উপার্জন বেশ ভালো হলেও ব্যয়বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে সঞ্চয় তেমন একটা হবে না। শরীর খুব একটা ... বিশদ
ওই ৯১টি কেন্দ্রে রাজনৈতিক উথালপাথাল আপাতত স্থগিত থাকলেও বাকি ভারতে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ অন্যরকম। সেই ভারতে রয়েছে আরও প্রায় সাড়ে চারশো আসন। আগামী ছ’দফায় সেগুলিতে প্রাপ্তবয়স্ক ভারতীয় নাগরিকদের বিবেচনার প্রতিফলন ঘটার কথা। সেই কোটি কোটি নাগরিক তথা ভোটারদের বিবেচনা নিজেদের পক্ষে আনতে রাজনৈতিক দলগুলির ব্যস্ততা এখন তুঙ্গে। প্রতিটি দলেরই ছোট বড় মাঝারি নেতা নেত্রীরা ছুটে বেড়াচ্ছেন। প্রতিদিন হাজার হাজার নির্বাচনী প্রচার সভায় এলাকার পর এলাকা সরগরম। যত বড় দল, তত বেশি আসনে প্রার্থী। নেতানেত্রীর সংখ্যাও সেই অনুসারে। হরেক রকম আঞ্চলিক দল। দু-চারটে সর্বভারতীয়। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে নবীন পট্টনায়ক, চন্দ্রবাবু নাইডু থেকে অখিলেশ যাদব, মায়াবতী থেকে নীতীশ কুমার। ছুটে বেড়াচ্ছেন সবাই। চষে বেড়াচ্ছেন যাঁর পক্ষে যতটা সম্ভব। তবে এদের সবাইকে ছাপিয়ে যাচ্ছেন প্রধান দুই সর্বভারতীয় দলের দুই নেতা নরেন্দ্র মোদি ও রাহুল গান্ধী। এবারের ভোটে নরেন্দ্র মোদির সামনে বাংলার অগ্নিকন্যা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একটি কঠিন চ্যালেঞ্জ। মমতাকে ঘায়েল করার তীব্র বাসনা নিয়ে নরেন্দ্র মোদি বার বার হানা দিচ্ছেন মমতার গড় বাংলায়। সর্বভারতীয় কংগ্রেস দলের সভাপতি রাহুল গান্ধীও গত কয়েক বছরের মধ্যে নিজেকে অভাবনীয় এক উচ্চতায় তুলে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছেন। তিনি গোটা ভারত জুড়ে লাগাতার সক্রিয়তায় মোদিজির স্বস্তি অনেকটাই কেড়ে নিয়েছেন। একদিকে মমতা অন্যদিকে রাহুল গান্ধীর সুতীব্র আক্রমণ ঠেকাতে তূণের সমস্তরকমের তিরই প্রয়োগ করে চলেছেন নরেন্দ্র।
গত পাঁচ বছরের প্রধানমন্ত্রিত্বকালে জনগণের দেওয়া করের টাকায় প্রায় একশোবার বিদেশ ভ্রমণ করা মোদি পরের পাঁচবছরের জন্য নিজের গদিটি অটুট রাখতে এখন দেশের কোণে কোণে ছুটছেন। উত্তর থেকে দক্ষিণ, পূর্ব থেকে পশ্চিম—দেশের প্রতিটি প্রান্তে মোদির এই ছুটে বেড়ানো দেখে বহু ভারতবাসীরই গত ২০১৪ সালের এই সময়টির কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। দৃপ্ত চেহারা, আসাধারণ বাচনভঙ্গিমা, তুলনাহীন শরীরী ব্যঞ্জনা সেসময় ভারতবাসীকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল। কোটি কোটি মানুষকে চুম্বকের মতো আকর্ষণ করেছিল গুজরাতনন্দনের একের পর এক চমকে দেওয়ার মতো প্রতিশ্রুতি। ক্ষমতায় এলে তিনি বিদেশে পাচার হওয়া লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা দেশে ফিরিয়ে আনবেন। না, টাকা ফেরালেও তিনি তার একটি কপর্দকও নিজে নেবেন না। নেওয়ার কোনও বাসনাই তাঁর নেই। কারণ, তিনি তো দেশবাসীর সেবায় আত্মোৎসর্গীকৃত এক সন্ন্যাসীসম। তাঁর নিজের জন্য কোনও পয়সাকড়ির প্রয়োজন নেই। তাহলে বিদেশ থেকে ফিরিয়ে এনে ওই বিপুল পরিমাণ টাকা তিনি কী করবেন? নিজের প্রশ্নের জবাব নিজেই দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, প্রতিটি ভারতবাসীর ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে তা সমানভাবে ভরে দেবেন। তাতে কত করে পাবেন প্রতিটি ভারতবাসী? মাথাপিছু পনেরো লক্ষ টাকা। শুনে চোখ ছানাবড়া হয়ে উঠেছিল দিন আনা দিন খাওয়া বিপুল সংখ্যক ভারতবাসীর। এত টাকা! এও কি সম্ভব? আবার মানুষটি যেভাবে বলছেন তাতে তাঁকে অবিশ্বাস করতেও মন সায় দেয় না। বরং বিশ্বাসের দিকেই পাল্লা ভারী হয়।
