উপার্জন বেশ ভালো হলেও ব্যয়বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে সঞ্চয় তেমন একটা হবে না। শরীর খুব একটা ... বিশদ
টুবলু ঘরের ভিতর বসে জানালা দিয়ে উদাসভাবে বাইরের দিকে তাকিয়ে। পাশের বাড়িতে জিকোদের ছাদের উপর বসে একটা কাক বেসুরে কা কা করে ডেকে চলেছে। টুবলু মনে মনে বলল, ‘আজ কপালে ভারী দুঃখ আছে। কাকের ডাক নাকি অমঙ্গল।’ এটা সে শিখেছে ঠাকুমার কাছ থেকে। একদিন দুপুরে ঠাকুমার কাছে শুয়ে টুবলু লালকমল আর নীলকমলের গল্প শুনছিল। এমন সময় একটা কাক তাদের বারান্দার রেলিংয়ে বসে খুব ডাকছিল। ঠাকুমা গল্প থামিয়ে বলেছিল, ‘আরে হতচ্ছাড়া কাক, যা যা...।’ তাতেও কাকটা উড়ে যায়নি। তখন ঠাকুমা টুবলুকে বলেছিল, ‘যা তো দাদুভাই, কাকটাকে তাড়িয়ে দিয়ে আয়।’ টুবলু কাকটাকে বারান্দা থেকে তাড়িয়ে দিয়ে এসে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘কাক ডাকলে কী হয় ঠাকুমা?’ ঠাকুমা বলেছিল, ‘অমঙ্গল হয়।’
এখন সেই কথাটাই মনে পড়ল। সেই অমঙ্গলের আঁচ একটু আগেই পেয়েছে সে। ঠাকুমা ঠাকুরঘরে পুজো করছিল। পুজো শেষে ঠাকুরের প্রসাদ দুটো গুজিয়া সে টুবলুকে দিতে গিয়েছিল। সেই দেখে বাবা গর্জন করে ঠাকুমাকে বলেছিল, ‘তুমি সরে যাও মা। একদম ওকে খেতে দেবে না।’
ঠাকুমা মিনমিন স্বরে বলেছিল, ‘খেতে তো দিইনি, এই একটুকরো প্রসাদ দিচ্ছি মাত্র।’
বাবা আবার বলে উঠেছিল, ‘কিচ্ছু দেবে না। আমি যখন বারণ করছি তখন দেবে না।’ একটু থেমে বাবা আবার শুরু করল, ‘তোমাদের আশকারা পেয়ে ছেলেটা এমন বাঁদর তৈরি হচ্ছে। যখনই কিছু বলতে যাই তখনি তুমি আর বাবা ওকে আড়াল করে দাঁড়াও। এতে ও আশকারা পেয়ে একটা বাঁদর তৈরি হচ্ছে।’
কান্না থামিয়ে মা বিছানা থেকে উঠে এসে বলল, ‘একথা আমি বারবার বলি, তুমি তো বাড়িতে থাকো না, তাই জানো না। কত অসুবিধার মধ্যে ছেলেকে মানুষ করতে হয়। পড়াশোনার ক্ষেত্রে, ম্যানার্সের ক্ষেত্রে যখনই কিছু বলব বাবা আর মা বলবে, সুমি এভাবে বলিস না। এখন বাচ্চা, একটু বড় হলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। এই তো তার নমুনা। একেবারে ফেল করে এলেন। নাও, এবার ওকে মাথায় নিয়ে নাচো।’ কথাগুলো বলে মা একটু দম নিল। টুবলু অবশ্য দাদুর ঘর থেকে কিছু দেখতে পাচ্ছে না। কিন্তু সব কথা শুনতে পাচ্ছে।
