উপার্জন বেশ ভালো হলেও ব্যয়বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে সঞ্চয় তেমন একটা হবে না। শরীর খুব একটা ... বিশদ
এটুকু ছাড়া সত্যি বলতে কী, আর একটিও ঝামেলার ঘটনা বৃহস্পতিবার চোখে পড়েনি। এটা প্রকৃত অর্থেই সাধারণ মানুষের কাছে যথেষ্ট আশাব্যঞ্জক। গত পঞ্চায়েত ভোটের হিংসা নিয়ে অনেক কথা তুলেছিলেন এ রাজ্যের বিরোধীরা। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তাঁর প্রশাসন পুলিসের নামে অজস্র অপবাদ দাখিল করেছিলেন জনতার দরবারে। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী শাসক তৃণমূলের প্রার্থীদের নিয়ে অনেক কটাক্ষও করেছিলেন। তাঁদের প্রতিবাদ আদালত পর্যন্তও গড়িয়েছিল। কিন্তু তাতেও পঞ্চায়েত স্তরে মমতার ব্যাপক জনপ্রীতি বা তৃণমূলের একাধিপত্যে কোথাও কোনও টান পড়েনি।
আর এবারের ভোট তো এখনও প্রায় ঘটনাশূন্য। দু’পর্ব মিলিয়ে যেটুকু ঘটেছে তা সংশ্লিষ্ট লোকসভা কেন্দ্রগুলির মোট আয়তন, জনসংখ্যা, জটিল রাজনৈতিক বিন্যাস ও যুযুধান পক্ষগুলির মধ্যবর্তী আবেগ উত্তেজনার ব্যাপ্তি ও তীব্রতার নিরিখে সামান্যই বলতে হবে। কিন্তু সেটি সরাসরি স্বীকার করলে প্রকারান্তরে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ও তাঁর প্রশাসন-পুলিসের দক্ষতা যোগ্যতাকেই স্বীকৃতি দিতে হয়। সেটা আর পাঁচজনের পক্ষে সম্ভব হলেও সিপিএম বা তার সমমনোভাবাপন্নদের পক্ষে অসম্ভব। তাই, সিপিএমের মুখপত্র দ্বিতীয় দফার পরদিন প্রথম পাতায় সেলিমের হেনস্তা ও চোপড়ার ঝামেলার কথা উল্লেখ করেও লিখতে বাধ্য হয়েছে ‘ভোট-লুঠেরাদের হার মানুষের জেদের কাছে!’ ‘মানুষের জেদ’কে সামনে এনে শান্তির ব্যাপারটা যেন এড়াতে চেয়েছে, ঊহ্য রাখতে চেয়েছে দ্বিতীয় দফার ভোটে কমিশন, কেন্দ্রীয় বাহিনী, মমতা-প্রশাসন ও পুলিসের সদর্থক ভূমিকাটিও! মজার ব্যাপার, এই লিড খবরের সঙ্গের ছবিতে ভোটের লাইনে নিশ্চিন্তমুখে দাঁড়ানো সারিবদ্ধ মহিলা ভোটার ও একজন পুলিসের ছবির ক্যাপশনে এঁরাই লিখেছেন, ‘কেন্দ্রীয় বাহিনী নেই, ভোট করছে সেই রাজ্য পুলিসই।’ তাহলে সব মিলিয়ে মানেটা কী দাঁড়াল? মানুষের জেদের কাছেই হোক, কি নিরাপত্তা বাহিনীর দাপটে ‘ভোট-লুঠেরারা’ বৃহস্পতিবার যে কায়দা করতে পারেনি—সেটি সত্যি, গণশক্তিও মেনেছে। অর্থাৎ ভোট হয়েছে নির্বিঘ্নে এবং তাতে মানুষ যে রাজ্য পুলিসের তত্ত্বাবধানেও নিশ্চিন্তে লাইনে দাঁড়িয়ে ভোট দিতে পেরেছে গণশক্তির প্রথম পাতার ওই ছবি ও তার ক্যাপশনই তার প্রমাণ—নয় কি?
