উপার্জন বেশ ভালো হলেও ব্যয়বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে সঞ্চয় তেমন একটা হবে না। শরীর খুব একটা ... বিশদ
আকাশ ভরা সূর্য তারা-র অজানা রহস্যে বিভোর থেকেছে বিজ্ঞানী। যুগ যুগ ধরে। তবু দেখি, ‘খেয়া’ কাব্যগ্রন্থের ‘হারাধন’ শীর্ষক কবিতায় কবি লিখছেন, ‘জ্যোতির মালায় একটি তারা/ কোথায় গেছে টুটে!’ ‘হারা তারা কোথায় গেল’ তার সন্ধানে ব্যস্ত বিশ্বের তাবড় তাবড় বিজ্ঞানী।
অনন্ত এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের আপাতত সব চাইতে রহস্যময় বিষয় বোধকরি এই কৃষ্ণ-গহ্বর। স্থানের রয়েছে তিনটি মাত্রা (ডাইমেনশন), এবং সেই সঙ্গে কাল (সময়) মিলেমিশে যেন একটা পর্দার মতো। ভর আছে এমন যে কোনও বস্তুই একটা বক্রতা সৃষ্টি করে সেই পর্দায়। কোনও নক্ষত্রের ভর যখন হয় খুব বেশি, সেই বক্রতাটা যেন পরিণত হয় গহ্বরে। কৃষ্ণ-গহ্বরের আকার খুব ছোট হতে পারে, যেমন হয়তো বা একটা পরমাণুর মতো। আবার হতে পারে খুব বড়, যেমন সূর্যের লক্ষ লক্ষ গুণ। আকার অনুপাতে এর ভর খুবই বেশি। যেমন, পরমাণুর আকারের কৃষ্ণ-গহ্বরের ভর হয়তো হিমালয়ের সমান। আর এই প্রচণ্ড ভর বা ঘনত্বের ফলেই এর মহাকর্ষ খুব বেশি। এর আওতার মধ্যে আসা সব কিছুকেই নিজের মধ্যে টেনে নেয় কৃষ্ণ-গহ্বর। এই আওতার সীমারেখাকে বলে ‘ঘটনা-দিগন্ত’, ইংরেজিতে ‘ইভেন্ট হরাইজন’। স্থান-কাল সব দুমড়ে মিলিয়ে যায় সেখানে। এমনকী আলোরও নিস্তার নেই, সীমারেখার মধ্যে পেলে তাকেও টেনে নেয় কৃষ্ণ-গহ্বর। আলো বের হতে পারে না বলেই তো এ হল নিকষ কালো অন্ধকার। চলতি কথায় একেই বলে নক্ষত্রের মৃত্যু। তারার জ্বালানি ফুরিয়ে গেলে এটাই তার ভবিতব্য। তারার ভিতরের হাইড্রোজেন গ্যাস শেষ হলে থেমে যায় তার নিউক্লিয় বিক্রিয়া। তখনই সঙ্কুচিত হতে থাকে এর অভ্যন্তরীণ মূল বস্তু। আচ্ছা, কবির ভাষায় এটাই কী ‘হারা তারা’?
সেই কোন ১৭৯৬ সালে অঙ্কবিদ ল্যাপলাস বিপুল ভর-বিশিষ্ট আলোকে-গিলে খাওয়া অজগর অন্ধকারের অস্তিত্বের কথা বলেছিলেন। ১৮৮৩-তে একই কথা বলেন বিজ্ঞানী জন মাইকেল। আর, প্রায় একশো বছর আগে, ১৯১৬তে, আইনস্টাইন তাঁর ‘জেনারেল থিওরি অব রিলেটিভিটি’ দিয়ে ধারণা করেন কৃষ্ণ-গহ্বরের অস্তিত্বের। মার্কিন পদার্থ-বিজ্ঞানী জন হুইলার ১৯৬৯ সালে প্রথম এই ‘ব্ল্যাক হোল’ নাম দেন। দেখে-শুনে যতটুকু বোঝা গেছে, প্রতিটা বড় ছায়াপথের কেন্দ্রে রয়েছে একটা দৈত্যাকার কৃষ্ণ-গহ্বর। আমাদের ‘মিল্কিওয়ে’ বা ‘আকাশগঙ্গা’ ছায়াপথের কেন্দ্রেও রয়েছে এমনই এক দৈত্য, ‘স্যাগিটারিয়াস এ*’।