দাদু বলল, ‘তোরা যেভাবে কথাটা বলছিস, সেটা ঠিক নয়। আমরা যে নিয়মে টুবলুকে মানুষ করতে চেয়েছি, সেই একইভাবে বাবু তোকেও আমরা মানুষ করেছি। তোরা তিন ভাই শোভাবাজারের ওই একটা ঘরে মানুষ হয়েছিস। পড়াশোনা শিখেছিস। সেখানে তো কোনও ভুল ছিল না।’
বাবা বলল, ‘এভাবে ব্যাপারটা দেখলে চলবে না বাবা। সময়, পরিবেশ, পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি যেমন বদলাচ্ছে, সেখানে সব কিছুই বদলাতে হবে। তুমি মাস্টারমশাই ছিলে। তখন যেভাবে পড়াতে এখনকার মাস্টারমশাইরা কি সেভাবে পড়ান?’ এখন সব কোচিং নির্ভর। তাই সব ব্যাপারে আগেকার দিনকে টানলে চলবে না।
মা বলল, ‘আমি একটা কথা না বলে পারছি না। এভাবে চলতে থাকলে আমি ছেলেকে মানুষ করতে পারব না। তোমাকে আমি বলে দিচ্ছি, হয় তুমি অন্য কোথাও ফ্ল্যাট দেখো, না হয় আমি নিজেই একটা ব্যবস্থা করব।’
এবার বাবা মাকে বলল, ‘পাগলের মতো কথা বোলো না। এভাবে দুম করে ফ্ল্যাট দেখা যায় নাকি। আর তাছাড়া আমরা চলে গেলে মা-বাবার কী হবে। না, না, অন্য কিছু ভাবতে হবে।’
মা বলল, ‘বসে বসে ভাবো। আর ছেলে এমনি এমনিই মানুষ হয়ে যাবে।’
বাবা বলল, ‘তুমি বেশি কথা বোলো না। বাড়িতে তো তুমিও থাকো। শুধু মা বাবার ওপর দোষ দিলে হবে! দিনরাত সিরিয়াল নিয়ে যদি বসে থাক, তবে ছেলে মানুষ হবে কী করে?’
টুবলু বুঝতে পারে। মা একথা শুনে চুপ করে থাকবে না। ঠিক একটা কিছু ঝাঁঝিয়ে বলবে। বহুদিন রাতে সে চুপ করে চোখ বুজে শুয়ে মা আর বাবার ঝগড়া শুনেছে। বাবা কিছুতেই মায়ের সঙ্গে কথায় পেরে ওঠে না। শেষকালে বাবাই বলে, ‘মাফ করো, আমার অন্যায় হয়েছে।’ সেই সময়টা টুবলুর খুব ভালো লাগে। যাকগে বাবা, ঝগড়া তাহলে থামল। বাবা মা ঝগড়া করলে টুবলুর বুকের ভেতর কেমন ভয় ভয় করে। ওদের ক্লাসের সাম্যব্রতর বাবা-মা আলাদা হয়ে গেছে। সাম্যব্রত একদিন ক্লাসে চুপি চুপি কাঁদছিল। টুবলু দেখেছে। জিজ্ঞাসা করতে সাম্যব্রত টুবলুকে বলেছিল, ‘আমায় কেউ ভালোবাসে না। বাবাও না, মা-ও না। আমি একদিন কোথাও হারিয়ে যাব।’
কথাটা শুনে টুবলুর খুব ভয় হয়েছিল। তার বাবা মা-ও যদি আলাদা হয়ে যায়? তাহলে সেও কি কোথাও হারিয়ে যাবে? ভাবলেই টুবলুর মনটা কেমন হয়ে যায়। চোখে জল আসে।
ওদিকে মা ততক্ষণে বলতে শুরু করে দিয়েছে। ‘আমি যখন ছেলে মানুষ করতে ব্যর্থ, তখন তুমিই বাড়িতে থেকে ছেলে মানুষ কর না!’
