উপার্জন বেশ ভালো হলেও ব্যয়বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে সঞ্চয় তেমন একটা হবে না। শরীর খুব একটা ... বিশদ
ভারতের রাজনীতিতে পরিবারতন্ত্রের পথিকৃৎ কংগ্রেস। এর শুরু জওহরলাল নেহরুকে দিয়ে, যখন তিনি তাঁর উত্তরসূরিকে নিজের পরিবার থেকেই বেছে নিয়েছিলেন। তিনি ১৯৫৯ সালে তাঁর ৪২ বছরের কন্যা ইন্দিরাকে কংগ্রেস সভাপতি হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। মহাত্মা গান্ধী একবার বলেছিলেন যে স্বাধীনোত্তর যুগে কংগ্রেসকে এমনভাবে তৈরি করতে হবে যাতে দলটিকে গণতান্ত্রিক ভারতের উপযুক্ত করে তোলা যায়, ব্রিটিশ ইন্ডিয়ার সময়কার নয়। কিন্তু, এর এক দশকের মধ্যেই স্বাধীনতা সংগ্রামীদের দল থেকে কংগ্রেস পারিবারিক-অধীনস্থ একটি সংস্থায় পরিণত হয়েছিল। ভারতের পরিবারতান্ত্রিক রাজনীতির প্রথম পদক্ষেপটি নিয়েছিলেন জওহরলালই। তাঁর কন্যা ইন্দিরা সেই ধারাটিকে মজবুত করেছিলেন। রাজীব গান্ধী, সঞ্জয় গান্ধী, সোনিয়া গান্ধী, রাহুল গান্ধী থেকে শুরু করে হালে সক্রিয় রাজনীতিতে প্রিয়াঙ্কা গান্ধী ওয়াধেরার প্রবেশ নতুন করে প্রমাণ করেছে যে ভারতের পরিবারতান্ত্রিক রাজনীতি আদতে জন্মাধিকার সূত্রে নিয়ন্ত্রিত। শুনলে অবাক হবেন, দ্বিতীয় লোকসভায় পরিবারকেন্দ্রিক সাংসদের সংখ্যাটা ছিল ২। সেটাই পঞ্চদশ লোকসভায় হয়েছে ৫৩। স্বাধীনতার পর থেকে সবচেয়ে বেশি সময় দেশ চালিয়েছে কংগ্রেস। ফলে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে স্বজনপোষণের অভিযোগ তোলার সুযোগ বেশি। বিজেপির নির্বাচনী ইতিহাস শুরু হয়েছে সবে আশির দশকে। লোকসভার তথ্যই জানাচ্ছে, এরই মধ্যে পরিবারতন্ত্র জাঁকিয়ে বসেছে বিজেপিতেও। ইতিহাসের ধারা বজায় রয়েছে ১৬তম লোকসভা নির্বাচনেও। প্রয়াত বেদপ্রকাশ গোয়েলের নাম কে শোনেননি। বিজেপির রাষ্ট্রীয় কোষাধ্যক্ষ ছিলেন দীর্ঘদিন। অটলবিহারী বাজপেয়ির মন্ত্রিসভায় জাহাজ মন্ত্রীও ছিলেন। তাঁর ছেলে পীযূষ গোয়েল এখন কেন্দ্রের রেলমন্ত্রী। হিমাচলের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী প্রেম কুমার ধুমলের ছেলে অনুরাগ ঠাকুর বিজেপি সংসদ সদস্যই শুধু নয়, ভারতীয় ক্রিকেটের হর্তাকর্তাও। ২০০৬ সালের ২২ এপ্রিল নিজের ভাই প্রবীনের গুলিতে প্রাণ হারিয়েছিলেন বিজেপির শীর্ষনেতা, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী প্রমোদ মহাজন। প্রয়াত প্রমোদ মহাজন কন্যা পুনম মহাজন এখন বিজেপির সংসদ সদস্য, যুব মোর্চার সর্বভারতীয় সভানেত্রীও। প্রমোদ মহাজন ছিলেন কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রী তথা মহারাষ্ট্রের জনপ্রিয় বিজেপি নেতা গোপীনাথ মুন্ডের শ্যালকও। ২০১৪ সালে পথ দুর্ঘটনায় মারা যান গোপীনাথ মুন্ডে। বিড কেন্দ্রে উপনির্বাচনে রেকর্ড ভোটে জেতেন গোপীনাথ মুন্ডের দ্বিতীয় মেয়ে প্রীতম মুন্ডে। আর বড় মেয়ে পঙ্কজা মুন্ডে এখন মহারাষ্ট্রের নারী ও শিশুকল্যাণ মন্ত্রী। মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী দেবেন্দ্র ফড়নবিশের বাবা গঙ্গাধর ফড়নবিশ বিজেপির শীর্ষ নেতা ছিলেন। পিসি শোভা ফড়নবিশ ওই রাজ্যের মন্ত্রীও ছিলেন। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী কিরণ রিজিজুর বাবা রিনচিন খারু অরুণাচল প্রদেশের প্রথম প্রোটেম স্পিকার ছিলেন। বাজপেয়ি সরকারের মন্ত্রী ছিলেন বিজেপি নেতা দেবেন্দ্র প্রধান। তাঁর ছেলে ধর্মেন্দ্র প্রধান এখন পেট্রোলিয়াম মন্ত্রী। আরও তথ্য চান?