অবশ্যই। বলতে কী, প্রথম দুই পর্বের নির্বাচনী যুদ্ধের সামগ্রিক ছবিটা দেখার পর জনমনেও ভোট নিয়ে ভয় ভাবনার ক্রমবর্ধমান পারদ যে একটু থমকেছে তাতে কোনও সন্দেহ নেই। পথেঘাটে লোকজনের আলাপ-আলোচনা শুনলেই সেটা বোঝা যাচ্ছে। নির্বাচন কমিশন কেন্দ্রীয় বাহিনীর পাশাপাশি রাজ্যের পুলিসের ওপরও তাঁদের আস্থা যে দুই পর্বের ভোটচিত্র দেখার পর অনেকটাই বেড়েছে—সাধারণ জনের কথাবার্তা থেকে সেটাও বেশ স্পষ্ট। এই আমজনতার এখন একটাই জিজ্ঞাসা: এই শান্তি শেষপর্যন্ত বজায় থাকবে তো? বৃহস্পতিবারের পর থেকে আমার পরিচিত একাধিক জনের মুখে ঘুরেফিরে এই প্রশ্নটাই শুনেছি। পরের পর্বে নব্বই শতাংশ বুথে কেন্দ্রীয় বাহিনী ও পুলিস থাকবে বলে খবর চাউর হতে তাঁদের যেন মনের জোর আরও বেড়েছে। একজন তো বলেই ফেললেন, এবার আর টেনশন নেই। বউ-ছেলেমেয়ে নিয়ে দিদির ভোটটা নিশ্চিন্তে দিতে পারব। যা সব শুরু হয়েছিল! এসব তো কোনওকালে এ রাজ্যে আমরা দেখিনি। যাক, মনে হচ্ছে অসুবিধা হবে না।
আসলে, এবারের ভোট শুরুর বহু আগে থেকেই, বলা ভালো সেই রামনবমীর অস্ত্রমিছিলের পর থেকেই, রাজ্যজুড়ে সাধারণ ঘরে একটা চিন্তার বাতাবরণ তৈরি হয়েছিল। গেরুয়া শিবিরের শক্তি বৃদ্ধি এবং শাসক তৃণমূলের সঙ্গে তার হাড্ডাহাড্ডি রাজনৈতিক লড়াইয়ের আয়োজন উদ্যোগ সেই চিন্তাকে আরও ঘনীভূত করে তুলছিল। তারপর রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মোদি-বিরোধী জাতীয় জোটের অন্যতম প্রধান মুখ হয়ে ওঠার পর থেকে যেভাবে জননেত্রী ও তাঁর বাংলা দিল্লির শাসকের নিশানা হয়ে উঠেছে তাতে এবার লোকসভার ভোটযুদ্ধের ময়দানে একটা ধুন্ধুমার মহাসংগ্রামের আভাসও ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছিল। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাগ্যুদ্ধে প্রাক্ভোটের আসর রীতিমতো অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠেছিল বলা যায়। সেই পরিস্থিতি এখনও বহাল এবং ভোটযুদ্ধের শেষপর্ব অবধি বজায় থাকবে বলেই মনে করছেন সকলে। একটা সময় তো এই বাগ্যুদ্ধের প্রচণ্ডতায় মনে হচ্ছিল মোদিজির প্রধান প্রতিপক্ষ কংগ্রেসের রাহুল গান্ধী নন, তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আসল লড়াই মোদি বনাম দিদির, মোদিজির গেরুয়া বাহিনীর সঙ্গে মমতার নেতৃত্বাধীন বিরোধী জোটের। আর সে লড়াইয়ের প্রধান ক্ষেত্র এই বাংলা! ফলে, সাধারণ জনমনে ভোটের