উপার্জন বেশ ভালো হলেও ব্যয়বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে সঞ্চয় তেমন একটা হবে না। শরীর খুব একটা ... বিশদ
আমাদের গত পাঁচ বছরের অভিজ্ঞতা একটি ব্যক্তি বা সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের ওপর দেশের সব দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়া যায় কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন তুলে দিয়েছে। ভারত নামে নানা ধর্ম, নানা ভাষা, নানা মতের একটি বিরাট দেশকে কোন বিশেষ দলের হাতে ছেড়ে দিলে তার ফল যে খুব একটা ভালো হয় না তা আমরা নিজেদের জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়েই বুঝেছি। বিশেষ করে সাম্প্রতিক সময়ে ডিমনিটাইজেশন, ফসলের দাম না পেয়ে কৃষকদের মৃত্যু, ধর্মের ভিত্তিতে দেশকে বিভাজনের চেষ্টা, আর্থিক সংস্কারের ব্যর্থতাকে দেশে সুশাসনের অভাব ছাড়া আর কিছুই বলা যাবেনা।
এই পরিস্থিতিতে দেশের বহু মানুষ ভাবতে শুরু করেছেন বিজেপির একদলীয় শাসন দেশের গণতন্ত্র ও ধর্ম নিরপেক্ষতার পক্ষে বিপজ্জনক। উত্তরপ্রদেশে বিজেপি সরকারের কার্যকলাপ এই ধারণাকে আরও শক্তিশালী করেছে। সেখানে বেড়েছে ধর্মীয় বিদ্বেষ ও দাঙ্গার ঘটনা। সুশাসন ও সামাজিক শান্তি সেখানে প্রায় নেই বললেই চলে।
এবারের ভোটে শাসকদলের জোট মোটামুটি একটা চেহারা পেয়েছে। একথা মানতেই হবে বিজেপির নেতৃত্বে এনডিএ অনেক বেশি সংহত। শিবসেনাদের মত শরিকদের সঙ্গে বিজেপির যে বিরোধ ছিল তা অনেকটাই এখন মিটে গিয়েছে। তুলনামূলকভাবে বিরোধী শিবিরে অনৈক্য বেশি। কংগ্রেসের খবরদারি মমতা, অখিলেশ, মায়াবতী কেউই মানতে রাজি নয়। শতাব্দী প্রাচীন এই দলটি নিজেদের স্বার্থ ছাড়া আর কিছুই বোঝে না। কেরলে রাহুল গান্ধী প্রার্থী হওয়ায় প্রতিবাদ জানিয়েছে সিপিএম। ফলে বিরোধী দলগুলির মধ্যে জটিলতা আরও বেড়েছে।
একদলীয় সরকারের সমর্থকরা কোয়ালিশন সরকারকে বলেন ‘মিলাওয়াটি সরকার’ বা ‘খিচরি সরকার।’ তাদের মতে এরফলে কোন আদর্শ বা কাজ রূপায়ণ করা অসম্ভব। কোনও কর্মসূচি রূপায়ণে সিদ্ধান্তহীনতা ও কালক্ষেপের ফলে দেশ ক্ষতিগ্রস্থ হয়, প্রকল্পের ব্যয় বাড়ে, মতপার্থক্যের ফলে বহু কাজ অর্ধসমাপ্ত হয়ে পড়ে থাকে। কিন্তু আপাতদৃষ্টিতে একথা ঠিক মনে হলেও এমন কথা ভাবার কোনও কারণ নেই যে কোয়ালিশন সরকার মানেই তা একটি ব্যর্থ সরকার। ১৯৯১-এ প্রথম ইউপিএ সরকারের আমলেই সংখ্যালঘুদের অধিকার সংরক্ষণের মত গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু উত্তরপ্রদেশে ২০১৭ তে ক্ষমতায় আসা যোগী সরকার সামাজিক শান্তি ও সুশাসন কোনওটাই সুনিশ্চিত করতে পারেনি। কেরল, তামিলনাডু-র মত কোয়ালিশন সরকার শাসিত রাজ্যগুলি উন্নয়ন ও সুশাসনের বিচারে অনেকটা এগিয়ে আছে। দেশের বহুত্ব এবং শাসন ক্ষমতায় সবার প্রতিনিধিত্ব মানতে হলে কোয়ালিশন সরকার শ্রেষ্ঠ সমাধান।
কোয়ালিশন মানে শুধু বিশেষ কোনও গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়কে নিয়ে না চলা একটি বিকেন্দ্রীভূত নীতি। এরফলে দেশের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলির গুরুত্ব বাড়ে। দেশের আঞ্চলিক বৈচিত্র্য, সমস্যা, জনগোষ্ঠীর নিজস্বতাকে স্বীকার করেই সমস্যা সমাধানের চেষ্টা হয়। অর্থাৎ বিকাশের রাস্তায় সে সমাজের সব অংশের মানুষকে সঙ্গে নিয়ে চলার চেষ্টা করে। একদলীয় শাসনে একটা অসুবিধা হল, সরকার তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরেই নিজেদের আদর্শ ও দৃষ্টিভঙ্গি দেশের ভালো মন্দের তোয়াক্কা না করে মানুষের ওপর চাপিয়ে দেয়।