উত্তরপ্রদেশের একসময়ের স্বাস্থ্যমন্ত্রী তথা বিহারের রাজ্যপাল লালজি ট্যান্ডনের পুত্র আশুতোষ ট্যান্ডন এখন প্রযুক্তি ও স্বাস্থ্যশিক্ষা মন্ত্রী। রাজস্থানে বিজেপির শীর্ষনেতা বিজয়রাজে সিন্ধিয়া। বসুন্ধরা রাজে সিন্ধিয়া তাঁরই মেয়ে। বিজেপির মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন রাজস্থান থেকে। বসুন্ধরা রাজের ছেলে দুষ্মন্ত সিং এখন সংসদ সদস্য। এবারও লোকসভায় প্রার্থী হয়েছেন। বসুন্ধরা রাজের বোন যশোধরা রাজে মধ্যপ্রদেশে মন্ত্রী ছিলেন। বিজেপির নেতা ও বর্তমানে রাজস্থানের রাজ্যপাল কল্যাণ সিংয়ের ছেলের নাম রাজবীর সিং। তিনি এটা আসন থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য। এবার লোকসভা ভোটে নয়ডা আসনের জন্য টিকিট পেয়েছেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংয়ের ছেলে পঙ্কজ সিং। কর্ণাটকের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর নাম বি এস ইয়েদুরাপ্পা। তাঁর সাংসদ ছেলে বিওয়াই রাঘবেন্দ্র ওই রাজ্যের শিমোগা লোকসভা আসন থেকে ফের প্রার্থী হয়েছেন। বিজেপিতেও যে পরিবারতন্ত্রের গভীর অবদান রয়েছে, এই অসম্পূর্ণ তালিকা তার উদাহরণ মাত্র। আসলে ভারতীয় রাজনীতি মানে, ছোটবেলার সেই সহজ বাক্যটা বারবার ফিরে আসে। ‘বাবার হল আবার জ্বর, সারিল ঔষধে।’ মোগল সাম্রাজ্যের অধিপতিদের নাম মনে রাখার জন্য এটাই ছিল টোটকা। সেই সাম্রাজ্যের পতন হয়েছে বহুকাল। কিন্তু, সেই ‘ব্যামো’ সারেনি। পরিবারতন্ত্রের ব্যামো!