মহাকাশে একটা গোলকের মতো অঞ্চল নিয়ে অস্তিত্ব এই কৃষ্ণ-গহ্বরের। ঘটনা-দিগন্তের প্রান্তে রয়েছে ফোটন বলয়, যা আবর্তিত হয় কৃষ্ণ-গহ্বরের কেন্দ্রকে ঘিরে। আলো যেন পিছলে পিছলে যায় এর গা ঘেঁষে। আসলে মহাকাশ-সংক্রান্ত গবেষণা অনেকটাই অঙ্ক-নির্ভর যুক্তিসঙ্গত আন্দাজ। এর অনেক তত্ত্বই প্রমাণ বা অপ্রমাণ করা সময়-সাপেক্ষ, এবং প্রমাণটাও অনেকাংশে অনুমান-নির্ভর অঙ্ক। তাই মহাকাশ সংক্রান্ত অনেক তত্ত্বকেই আপাতভাবে কল্পবিজ্ঞানের গল্প বলেও মনে হতে পারে। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, কৃষ্ণ-গহ্বরের গভীরতম অংশে পদার্থবিদ্যার নিয়মগুলি আর কাজ করে না। এমন ধারণার কথাও শুনিয়েছেন বিজ্ঞানীরা যে, কৃষ্ণ-গহ্বর হল এক প্রবেশপথ, যার মধ্য দিয়ে চলে যাওয়া যায় মহাবিশ্বের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। একে বলা হয়েছে ‘ওয়ার্ম-হোল’ বা কীট-গহ্বর। কৃষ্ণ-গহ্বরের অন্তঃপুরে তৈরি হয়ে চলেছে বস্তু আর প্রতিবস্তু। এদের মধ্যে ঘটে সংঘর্ষ। যার নাম দেওয়া হয়েছে প্রয়াত কিংবদন্তি ব্রিটিশ বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং-এর নামে। এই সংঘর্ষের ফলশ্রুতিতে বস্তু আর প্রতিবস্তু কিন্তু একে অপরকে ধ্বংস করে দেবে একেবারে। রাখবে না কিছুই। একে বলে ‘কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশন’। এই সংঘাত যখন ঘটে ব্ল্যাক হোলের প্রান্তে, অর্থাৎ ঘটনা-দিগন্তের সীমানায়, কৃষ্ণ-গহ্বর শোষণ করে নেয় কিছু কণা, আর বাকিটা মুক্ত হয়ে পরিণত হয় বাস্তব কণায়। তাই ক্রমে ভর হারাতে থাকে কৃষ্ণ-গহ্বর। কোনও এক সময় মহাশূন্যে বিলীন হওয়াটাই তার ভবিতব্য। কিন্তু, বিশ্বস্রষ্টার মহান সৃষ্টি এই মহাবিশ্বে সত্যিই কিছু কি হারায়?
ক'দিন আগেই, এপ্রিলের ১০ তারিখ, গোটা পৃথিবীর সামনে উঠে এসেছে এম৮৭* নামক কৃষ্ণ-গহ্বরের ছবি। যা নিয়ে পৃথিবী জুড়ে মস্ত হইচই। পৃথিবী থেকে সাড়ে পাঁচ কোটি আলোকবর্ষ দূরে এর অস্তিত্ব। উপবৃত্তাকার ছায়াপথ মেসিয়ার৮৭-র কেন্দ্রে। যার আনুমানিক ভর আমাদের সূর্যের ভরের প্রায় সাতশো/সাড়ে সাতশো কোটি গুণ।
উজ্জ্বল কমলা রঙের ডোনাটের মতো দেখতে এই বলয় আসলে কৃষ্ণ-গহ্বরটির ঘটনা-দিগন্তের ছবি। এই অঞ্চলে প্রচুর পরিমাণে গ্যাস, মেঘ, প্লাজমা অশান্ত আবেগে ঘুরপাক খেয়ে বেড়াচ্ছে, বিকিরণ ঘটাচ্ছে এমনকী আলোরও। কৃষ্ণ-গহ্বরটির ব্যাস সূর্যের চারধারে নেপচুনের কক্ষপথের মোটামুটি দশগুণ। মাঝখানের কালো অংশটাই সেই রহস্যময় কৃষ্ণ-গহ্বর। যার ছবি এমনিতে পাবার কোনও উপায় নেই। আলোকে সে গিলে খায়। চারদিকের আলোর বলয়ের মধ্যেই তাই অন্ধকারের হিম-কুঞ্চিত অস্তিত্বকে অনুভব করা। উপলব্ধি করা অজগর অন্ধকারকে।
প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক যে, ব্ল্যাক হোল তো রয়েছে অনেক। তাহলে এর আগে অন্য কেউই বা এভাবে ছবি তুলতে পারেনি কেন? ধরা যাক এই এম৮৭* কৃষ্ণ-গহ্বরটির কথাই। এর ব্যাস ৪,০০০ কোটি কিলোমিটার, বা দেড় আলোকবর্ষ। চারপাশের বলয়টা মোটামুটি এরও ৪-৫ গুণ ছড়িয়ে আছে। আমাদের টেলিস্কোপে এর ছবি ঠিকঠাক তোলা অসম্ভব। যে ছবিটা তোলা হয়েছে তাতে দরকার একটা মস্ত টেলিস্কোপ, যার অ্যান্টেনা পৃথিবীর মত বড়। কিন্তু, সেটা তো আর বাস্তব নয়। পরিবর্তে তাই একটা চমৎকার উপায় বের করলেন বিজ্ঞানীরা। পৃথিবীর সব চাইতে বড় আর কার্যকরী আটটি