গত পাঁচ বছরের অভিজ্ঞতায় আমরা দেখেছি বিপুল ভোটে জিতে আসা বিজেপি পরিচালিত সরকার সুশাসনের কোনও নমুনা তৈরি করতে পারেনি। ঘৃণার রাজনীতি দেশজুড়ে মানুষে মানুষে বিভেদ বাড়িয়েছে, ব্যাহত হয়েছে অর্থনৈতিক উন্নয়ন। পুলওয়ামা কাণ্ডের পর দেশজুড়ে যে দেশপ্রেমের আবহাওয়া সৃষ্টি করা হচ্ছে তাতেও কিন্তু এই অবস্থা ঢাকা যাচ্ছে না। জঙ্গিদের সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াই, দেশের ভূখণ্ডে হানাদারদের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠাকে আমরা সবাই মুক্তকণ্ঠে সমর্থন জানাই। কিন্তু জাতীয় নিরাপত্তার নামে একটা লড়াইয়ের আবহাওয়া তৈরি করে দেশের অর্থনীতির করুণ দশাকে ঢেকে রাখার অপচেষ্টাকে মানুষ সমর্থন করে না।
বিরোধী দলগুলির অনৈক্যও বিজেপির অপশাসনের জন্য অনেকটা দায়ী। আমরা ভেবেছিলাম, বিজেপির আমলে দেশের কর্মসংস্থান বাড়বে। দেশের সম্পদ ও মানব সম্পদকে যথার্থভাবে কাজে লাগিয়ে বেকারত্বের অবসান ঘটবে, কিন্তু তা হয়নি। অথচ দেশের বিরোধী দলগুলি নানা ব্যাপারে বিজেপির সমালোচনা করলেও এমন একটা গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে কোন যৌথ আন্দোলন গড়ে তুলতে পারলেন না। জাতীয় পরিসংখ্যান কমিশনের রিপোর্ট থেকে দেখা যাচ্ছে এব্যাপারে সরকার দেশের মানুষের কাছে ভুল তথ্য দিয়েছিলেন। এটাও খুব আশ্চর্যের ব্যাপার সংসদে তো বটেই এমনকী রাজ্যস্তরেও বিজেপির ব্যর্থতা নিয়ে সংশ্লিষ্ট রাজ্যের বিরোধী দলগুলি জোট বেঁধে লড়াই করতে ব্যর্থ হলেন। ব্যতিক্রম পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি বরাবরই বিজেপি বিরোধী লড়াইয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছেন। স্রেফ রাজনৈতিক বিরোধিতার কারণেই বাংলার সিপিএম ও কংগ্রেস দল এব্যাপারে তার সঙ্গে আসেনি। দেশ নয়, তাদের কাছে মমতা বিরোধিতাই বড় কথা।
বালাকোটের ঘটনার পর বিজেপি তাদের অর্থনৈতিক ব্যর্থতা ঢাকতে জাতীয় নিরাপত্তাকে বড় করে দেখাতে চেষ্টা করছে, সেটাই তাদের রাজনীতি। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে দেশজুড়ে কৃষকদের আত্মহত্যা থেকে জিএসটি, ডিমনিটাইজেশন, দেশের টাকা নিয়ে নীরব মোদি, মেহুল চোকসিদের বিদেশে পালিয়ে যাওয়ার মত এত ইস্যু থাকতেও বিরোধীরা কেন একটা বড় আন্দোলন গড়ে তুলতে পারলেন না তা খুব অবাক হওয়ার মত ব্যাপার!
অনেকে বলবেন কোয়ালিশন রাজনীতি এমন সিদ্ধান্তহীনতাতেই ভোগে। কোনও কাজ বা লড়াই শুরু করার আগে তাদের পরস্পরের বিরুদ্ধে অভিযোগ ও পাল্টা অভিযোগেই দিন কেটে যায়। কিন্তু এটা কোয়ালিশন রাজনীতির দোষ নয়। দোষ কংগ্রেস, সিপিএম সহ অন্যান্য আঞ্চলিক দলগুলির, যারা নিজেদের সঙ্কীর্ণ স্বার্থেই বিগত পাঁচ বছরে মোদি সরকারের বিরুদ্ধে তেমন কোন সংহত প্রতিবাদ গড়ে তুলতে পারেনি। বিজেপি এই ফাঁকা ময়দানে পরপর ছুঁড়ে দিয়েছে জাতীয় নিরাপত্তা, বালাকোট এয়ার স্ট্রাইক এবং শক্তি মিসাইলের মত তিনটি দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র। বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সফল হতে হলে বিরোধীদের দেশজোড়া একটা কোয়ালিশন গড়ে তুলতেই হবে। বন্ধ করতে হবে নিজেদের মধ্যে কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি। তবেই তারা বিজেপিকে সরিয়ে দেশের মানুষকে একটা প্রকৃত ও জনমুখী সরকার উপহার দিতে পারবে।