লোকসভার তথ্যই বলছে, ২০১৪ থেকে ২০১৯-এ পরিবারতন্ত্রের সঙ্গে যোগ রয়েছে এমন সংসদ সদস্যের সংখ্যাটা কংগ্রেসের তুলনায় বিজেপিতে দাঁড়িয়েছে দ্বিগুণেরও বেশি। বিজেপির ২০ জন এবং কংগ্রেসের ৮ জন। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা পরিসংখ্যান ঘেঁটে যে তথ্য তুলে এনেছেন তাতে স্পষ্ট, পরিবারের গুরুত্বকে উপেক্ষা করতে পারছে না বিজেপিও। পরিবারতন্ত্রের প্রভাব যথেষ্ট আঞ্চলিক দলগুলিতেও। ত্রয়োদশ লোকসভায় বিজেপি শরিক শিরোমণি অকালি দলে সংখ্যাটা শতকরা ৫০। রাষ্ট্রীয় লোক দলেও তাই। জেডিইউয়ে ২২ শতাংশ। ফারুক আবদুল্লার ন্যাশনাল কনফারেন্সে ২০ ও নবীন পট্টনায়কের বিজু জনতা দলে ১৮ শতাংশ। পরিবারতন্ত্র কায়েম করার ক্ষেত্রে আঞ্চলিক দলগুলোও পিছিয়ে নেই। উত্তরপ্রদেশের যাদব পরিবারও কম যায় না। মুলায়ম সিংহ পরিবারে অনেক কোন্দল থাকলেও উত্তরপ্রদেশের ‘যাদববংশ’-ই দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক পরিবার। চমকে যেতে হয় যাদব পরিবারের বংশতালিকা দেখলে। সেখানে সবাই নেতা, সবাই বড় বড় দায়িত্বে। যে কোনও নির্বাচনেও ‘নেতাজি’ মুলায়ম সিং যাদবের গোটা পরিবারই অংশ নেয়। ছেলে অখিলেশ থেকে ছেলের বউ ডিম্পল, অপর্ণারা রাজনীতির সামনের সারিতে। এছাড়াও, ভাই, ভাইপো, ভাইপো বউ, শ্যালক — কাউকেই রাজনৈতিক ‘মধুভাণ্ড’ থেকে বঞ্চিত করেননি মুলায়ম সিং যাদব। অন্যদিকে, বিহারের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী লালুপ্রসাদ যাদবের পরিবারের দিকে তাকান। মেয়ে মিশা ভারতী থেকে ছেলে তেজস্বী যাদব — কেউ বিধায়ক তো কেউ সংসদ সদস্য। রামবিলাস পাশোয়ানের সংসদ সদস্য ছেলে চিরাগ বাদ যাবে কেন। তাঁকেও দলের টিকিট দেওয়া হয়েছে এবারের লোকসভা ভোটে। উত্তরপ্রদেশে রাষ্ট্রীয় লোকদল প্রধান অজিত সিং নিজে এবার ভোটে লড়ছেন। তার সঙ্গেই ছেলে জয়ন্ত চৌধুরীকে ভোটে লড়াই করার সুযোগ করে দিয়েছেন। গজওয়েল বিদায়ী মুখ্যমন্ত্রী কে চন্দ্রশেখর রাও (কেসিআর)-এর বিধানসভা কেন্দ্র। তাঁর হয়ে গোটাটাই সামলান ভাগ্নে হরিশ রাও। সিদ্দিপেট বিধানসভা থেকে রেকর্ড ১ লাখ ২০ হাজারের বেশি ভোটে জিতেছেন হরিশ। চন্দ্রশেখর টিআরএসের কার্যকরী সভাপতি পদে তাঁর ছেলে তথা মন্ত্রিসভার সদস্য কে টি রামা রাওকে ইতিমধ্যে নিযুক্ত করে দিয়েছেন। তেলেঙ্গানার মুখ্যমন্ত্রী নিজামাবাদ লোকসভা কেন্দ্রে প্রার্থী করেছেন মেয়ে কে কবিতাকে। তামিলনাড়ুতে প্রয়াত জননেতা করুনানিধির পরিবারের পরিবারতন্ত্র কি কোনও অংশে গান্ধী পরিবারের থেকে কম? ডিএমকের প্রার্থী তালিকায় রয়েছেন একাধিক নেতা-মন্ত্রীর ছেলে-মেয়েরা। প্রার্থী করা হয়েছে প্রয়াত ডিএমকে সুপ্রিমো এম করুণানিধির কন্যা কানিমোঝি, প্রপৌত্র প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী দয়ানিধি মারান, পার্টির