আগে-পরে এবং ভোটের দিনে সংঘাত সংঘর্ষ নিয়ে একটা আশঙ্কার মেঘ যে জমছিল তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু, পর পর দুই পর্বের শান্ত ও প্রায় নির্বিঘ্ন ভোট তাঁদের মন থেকে যে সেই শঙ্কার কালো মেঘ অনেকটাই হালকা করে দিতে পেরেছে তা অনস্বীকার্য। এখন তাই তাঁদের একটাই প্রশ্ন, একটাই জিজ্ঞাসা—এই শান্তি শেষপর্ব পর্যন্ত বজায় থাকবে তো? থাকবেই এটা নিশ্চিত করে কেউই এখনই বলতে পারবেন বলে মনে হয় না। তার কারণ আজ ভোট ময়দানে প্রধান দুই প্রতিপক্ষ তৃণমূল এবং বিজেপি হলেও অপ্রধান অনেক আছে। তার মধ্যে ৩৪ বছর বাংলায় রাজ চালানো সিপিএম এবং তার শরিকেরা যেমন আছে, তেমনি আছে বহুদিন ক্ষমতাচ্যুত কংগ্রেসও। আছে নানা ছোটখাট কিন্তু বিপজ্জনক শক্তিও। ভোটটা তো একটা যুদ্ধই—রাজনৈতিক যুদ্ধ। আর কে না জানে যুদ্ধে, প্রেমে কোনও কিছুই ‘আনফেয়ার’ অর্থাৎ অন্যায্য অন্যায় নয়। সোজা কথায়—মারি অরি পারি যে কৌশলে। ঠিকই, ভোটটা দেশের পরবর্তী শাসক নির্বাচনের। দেশ শাসনের ভার পেতে প্রধান পক্ষগুলির যে রথী-মহারথীরা মহাসংগ্রামে নেমেছেন তাঁদের ভোটদাতাদের প্রতি দায়বদ্ধতা, তাঁদের নিরাপত্তার জন্য চিন্তাভাবনা অবশ্যই আছে। কিন্তু, তাঁদের বাইরেও তো অনেক সুযোগসন্ধানী এই ভোটযুদ্ধের আনাচকানাচে ঘাপটি মেরে থাকতে পারে। পুলিস, গোয়েন্দা, কেন্দ্রীয় বাহিনীর সদাসতর্ক দৃষ্টি এড়িয়ে তারা ঝামেলা-ঝঞ্ঝাট পাকাবার চেষ্টা করতেই পারে। তাই, এখনই শেষ নিয়ে শেষকথা বলতে যাওয়া মনে হয় না সঠিক হবে। তবে, একথা ঠিক ভোটের প্রথম দুই পর্ব আমাদের মনে যথেষ্ট আশা জাগিয়েছে। আশ্বস্ত করেছে বাংলার ভোটজনতাকেও। এখন দেখার ভোটযুদ্ধের ময়দানে এই শান্তি ও সম্প্রীতির আবহ শেষপর্ব পর্যন্ত বজায় থাকে কি না, পরবর্তী পর্যায়গুলোতে বাংলার সাধারণ মানুষ নিশ্চিন্তে নির্ভয়ে তাঁদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করে আসতে পারেন কি না। মমতার উন্নয়নের বিশ্ববাংলা যেমন গোটা দেশে নজির গড়েছে, জগৎসভা থেকে নিয়ে এসেছে শ্রেষ্ঠত্বের শিরোপা, তেমনি তাঁর এই ভোটবাংলাও শান্তি ও সম্প্রীতি বজায় রেখে এবার দেশে নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে—শান্তির দুই পর্বের পর বাংলার জনমহলে এমন একটা প্রত্যাশা কিন্তু জেগেছে। সে প্রত্যাশা শেষপর্যন্ত কতটা পূরণ হবে তা বলবে সময়। বলবে শেষ দফার শেষ বিকেল। আমরা অপেক্ষায় রইলাম।