উপার্জন বেশ ভালো হলেও ব্যয়বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে সঞ্চয় তেমন একটা হবে না। শরীর খুব একটা ... বিশদ
অথচ এই উদ্দাম উচ্ছ্বাস ফুরিয়ে যেতেই আমরা দেখেছি সামাজিক বিভাজনের কঠিন রূপ। আবার যেখানে অপরিপক্ব রাজনৈতিক ব্যবস্থা গণতান্ত্রিক চাহিদার ‘ওভারলোড’ নিতে পারেনি। যেমন পাকিস্তান, সেখানে পুনঃপুন সেনা অভ্যুত্থানের ঘটনা ঘটেছে। তবে এটাই সামগ্রিক চালচিত্রের সবটা নয়। দক্ষিণ এশিয়ায় রাজনৈতিক ব্যবস্থার আপেক্ষিক দুর্বলতার জন্য দায়ী নেতৃত্বের দুর্বলতা এবং বিরূপ আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিতে বাহ্যিক শক্তির সাঁড়াশি চাপ, যা প্রায়শই শৈশব অবস্থায় গণতান্ত্রিক পুনর্গঠনকে ব্যাহত করেছে। রাজনীতিকে পরিচালিত করেছে সংঘাতের খাতে, টিকিয়ে রাখতে চেয়েছে পারস্পরিক যুযুধান জাতীয়তাবাদী ও ধর্মীয় ফ্রন্টগুলো যাতে রাষ্ট্রের দাপট তার বর্শামুখকে ভোঁতা না করে দেয়। তাই প্রথম থেকেই আমরা যতটা না জাতীয় লক্ষ্যের কথা ভেবেছি, তার থেকেও দেশ-ভাগ-উত্তর পরিস্থিতিতে পাকিস্তান-বিরোধিতা আমাদের রাজনীতির প্রধান আশ্রয় হয়ে উঠেছে। ফলে স্বাধীন দেশে যখন আমাদের সামনে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি ও তদনুরূপ পরিবর্তনের একটা সুবর্ণ সুযোগ এল—তখনও সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদী ঐতিহ্যের ওপরে ভর করে আমরা নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে চেয়েছি, যথার্থ inclusive policy আমরা প্রণয়ন করতে পারিনি।
ভেবে আশ্চর্য হতে হয় যে, স্বাধীনতার সাত দশক পরেও, নতুন করে জাতীয়তাবাদকে উস্কে দেবার অপচেষ্টা আমরা লক্ষ করছি। এর মধ্যে দুটি বিষয় প্রণিধানযোগ্য—(১) এটা রাজনীতিগতভাবে একটি স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক পরিচিতি তৈরি করার চেষ্টা। এই নির্মাণের প্রক্রিয়া আরও জোরদার হয়েছে কেন্দ্রে হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক শক্তির কার্যকলাপে। দ্বিতীয়ত, সাম্প্রতিককালে উরিতে পাক-জঙ্গিহামলা বা কাশ্মীরের অবন্তীপুরায় ভারতের আধাসেনা কনভয়ে অভূতপূর্ব জয়েশ হামলার অভিঘাতে আমরা চমকে উঠে লক্ষ করলাম ভারত উত্তর-আধুনিক রাষ্ট্র নয়, সে এখনও পুরনো ধারায় বর্তমান, জাতীয় সুরক্ষার প্রশ্নে প্রতিক্রিয়াশীল, এবং এমনকী পাল্টা আক্রমণেও পিছপা নয়। বস্তুত এই জাতীয়তাবাদী আস্ফালন কি ভারতের নয়া অর্থনৈতিক কূটনীতির সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ? হয়তো এই বিপরীতধর্মী টানাপোড়েনের অস্বস্তি আম জনতার কাছে ধরা পড়ে না, কিন্তু ভারত-পাক দ্বৈরথের মোকাবিলায় মানুষের যে স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া—তা দেখে মনে হয় যে তারা সন্ত্রাস নয়, শান্তি চায়। মানুষের এই যে চেতনা ও আগ্রহ তা কিন্তু সংকীর্ণভাবে কোনও ভূখণ্ডকেন্দ্রিক নয়, বরং এটাকে একটা বৃহত্তর আঞ্চলিক প্রেক্ষাপটে রেখে দেখা উচিত, যে রূপান্তরটা ইতিমধ্যেই আমরা ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যে মূর্ত হয়ে উঠতে দেখেছি। ২০১৪ সালে মোদির শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে সার্কের গোষ্ঠীভুক্ত রাষ্ট্রপ্রধানদের আহ্বানের মধ্য দিয়ে এমন একটা সৌহার্দপূর্ণ আঞ্চলিক বাতাবরণ নির্মাণের একটা রাজনৈতিক সুযোগ তৈরি হয়েছিল। কিন্তু যখন বিমুদ্রাকরণ নিয়ে সাধারণ মানুষের সীমাহীন ক্ষোভ, অন্যদিকে রাফাল বিমানের দাম বিতর্কে যখন ‘চৌকিদার’-এর দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ার অবস্থা, তখনই পুলওয়ামার ঘটনায় আশ্চর্যজনকভাবে ‘অক্সিজেন’ পেয়ে মোদি শিবির যেন খানিকটা চাঙ্গা। তবে ঘুরে দাঁড়াতে না দাঁড়াতেই পাক উজির-এ-আজম ইমরান খানের মন্তব্যে বিজেপি শিবিরে অস্বস্তি বেড়েছে। ইমরান আশা করেছেন, বিজেপির (বস্তুত মোদি-শাহ জোটের) বিজয়ে ভারত-পাক আলোচনার দরজা খুলে যাবে। এতেই অস্বস্তির সূত্রপাত। কারণ এতদিন বিজেপির পোস্টারবয় এই দুই ব্যক্তির নিশানা ছিল পাকিস্তান। তবে কি পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ধরে নিতে হবে ইমরানের ‘রিভার্স সুইং’ দুই পুরনো প্রতিপক্ষের গোপন বোঝাপড়ার ইঙ্গিতবাহী?