শীর্ষ নেতা দুরাই মুরুগানের ছেলে ডি এম কাথির আনন্দ, অপর শীর্ষ নেতা আর্কোট এন বীরস্বামীর ছেলে ডা. কলানিধি বীরস্বামী, বিধায়ক ও প্রাক্তন মন্ত্রী কে পোনমুডির ছেলে গৌতম সিগামানিদের। বারামতীতে যেমন শরদ পাওয়ারের উত্তরসূরি হিসেবে তাঁর মেয়ে সুপ্রিয়া সুলে দলের সাংসদ। এ বারও ভোটে তিনি লড়ছেন। ওড়িশায় বিজু পট্টনায়েক পরিবার, পাঞ্জাবে অমরিন্দর সিংয়ের পরিবার, উত্তরপ্রদেশে মায়াবতীর ভাই-ভাইপো। বালাসাহেব থ্যাকারেও এই রাজনীতিই করেছেন শিবসেনায়। সেখান থেকে আলাদা হয়েও এই সংস্কৃতির মধ্যে কোনও ভুল দেখে না এমএনএস। এমন উদাহরণ আরও আছে, আরও অনেক। ভারতে পরিবারতন্ত্রের এই গল্প শেষ হবার নয়। ফলে খাতায়-কলমে দেশের বহু লোকসভা আসন কখনও কংগ্রেস, কখনও বিজেপি, কখনও বা আঞ্চলিক দলগুলির হাতে গেলেও বাস্তবে এগুলি দলের হাতে নয়, থেকে যায় কয়েকটি পরিবারের হাতেই। ফলে পরিবারতন্ত্র চলছেই। জলে নেমে কুমিরের সঙ্গে লড়াই করেছিলেন বালক নরেন্দ্র। এ কাহিনী গুজরাত জানে। এই কাহিনী প্রধানমন্ত্রীর সব জীবনীকারই তাঁদের বইতে লিখেছেন। আজকের নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদি নিয়মিত স্নান করতেন বরানগরের শর্মিষ্ঠা সরোবরে। লোকে বলত, ওই সরোবরে অনেক কুমির রয়েছে। কিন্তু , সেই সব সাবধানবাণীকে পাত্তা না দিয়েই শর্মিষ্ঠা সরোবরে নিয়মিত এপার-ওপার করত বালক নরেন্দ্র। তখন তিনি অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র। যে কাহিনী শোনা যায়, তাতে ওই সরোবরের মাঝখানে ছিল একটি কৃষ্ণ মন্দির। প্রবল বৃষ্টিতে সেবার গোটা মন্দিরটাই জলের নীচে চলে যায়। এমনকী, তার চূড়ায় যে গেরুয়া পতাকা ছিল সেটাও জলে ভেসে যায়। নিয়ম ছিল, সেই পতাকা বছরের একটি বিশেষ দিনে বদলাতে হবে। কিন্তু সেই পতাকা ভেসে গেলে কী হবে? গ্রামের অকল্যাণ হবে না তো! গোটা গ্রামেই ছিল আতঙ্ক। কিন্তু তার থেকেও বড় আতঙ্ক ছিল কুমির নিয়ে। কে নামবে জলে? সাহসী বালক নরেন্দ্র কিছু না ভেবেই ঝাঁপ দিয়েছিলেন। পুরনো পতাকা নামিয়ে নতুন গৈরিক পতাকা বসিয়ে দিয়ে এসেছিলেন মন্দিরের চূড়ায়। আর তখনই জল থেকে ওঠার সময় তুলে নিয়ে এসেছিল জ্যান্ত কুমির ছানা। সকলে চিৎকার করে উঠছিল—‘ফেলে দে ফেলে দে।’ ফেলেও দিয়েছিলেন সবার কথা শুনে। পরে নাকি নরেন্দ্র বলেছিলেন, ‘মগর মাছ মানে যে ভয়ঙ্কর ব্যাপার, সেটা বুঝতে পারিনি।’
সেই নরেন্দ্র দেশের প্রধানমন্ত্রী হয়ে সত্যি সত্যিই হাঙর ধরেছেন। ভারতীয় রাজনীতিতে রাজনৈতিক ‘হাঙর’ পরিবারতন্ত্রের মূলে কুঠারাঘাত করেছেন। কিন্তু ভারতীয় রাজনীতিতে তাঁর দলেও যে পরিবারতন্ত্র জাঁকিয়ে বসে আছে, তার উদাহরণও তো ভূরি ভূরি। নিজের দলের অন্দরে সেই পরিবারতন্ত্রের মূল কি উপড়ে ফেলার সাহস দেখাবেন? ভোট প্রচারে সেই প্রশ্নও যে মোদির পিছু নিয়েছে!