বাবা বলল, ‘উপায় থাকলে নিশ্চয়ই করতাম। কিন্তু আমাকে বাইরে বেরতে হয় রোজগার করতে। সেটা ভুলে যেও না।’
মা বলল, ‘আর আমি কি অশিক্ষিত নাকি? আমি কি চাকরি করতাম না? তখন কে বলেছিল, ছেলেটাকে মানুষ করতে হবে, চাকরিটা ছেড়ে দাও।’
বাবা বলল, ‘ওসব কথা টেনে বসে থাকলে ছেলে মানুষ হবে না। ওকে আর আমি এখানে রাখবই না। ওকে হস্টেলে পাঠিয়ে তবে আমি অন্নজল গ্রহণ করব।’
বাড়িতে এই সবই হচ্ছে। কেউ আর খাওয়ার কথা বলছে না। কিন্তু টুবলুর খুব খিদে পেয়েছে। এখন তার কতরকম খাবারের কথা মনে পড়ছে। চিকেন বিরিয়ানি খেতে টুবলু খুব ভালোবাসে। খিদে পেলেই তার চিকেন বিরিয়ানির কথা মনে পড়ে। তাদের পাড়ায় একটা বিরিয়ানির দোকান আছে। তার পাশ দিয়ে গেলেই টুবলু জোরে জোরে নিশ্বাস টানে। কী সুন্দর বিরিয়ানির গন্ধ! দাদুর কাছেই সে শুনেছে, গন্ধেতেই নাকি অর্ধেক খাওয়া হয়ে যায়। দাদু মজা করে বলে, ‘ওরা যদি জানতে পারে তুই গন্ধ শুঁকে অর্ধেক বিরিয়ানি খেয়ে নিয়েছিস, তাহলে আমার কাছ থেকে ওরা টাকা চাইবে কিন্তু।’ খুব মজা পায় টুবলু। কিন্তু এখন মজাটাই উড়ে গেছে। এখন বিরিয়ানির সঙ্গে পান্তুয়ার কথা মনে পড়ছে। পান্তুয়া তার খুব ভালো লাগে। মামা আর মিমি এ বাড়িতে এলেই তার জন্য পান্তুয়া নিয়ে আসে। আর তার ভালো লাগে মাখন দিয়ে গোবিন্দভোগ চালের ভাত আর ডিমসেদ্ধ। টুবলু বলে, ইয়ামি ভাত। সেটা হলে সে আর কিছুই চায় না। কিন্তু এখন সে সব জোটার কথাই নয়।
টুবলু বুঝতে পারল, বাবা ল্যাপটপ খুলেছে। কেননা সে শুনতে পেল বাবা বলছে, ‘যেখানে পাব ভর্তি করে দেব। এখানে আর এক মুহূর্ত রাখব না।’
দাদু বলল, ‘বাবু শোন না। আমি বলি কী, তুই একবার টুবলুর রেজাল্টটা সঙ্গে নিয়ে ওর স্কুলে যা। গিয়ে দেখ না কেন ফেল করল। কোন কোন সাবজেক্টে প্রবলেম হচ্ছে। তেমন হলে তুই চ্যালেঞ্জ কর। ওদের বল, টুবলুর পরীক্ষার খাতা দেখান। আমরা দেখতে চাই কীভাবে এমন ভুল হল। হাফ ইয়ার্লিতে যে ছেলে এত ভালো রেজাল্ট করল, সে ফেল করল কেন! এটা তো প্রথম জানা দরকার।’
বাবা বলল, ‘তুমি আমাকে স্কুলে গিয়ে প্রিন্সিপালের পায়ে ধরতে বলছ? কী বলব, স্যার আমার ফেল করা ছেলেটাকে পাশ করিয়ে দিন? আমি তা কখনও পারব না।’
মা বলল, ‘বহু স্কুলে টিচাররা ইদানীং ভালো করে খাতাই দেখে না। পাশ করতে গেলে নাকি টিচারদের ভালো ভালো গিফট দিতে হয়। টিচার্স ডেতে কিংবা টিচারের জন্মদিনে। তবে আমার মনে হয় বাবা কথাটা খারাপ বলেনি। একবার গিয়ে দেখো না। তেমন হলে আমিও তোমার সঙ্গে যাব। এটার তো একটা কিনারা হওয়া দরকার। কেন ছেলে ফেল করল। ছেলের বিরুদ্ধে স্কুলের কোনও কমপ্লেন আছে কি না।’
বাবা বলল, ‘এই জন্য পেরেন্ট-টিচার মিটিংগুলোতে যেতে হয়। লাস্ট মিটিংয়ে আমাদের যাওয়াই হল না। তখন আমরা পুরীতে। তুমি বললে, টুবলুকে নিয়ে কোনও চিন্তা নেই। ওর মতো ছেলের বিরুদ্ধে কোনও কমপ্লেন থাকতেই পারে না।’
মা বলল, ‘তখন কে জানত যে ছেলের পেটে পেটে এত। এভাবে মুখ পোড়াবে! ছি ছি এখন সায়ন্ত, দিগন্তিকা, সৌমিলী, রুদ্রাক্ষর মায়েদের কাছে মুখ দেখাব কী করে! একটু পরেই ওরা ফোন করে রেজাল্ট জানতে চাইবে। আমার আর বাঁচতে ইচ্ছে করছে না।’
এর মধ্যে দাদু টুবলুর রেজাল্টখানা এনে টেবিলে রাখল। বলল, ‘দেখ রেজাল্টের কী অবস্থা!’ টুবলু বুঝতে পারল এবার বাবা রেজাল্টটা টেনে নিয়ে দেখবে। সে চোখ বন্ধ করে পরবর্তী অবস্থার জন্য অপেক্ষা করতে লাগল।
বাবা চিৎকার করে উঠল, ‘একী একী! এটা কী করে হল! দেখো দেখো! টুবলু কী করেছে!’