আর কী বললেন মোদি? তিনি ক্ষমতায় এলে বছরে দু’কোটি ছেলেমেয়ে চাকরি পাবে। বেকারত্বের অভিশাপ থেকে মুক্তি ঘটবে কোটি কোটি শিক্ষিত অথচ একটি চাকরি জোগাড় করতে না পারার ব্যর্থতায় মরমে মরে থাকা অসংখ্য তরুণ প্রাণের। একবার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার অর্থ সাধারণ হিসেবে পাঁচ বছরের জন্য সিংহাসন। অর্থাৎ মোট অন্তত দশ কোটি বেকারের চাকরি। লোকটা নাকি গুজরাতে গত বারো-তেরো বছরে এমন অবিশ্বাস্য উন্নয়ন ঘটিয়েছেন যে বেকার নামক শব্দটিই ওই রাজ্যের অভিধান থেকে ধাঁ হয়ে গিয়েছে। সেখানে ঘরে ঘরে সুখ। সুখের জোয়ার। সুখের বান। সুখ-স্বস্তির জোয়ারে ভেসে যাচ্ছে রাজ্যটা। একসময়ে ছিলেন দরিদ্র চা-ওয়ালা। তিনি এমন অসাধ্যসাধনই করেছেন। তাঁর সাফল্য তো আসলে বিপুল সংখ্যক গরিব ভারতবাসীরই সাফল্যের নামান্তর। সে ওই স্যুটবুট পরা বড়লোকদের নয়, আসলে আমজনতারই প্রকৃত প্রতিনিধি।
এত কথা বাকি ভারত জানল কী করে? ওমা তাও জানো না? টিভির পর্দায়, খবরের কাগজের পাতায় পাতায়, হোর্ডিংয়ে-পোস্টারে, নেতাদের বক্তৃতায়, ঘরোয়া জমায়েতে ও কথাই তো বলা হচ্ছে। সবাই যখন একই কথা বলছে, ব্যাপারটা নিশ্চয়ই সত্যি। মনমোহন সিং নামের মানুষটির গত দশ বছরের শাসনে প্রায় মরতে বসা দেশটায় নতুন করে প্রাণসঞ্চারের জাদু-জল তো মোদিজির হাতের কমণ্ডলুতেই রাখা রয়েছে। তা ব্যবহারের সুযোগ চাই। তাহলে ভারতবাসীর পবিত্র কর্তব্য কী? মোদি নামক নয়া দেবদূতকে প্রধানমন্ত্রী বানাতে যা করণীয় তা করতেই হবে। হলও তাই। হ্যামলিনের সেই বাঁশিওয়ালার ডাকের মতো লাখো লাখো ভোটার ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। তাঁকে সিংহাসনের দিকে এগিয়ে দিলেন। দেশসেবার জন্য ‘সর্বস্বত্যাগী’ গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী হলেন তামাম ভারতের প্রধানমন্ত্রী।
তারপর? সম্ভবত মাথাপিছু পনেরো লাখ টাকার আশাতেই ব্যাঙ্কের দরজায় দরজায় লম্বা লম্বা লাইন পড়ল। সবাই ব্যাঙ্ক অ্যাকউন্ট খুলতে চায়। জনধন অ্যাকাউন্ট। অ্যাকাউন্ট তো খোলা হল। কিন্তু টাকা ঢুকল কই? বিদেশ থেকে লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা কালো টাকা আসার কথা ছিল। তার দেখা তো মিললই না, উল্টে নীরব মোদি, মেহুল চোকসি, বিজয় মালিয়াদের জাদুর জোরে হাজার হাজার কোটি সাদা টাকা দেশের বাইরে চলে গেল। দেশের টাকা মেরে ভাগনেওয়ালাদের কেউ আমাদের প্রধানমন্ত্রীর দাওয়ায় বসে তাঁর স্বকণ্ঠে ‘ভাই’ বলে আপ্যায়িত হয়েছেন, কেউবা বিদেশের মাটিতে প্রধানমন্ত্রীর অনুষ্ঠানমঞ্চ আলো করে নিজের উপস্থিতি জানান দিয়েছেন। আবার, এক ভাগনেওয়ালা নাকি প্রধানমন্ত্রীর এক বিশ্বস্ত সেনাপতিকে আগাম জানিয়েই দেশ থেকে ধাঁ হয়েছেন বলে নিজেই দাবি করেছেন। কেন এমন হল?
দেখতে দেখতে পাঁচবছর কেটে গেল। সেই বছরে দু’কোটি চাকরির ব্যাপারটা কী হল? শুধু চাকরি! মেক ইন্ডিয়ার মাধ্যমে আরও বহু কোটি কর্মসংস্থানের স্বপ্ন? পাঁচ বছরে মোট দশ কোটি চাকরি! সব মিলিয়ে পাঁচ লাখ হয়েছে তো? আর মেক ইন ইন্ডিয়া? ভারতবাসী সকাল থেকে রাত অবধি যে যে পণ্য ব্যবহার করে তার শতকরা আশিটিতেই তো মেড ইন চায়না ছাপ! এর জন্য কার ব্যর্থতা দায়ী?