বস্তুত আশ্চর্যজনক হলেও পাকিস্তানের তরফে ভারতের নির্বাচনকে সর্বদাই দেখা হয়েছে তাদের জাতীয় স্বার্থের নিরিখে, বিশেষত কাশ্মীরকে কেন্দ্র করে ঘুঁটি সাজানোর ‘গেম প্ল্যান’ হিসেবে। প্রসঙ্গত স্মরণীয়, ১৯৬২ সালের সীমান্ত-সংঘাতের পর থেকে কাশ্মীরের ৩৮,০০০ বর্গকিমি চীনের দখলে রয়েছে। তদুপরি ১৯৬৩ সালে চীনের সঙ্গে সীমান্ত-বোঝাপড়ার মাধ্যমে পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরের ৫,১৮০ বর্গ কিমি চীনকে ছেড়ে দেয়। এখন ভারতের হাতে থাকা অবশিষ্টাংশও পাকিস্তান কব্জা করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। তাই ভারতের লোকসভা নির্বাচন পাকিস্তানের কাছে মুসলিমপক্ষীয় বা মুসলিম-বিরোধী এমন অক্ষ গঠনের তাৎপর্যের নিরিখে নয়; পাকিস্তান এ ব্যাপারে অবহিত যে, ভারতে মুসলিম জনসংখ্যা ১৭.২২ কোটি (২০১১ সেনসাস অনুযায়ী)। সেক্ষেত্রে পাক হামলায় মুসলিম জনগোষ্ঠীর নিরাপত্তাও ক্ষুণ্ণ হতে পারে।
অন্যদিকে, ভারতের নির্বাচনকে চীন গুরুত্ব দিলেও তাদের কাছে বিষয়টা কমিউনিস্ট-ভাবাদর্শের প্রোপাগান্ডাকে জোরদার করার দিক থেকে নয়, কারণ ভারতের কমিউনিস্ট দলগুলি বরাবরই চীনপন্থী। তাই আলাদা করে তাদের সমর্থন লাভের বিষয়টি বাহুল্যমাত্র। তাছাড়া ইতিমধ্যেই পুরনো ভুলের মাশুল দিতে যখন তাদের হিমশিম অবস্থা, তখন চীন এতটা অপরিপক্ব নয় যে, সে বিপন্ন কমিউনিস্ট দলগুলিকে নির্বাচনের বাজি ধরবে। অতএব চীনের কাছেও ভারতের লোকসভা নির্বাচন, তাদের জাতীয় স্বার্থ—ডোকালাম ইস্যু, অরুণাচল-সমস্যার মতো সীমান্তভিত্তিক ইস্যুগুলির মীমাংসার প্রধান উপায়।
তবে, শুধু চীন বা পাকিস্তানই নয়, এই নির্বাচনের অন্যতম প্রধান চ্যালেঞ্জ হল কীভাবে তা সংঘটিত হচ্ছে। নির্বাচনের পবিত্রতা ও কমিশনের নিরপেক্ষতাকে টি এন সেশন যে উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন—তা কি আমরা বজায় রাখতে পারব? ইতিমধ্যেই আমরা উত্তরবঙ্গ, ত্রিপুরা ও অন্যত্র হিংসা লক্ষ করেছি। গণতন্ত্র যদি ‘Soft Power’ হয়, তবে এই হিংসার দরুন ভারতের ইমেজ সাফার করবে। যথার্থ গণতন্ত্র যেমন বিরোধীপক্ষকে সম্মান করে, তেমনি দক্ষিণ এশিয়ায় সেই সংস্কৃতি কবে গড়ে উঠতে আমরা দেখব?
লেখক সিধো কানহো বীরসা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্র- বিজ্ঞানের অধ্যাপক (মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)