঁর ‘অ্যানিহিলেশন অব কাস্ট’ বইটিতে তিনি তথাকথিত হিন্দু গুরুদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগরে দিয়েছিলেন। ১৯৫৫ সালে বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি মহাত্মা গান্ধীর কড়া সমালোচনা করেছিলেন। কারণ, গান্ধী ইংরাজি কাগজগুলিতে ভারতের জাতিভেদ প্রথার বিরুদ্ধে কলম ধরলেও গুজরাতি কাগজগুলিতে এই প্রথার সমর্থন করেছিলেন।
আম্বেদকর ছিলেন স্বাধীন ভারতের প্রথম আইনমন্ত্রী। সংবিধানের খসড়া কমিটির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব সাফল্যের সঙ্গেই পালন করেছিলেন তিনি। ভারতের সংবিধান রচনার ক্ষেত্রে তাঁর উল্লেখযোগ্য অবদান রয়েছে। আগাগোড়া তিনি সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদের বিরোধিতা করে গিয়েছেন তিনি। এই ধারায় কোনও রাজ্যকে বিশেষ সুবিধা দেওয়া হয়। যেমন, জম্মু-কাশ্মীর। কিন্তু শেষপর্যন্ত চাপের মুখে নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে তিনি সংবিধানে এই ধারা অন্তর্ভূক্ত করতে বাধ্য হন। ১৯৫২ সালে ভারতের প্রথম সাধারণ নির্বাচনে তিনি উত্তর বম্বে আসন থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। কিন্তু, কংগ্রেসের নারায়ণ কাজরোলকরের কাছে তিনি পরাজিত হন। এরপর তিনি রাজ্যসভার সদস্য হন। ১৯৫৬ সালের ৬ ডিসেম্বর দিল্লির বাড়িতে এই মহান ব্যক্তি প্রয়াত হন। ভারতীয় সংবিধানের রূপকারকে তাঁর অনবদ্য অবদানের জন্য ১৯৯০ সালে মরণোত্তর ‘ভারতরত্ন’ সম্মান প্রদান করা হয়। আপামর ভারতবাসী গভীর শ্রদ্ধা এবং কৃতজ্ঞতার সঙ্গে তাঁকে চিরদিন স্মরণ করে আসছে, আসবে।
ছবি : সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে