উপার্জন বেশ ভালো হলেও ব্যয়বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে সঞ্চয় তেমন একটা হবে না। শরীর খুব একটা ... বিশদ
ভারতীয় গণতন্ত্রে প্রতীকের ব্যবহার শুরু হয় একেবারে গোড়া থেকে। ১৯৫২ সালে প্রথম সাধারণ নির্বাচন যখন হয় তখনই ভাবা হয় প্রতীকের কথা। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ নিরক্ষর ভোটারের কথা মাথায় রেখে কিছু চিহ্ন ঠিক করা হয়েছিল। সেই তালিকায় সব্জি ‘ক্যাপসিকাম’ থেকে ‘এয়ার কন্ডিশনার’, ‘মই’ থেকে ‘চপ্পল’ অনেক কিছুই রয়েছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পাল্টেছে সেই প্রতীকের তালিকা। টাইপরাইটার, টেলিফোন, ক্যামেরার মতো পুরোনো কমন সিম্বলের পাশাপাশি ভ্যাকিউম ক্লিনার, এয়ার কন্ডিশনারের মতো সামগ্রী প্রতীক হিসেবে ঢুকে গিয়েছে। কৃষিপ্রধান ভারতে ভোটদান প্রথার গোড়ার দিকে প্রতীক ছিল ‘লাঙল কাঁধে চাষী’। বলদ দিয়ে জমি চাষ করার জন্য কখনও তা হয়েছে ‘দু’টি গোরু’। কখনও আবার ব্যালটে উঠে এসেছে ‘গোরুর গাড়ি’।
দেশের বর্তমান দুই প্রধান দল বিজেপি ও কংগ্রেসের ক্ষেত্রেও বিভিন্ন সময় প্রতীক বদলেছে তিনবার। আদি প্রতীক ‘জোড়া বলদ’ থেকে কংগ্রেসের প্রতীক হয়েছে ‘হাত’। আবার গোড়ায় ‘প্রদীপ’ প্রতীকের জনসংঘই বিজেপি হওয়ার পরে প্রতীক নিয়েছে ‘পদ্ম’। বিজেপির আদি দল শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের জনসংঘ ১৯৫১ থেকে ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত ভোটে লড়েছিল ‘প্রদীপ’ প্রতীক নিয়ে। ১৯৭৭ সালে যখন বেশ কিছু কংগ্রেস বিরোধী দলকে নিয়ে জনতা পার্টি গঠন হয় এবং জনসংঘ তাতে যোগ দেয় তখন প্রতীক হয়ে যায় ‘লাঙল কাঁধে কৃষক’। তিন বছর পরেই জনতা পার্টি ভেঙে যায়। জন্ম নেয় ভারতীয় জনতা পার্টি বা বিজেপি। তখন থেকেই প্রতীক ‘পদ্ম’।
অন্যদিকে, ১৯৫২ থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত কংগ্রেসের প্রতীক ছিল ‘জোড়া বলদ’। মাঠে লাঙল নিয়ে যাওয়া ‘জোড়া বলদ’ প্রতীক নিয়েই প্রথম চারটি লোকসভা নির্বাচনে লড়ে কংগ্রেস। ১৯৬৯ সালে ইন্দিরা গান্ধী দল ভেঙে গঠন করেন ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস (আর)। প্রতীক হয় ‘গাই-বাছুর’। তখন আদি কংগ্রেসের হাতেই থেকে যায় ‘জোড়া বলদ’ প্রতীক। এর পরে ১৯৭৭ সালে ইন্দিরা গান্ধী গঠন করেন কংগ্রেস (আই)। তখন থেকেই প্রতীক হয় ‘হাত’। এক সময় গ্রামে গ্রামে ছিল তীব্র জলসঙ্কট। ছিল না গভীর নলকূপ। ভরসা বলতে পুকুরের জল বা কুয়ো। তাই ‘কপিকল লাগানো কুয়োও’ কখনও হয়ে উঠেছে আমজনতার প্রতীক। পাল্টেছে সময়। তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ভেঙেছে দল। তৈরি হয়েছে নতুন পার্টি। আর সেই বদলানো সময়ের সঙ্গে দলের প্রতীক হয়েছে কখনও ট্যাক্সি, কখনও মোটরবাইক, কখনও আবার সাইকেল।
বর্তমান যুগ হল ‘এজ অব ডিজিটাল এরা’। প্রচার আর শুধু দেওয়াল লিখন, পোস্টার-হোর্ডিং-ব্যানারে সীমাবদ্ধ নেই। কাগজ-টিভির তথাকথিত মাধ্যম ছাড়িয়ে মতামত গঠনের প্রধান মাধ্যমে পরিণত হয়েছে সোশ্যাল মিডিয়া। আর সিংহভাগ ভোটের লড়াই যখন সোশ্যাল মিডিয়াজুড়ে, আমজনতা যখন ধরা দিচ্ছে ডিজিটাল ওয়ার্ল্ডে, তখন ভোটের প্রতীকই বা কেন কৃষক, লাঙল, কুড়ুল বা ঝাড়ুর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে! স্বাভাবিক নিয়মেই সেই প্রতীকের উপর প্রভাব ফেলেছে ডিজিটাল জমানা। নির্দল বা স্বীকৃতিহীন দলের জন্য প্রতীকের তালিকা প্রকাশ করেছে দেশের নির্বাচন কমিশন। ট্রাডিশনাল কান্ট্রির তকমা ঝেড়ে আরবান নেশন-এ রূপ নিয়েছে ভারত। তাই প্রতীকও হয়ে উঠেছে দেশবাসীর নিত্য জীবনযাত্রায় ব্যবহার্য সামগ্রী — সিসিটিভি থেকে কম্পিউটার মাউস, ল্যাপটপ থেকে পেন ড্রাইভ, মেবাইল চার্জার থেকে ব্রেড টোস্টার। এমনকী, একঝাঁক আনুষঙ্গিক উপকরণ বা অ্যাকসেসরিজ।