তারপরও রয়ে যাচ্ছে আচমকা নোট বাতিল ও অপরিণত জিএসটি চালুর বিষয়দুটি। গত ২০১৬ সালের নভেম্বরের এক সন্ধ্যায় আচমকাই পাঁচশো ও এক হাজার টাকার চালু সমস্ত নোটকে বাতিল ঘোষণা করেছিলেন মোদিজি। তখন কী বলেছিলেন? বলেছিলেন, নোট বাতিলের ফলে কালো টাকার কবর হবে, আর কোমর ভেঙে যাবে জঙ্গিদের। এর সুবাদে নিত্যপণ্যের দাম কমবে, কোটি কোটি কর্মসংস্থান হবে। সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনে সুখের দিশা মিলবে। দেশ থেকে সন্ত্রাসবাদ লেজ গুটিয়ে বিদায় নিতে বাধ্য হবে। দেশবাসী নিশ্চিন্তে দিন কাটাতে পারবেন।
ওই নোট-বাতিল পর্বের পর আড়াই বছরেরও বেশি সময় কেটে গিয়েছে। কী ফল পেলেন ভারতবাসী? বাতিল হওয়া তথাকথিত বিপুল পরিমাণ কালো টাকার প্রায় সবটাই ব্যাঙ্কে ফিরে এসেছে। অর্থাৎ কালো টাকার দানবীয় যে উপস্থিতির গল্প ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল তা নেহাতই রটনা ছিল। অথবা, মোদিজির ওই পদক্ষেপের সুযোগে বিপুল পরিমাণ কালো টাকা কোনও অদৃশ্য জাদুর ছোঁয়ায় সাদা হয়ে গিয়েছে। এতে লাভবান হল কারা? অন্যদিকে, সাধারণ মানুষ কী পেলেন? পেলেন বেশ কিছুদিনের জন্য সীমাহীন উদ্বেগ। নিজের কষ্টার্জিত টাকা ঠিকঠাক রাখতে দুর্ভোগের একশেষ হতে হল। এটিএমের সামনে লাইন দিতে গিয়ে কিছু মানুষের অকালমৃত্যু হল। শুধু তাই নয়, নোট বাতিলের জেরে লক্ষ লক্ষ সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ রাতারাতি কাজ খোয়ালেন। তাঁদের উপার্জন গেল, জীবিকা গেল। অনেকেই নড়বড়ে শিরদাঁড়া চুরমার হয়ে গেল। দিনের স্বস্তি, রাতের ঘুম উড়ে যাওয়া অনেক মানুষ চিরকালের মতো মুখ খুবড়ে পড়লেন। এর দায় কার?
আর জিএসটি? নেহরুকে পাল্লা দিয়ে নয়া ইতিহাস রচনার তীব্র বাসনায় মেদিজি মধ্যরাতে সংসদের অধিবেশন ডেকে যে অপরিণত জিএসটি চালু করলেন তার ফল কী হল জানেন তো? আপনি না জানলেও কোটি কোটি সাধারণ ভারতবাসী তা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছেন। এখনও পাচ্ছেন। ছোট ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের কোমর ভেঙে গিয়েছে। বহু ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান পাততাড়ি গোটাতে বাধ্য হয়েছে। যারা কোনও রকমে টিঁকে গিয়েছে তাদের হালও যথেষ্টই খারাপ। এর জেরে লক্ষ লক্ষ সাধারণ কর্মচারীকে মালিকরা দরজা দেখিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন। বহু সকার ব্যক্তি নতুন করে বেকার হয়েছেন। তাঁদের পরিবার পরিজন অথৈ জলে পড়েছেন। পরিবারের ভরণপোষণ, সন্তানের শিক্ষা, ভবিষ্যৎ—সব কিছুই অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। এমন পরিণতির জন্যই কি ২০১৪ সালে বিপুল সমর্থন দিয়ে মোদিজিকে ক্ষমতায় আনার জন্য সক্রিয় হয়ে উঠেছিলেন ওই লক্ষ লক্ষ মানুষ? এটাই কি তাদের প্রত্যাশা ছিল? মোদিজির বহু প্রতিশ্রুত ‘সবকা সাথ সবকা বিকাশের’ই বা কী হল? কোথায় গেল ‘আচ্ছে দিন’?
ফের প্রধানমন্ত্রী হতে চাইছেন নরেন্দ্র মোদি। নিজের পক্ষে ভোট জোগাড়ে আপাতত তাঁর পরিশ্রমের শেষ নেই। ফের হরেক রকম গল্প শোনাচ্ছেন। হরেক আবেগে সুড়সড়ি দিচ্ছেন। কিন্তু তার আগে আগের প্রশ্নগুলির জবাব দিন। নতুন ক্লাসে ভর্তি হতে চাইলে আগের ক্লাসের রিপোর্ট কার্ড দেখানোই দস্তুর। সেখানে পাশ করতে হয়। মোদিজির গত পাঁচ বছরের রিপোর্ট কার্ড কী বলে?