মা-ও বোধহয় রেজাল্টটা দেখেছে। মা বলে উঠল, ‘আমি জানতাম এটা হতেই পারে না। বাবা এটা তুমি কিন্তু ঠিক করনি।’ ঠাকুমা বলল, ‘ওরে কী হল রে! আমাকে তোরা বল, কী হল!’
বাবা বলল, ‘টুবলু পরীক্ষায় থার্ড হয়েছে। ছি ছি ছি, আমরা কী সব ওকে বলেছি। সব কিন্তু বাবা তোমার জন্য।’
মা বলল, ‘তুমি বাবা এভাবে মিথ্যে কথা বলবে, আমি কিন্তু ভাবতেই পারছি না।’
দাদু বলল, ‘বলবই তো! আজ কত তারিখ তোরা জানিস না! আজ তো পয়লা এপ্রিল। আমি-টুবলু দুজনে মিলে তোদের সবাইকে এপ্রিল ফুল করলাম। আর তোরাই বা কেমন, আমি বললাম টুবলু ফেল করেছে, সেটা বিশ্বাস করে নিলি? রেজাল্টটা একবার দেখতে চাইলি না তো! ’
টুবলু এবার দৌড়ে বাইরে এল। বলল, ‘কেমন মজা। কেমন মজা। তোমরা বোকা, বোকা।’
বাবা ওকে কোলে তুলে নিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ রে টুবলু , তুই সব সময় যেন এভাবেই আমাদের বোকা বানাস।’ মা-ও ওকে জড়িয়ে ধরেছে। এবার বেশ শব্দ করে মা কাঁদতে লাগল। ‘অনেক কথা বলেছি। কিছু মনে করিস না বাবা।’
টুবলু বলল, ‘মনে করব কেন, আমি আর দাদু স্কুল থেকে ফেরার পথেই তো এমন প্ল্যান করলাম।’
বাবা বলল, ‘এমন প্ল্যান করলি যে আমার অফিস যাওয়াটাই বন্ধ হয়ে গেল।’
মা বলল, ‘খুব ভালো হয়েছে। এখন টুবলুকে কিছু খেতে দিই। অনেকক্ষণ ওর কিছু খাওয়া হয়নি।’
দাদু বলল, ‘ওতে হবে না, আমাদের একটু কিছু ভালোমন্দ খাওয়াতে হবে। অনেক কথা আমরা হজম করেছি। কিন্তু তাতে পেট ভরেনি। এবার পেট ভরানোর মতো কিছু খাওয়াতে হবে।’
বাবা বলল, ‘বেশ তাই হবে। আজ বাইরে কোথাও খাব। টুবলু বল, কী খাবি?’
টুবলু বলল, ‘চিকেন বিরিয়ানি।’
বাবা বলল, ‘বেশ তাই হবে। সবাই তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নাও। আমি গাড়িটা বের করি।’
দাদু টুবলুকে বলল, ‘আজ আর কিন্তু শুধু গন্ধ শোঁকা নয়, একেবারে পেটপুরে খাওয়া। আর টুবলুবাবুর কল্যাণে আমাদেরও একটু ভূরিভোজ হবে। জয় টুবলুবাবুর জয়।’
মা আরা বাবা দুজনেই বলে উঠল, ‘জয়।’