আগে যেখানে নির্দল প্রার্থীদের জন্য গোরুর গাড়ি, কুড়ুল, ঝাঁপি বা ঝুড়ি, মোমবাতি, গাজরের মতো ‘ফ্রি সিম্বল’ ছিল। সেখানে নির্বাচন কমিশন এবার ডিজিটাল জমানার সঙ্গে তাল মিলিয়ে পেনড্রাইভ, মাউস বা ল্যাপটপের মতো একগুচ্ছ প্রতীক প্রকাশ করেছে। সূচনা করেছে নয়া যুগের। লণ্ঠন, ঝাড়ু একদা যেখানে কমিশনের ফ্রি সিম্বল ছিল, সেখানে তা এখন আরজেডি এবং আম আদমি পার্টির নিজস্ব প্রতীকে পরিণত হয়েছে। রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে, এই পরিবর্তন হল আদতে ভারত থেকে ইন্ডিয়াতে রূপান্তর। একসময় যে পরিবর্তন শুরু হয়েছিল গোরুর গাড়ি বা সমতুল্য প্রতীকের হাত ধরে। তথ্য বলছে, প্রথম লোকসভা ভোটে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের ৯০ শতাংশই ছিল গ্রামীণ ভারত থেকে। আর আট বছর আগে ২০১১ সালে হওয়া সর্বশেষ আদম সুমারি অনুযায়ী দেশের মাত্র ৩৭ শতাংশ মানুষ বসবাস করেন শহর ও নগরে। পশ্চিমবঙ্গের ৩৩ শতাংশ মানুষ শহরে বসবাস করেন। গুজরাত ও মহারাষ্ট্রের ক্ষেত্রে সেই সংখ্যা প্রায় ৫০ শতাংশ। আর এই শহুরে জনসংখ্যার কাছে ল্যাপটপ, স্মার্টফোন একটা শক্তিশালী সোশ্যাল সিম্বল। এ বছরে সারাদেশের ৯০ কোটি ভোটারের মধ্যে ৩৭ কোটির বয়স ১৮-৩৫ বছরের মধ্যে। যাঁদের মধ্যে আবার দেড় কোটি প্রথমবারের ভোটার। প্রসঙ্গত, এবার ভোটার তালিকায় ২০ লক্ষ ৬০ হাজার নতুন ভোটারের নাম নথিভুক্ত হয়েছে পশ্চিমবঙ্গ থেকে। যা ভারতে সর্বোচ্চ। আর ইন্টারনেট যেহেতু শহর থেকে গ্রামকে গোটা বিশ্বের সঙ্গে একসুতোয় বেঁধে ফেলেছে, সেই ‘বিশ্বজাল’কে ভর করেই ডিজিটাল সরঞ্জামের রমরমা; সেখানে নির্বাচনী প্রতীকেও যে তা প্রতিফলিত হবে সেটাই স্বাভাবিক। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এটা হচ্ছে নতুন যুগের ভারত। কমিশনের সময়োপযোগী প্রতীকের মাধ্যমে দেশের তরুণ প্রজন্মকে নিজেদের পালে টানতে সুবিধা হবে রাজনৈতিক নেতাদের। যেখানে দেশের একটা বড় অংশ তরুণ প্রজন্ম। এছাড়া এই অভিনব প্রতীক মতামত গড়তেও বড় ভূমিকা নেবে।
মার্কেটিং বা কমিউনিকেশন বলে, কোনও সংস্থার ‘লোগো’র মতো নির্বাচনী প্রতীকও আসলে সংশ্লিষ্ট দল বা পার্টি সুপ্রিমোর ‘ব্রান্ড ভ্যালু’ গড়তে কাজ করে। আন্না হাজারের সঙ্গে দুর্নীতিবিরোধী অভিযানে নেমে যখন আম আদমি পার্টি প্রতিষ্ঠা করেন অরবিন্দ কেজরিওয়াল, তখন তিনি প্রতীক হিসেবে ঝাড়ু বাছেন। প্রচারে ঝড় তোলেন, এর মাধ্যমেই দেশ থেকে দুর্নীতি ঝেঁটিয়ে বিদায় করা হবে। আর ‘স্বচ্ছ ভারত’ অভিযানে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যখন হাতে সেই ঝাড়ু ধরলেন, তখন অনেকে মনে করেন, দুর্নীতিবিরোধী ভারত গড়তে ঝাঁটাই উপযুক্ত প্রতীক।
আবার দলের সেই প্রতীককে কেন্দ্র করেই তৈরি হয় নির্বাচনী স্লোগান। আর আজকের সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে দলের কর্মী-সমর্থকেরা সেই প্রতীক নিয়ে সেলফি তুলে পোস্ট করেন। যাতে সম্ভাব্য ভোটারদের কাছে টানা যায়। দলে ভাঙনের পর প্রতীক নিয়ে আইনি লড়াইয়েরও নজির রয়েছে নির্বাচনী ইতিহাসে। সেই তালিকায় রয়েছে জনতা পার্টি, জনতা (এস), চরণ সিংয়ের ভারতীয় লোকদল, কংগ্রেস এবং কংগ্রেস (আই)। বা সাইকেল প্রতীক নিয়ে সাম্প্রতিক কালের বাবা-ছেলে মুলায়ম-অখিলেশের লড়াই।