টেলিস্কোপের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করে তাঁরা বানিয়ে ফেললেন যেন এক পৃথিবীর আকৃতির টেলিস্কোপ। এই আটটি টেলিস্কোপ একসাথে তথ্য সংগ্রহ করবে কৃষ্ণ-গহ্বর থেকে। বিপুল সেই তথ্য। ৪ পেটাবাইট। এমপি৩ ফরম্যাটে যদি নিরন্তর গান বাজানো হয়, একটানা ৮,০০০ বছর ধরে, তাহলে যতটা ডেটা থাকে, ততটা। এই সমস্ত তথ্যকে পাঠানো হয় বস্টনের মাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে। আর সেখানেই সেই বিপুল পরিমাণ তথ্যকে জুড়ে, এবং সুপার-কম্পিউটারের সাহায্যে এই তথ্যের এবং ছবির অনেক ফাঁকফোকর বুজিয়ে নতুন করে তৈরি হয় কৃষ্ণ-গহ্বরের ছবিটা। এর জন্য কম্পিউটারে প্রোগ্রাম লিখতে প্রধান ভূমিকা নিয়ে বিশ্বজোড়া খবরের শিরোনামে এসেছেন ২৯ বছরের কেটি বাউম্যান। ছবিটা দেখে বোঝা না গেলেও, টেলিস্কোপে পাওয়া তথ্যগুলি জুড়ে পাওয়া গেল যেন অত্যন্ত ভাঙাচোরা, থাম উপড়ে পড়া, দেওয়ালে ইট খুবলে নেওয়া, দরজা-জানালা-ছাদের হদিশ না থাকা এক পুরনো রাজবাড়ির ছবি। তাকে অনেক মেরামত করে, বেশ কিছু কল্পনার মশলা, ইঁট, সিমেন্ট, রং দিয়ে রংচঙে রূপ দেওয়া হয়েছে। তথ্য বিশ্লেষণ করে এই ছবি তৈরি করতে পৃথিবীর সব চাইতে দক্ষ সুপার-কম্পিউটারের লেগেছে দু’বছর।
২০১৪ সালের সায়েন্স ফিকশন ম্যুভি ‘ইন্টারস্টেলার’। ভিসুয়াল এফেক্টের জন্য ছবিটি অ্যাকাডেমি পুরস্কারও পায় ২০১৫তে। এর ঘটনার প্রেক্ষাপট ভবিষ্যৎ— একুশ শতকের মাঝামাঝি। শস্যে মড়ক এবং ধুলোঝড়ের প্রভাবে পৃথিবী তখন হয়ে পড়েছে বসবাসের অযোগ্য। শনিগ্রহের কাছে অবস্থিত একটি ওয়ার্মহোলের পথ ধরে যাওয়া যায় দূর এক ছায়াপথে, যেখানে গর্গানচুয়া নামে এক কৃষ্ণ-গহ্বরের কাছে রয়েছে এক ডজন বসবাস-যোগ্য গ্রহ। কীট-গহ্বরের পথ গলে বেরিয়ে পড়ে বারোজন, বারোটি গ্রহ সরেজমিনে দেখবার জন্যে। আশাপ্রদ তথ্য পাঠায় তিনজন। তাঁদের পাঠানো তথ্যের উপর নির্ভর করে প্রফেসর ব্র্যান্ড তৈরি করেন দুটি পরিকল্পনা। প্ল্যান ‘এ’, আর প্ল্যান ‘বি’। তারপর ওয়ার্মহোলের পথ বেয়ে ভিন ছায়াপথের অজানা গ্রহে পৌঁছানোর অভিযাত্রা চমকপ্রদ বললেও কম বলা হয়। সঙ্গে রয়েছে ডঃ রোমিলি নামে একটি চরিত্রের ব্ল্যাক হোলের অজানা তথ্য অনুসন্ধানের প্রয়াসও। মুভিটিতে দেখানো হয়েছে, প্রফেসর ব্র্যান্ডের প্ল্যান ‘এ’ বাস্তবায়িত করা যাবে না, কারণ তাতে প্রয়োজন ব্ল্যাক হোলের অভ্যন্তরের কিছু তথ্য, যা পাওয়া অসম্ভব। তাই এই মুভিটির কল্পনার সীমারেখাকে বাড়াতে বাড়াতেও কোথাও যেন বেঁধে দেওয়া হয়েছে। স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে কৃষ্ণ-গহ্বরের অজ্ঞাত অতলান্তিক রহস্যের কথা। যা বোধকরি কল্পবিজ্ঞানের সীমারও বাইরে।
ওয়ার্মহোল গলে অন্য ব্রহ্মাণ্ডে পাড়ি দেওয়াটা কল্পবিজ্ঞানের আওতাতেই থাকুক। আমরা কৃষ্ণ-গহ্বরের ছবিতেই উল্লসিত। আমাদের আকাশগঙ্গা ছায়াপথের কেন্দ্রে থাকা ‘স্যাগিটারিয়াস এ*’ কৃষ্ণ-গহ্বরের ছবিটাও হয়তো আমরা দেখতে পাব অদূর ভবিষ্যতে।