উপার্জন বেশ ভালো হলেও ব্যয়বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে সঞ্চয় তেমন একটা হবে না। শরীর খুব একটা ... বিশদ
১৯৪৭ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিন বছরের মধ্যেই ভাবনাটা তৈরি হয়েছিল যে, গণতন্ত্রের নিয়মানুযায়ী নির্বাচন পরিচালনার জন্য একটি স্বয়ংশাসিত সংস্থা গঠন করা প্রয়োজন। ২১ মার্চ ১৯৫০ সালে গঠিত হল নির্বাচন কমিশন। গর্বের বিষয়, প্রথম নির্বাচন কমিশনার ছিলেন একজন বাঙালি। সুকুমার সেন। তিনিই ভারতে প্রথম নির্বাচন পরিচালনা করেছিলেন। ভারতে নির্বাচন তথা ভোটগ্রহণ প্রথম শুরু হয়েছিল ২৫ অক্টোবর ১৯৫১ সালে। আর শেষ হয়েছিল ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ সালে। চার মাস ধরে চলেছিল ভোটগ্রহণ পর্ব। কারণটা ছিল সরকারি লোকের অপ্রতুলতা। দেশ তখন সবে তৈরি হচ্ছে। স্বাধীন ভারতের প্রথম ভোট। লোকসভা আর বিধানসভা একসঙ্গে ভোট হয়েছিল দেশজুড়ে। দেশের মানুষ প্রথম নিজেরা নির্বাচন করছে তাদের শাসন ক্ষমতায় কারা বসবে। বিষয়টা যতখানি না রাজনৈতিক তার চেয়ে বেশি ছিল সাধারণ মানুষের আবেগ। মজার বিষয় ছিল, ভোটগ্রহণ করার জন্য এক একটি ভোটকর্মীর দল বুথে বুথে ঘুরে ঘুরে ভোটের আয়োজন করত। এক একটি দল, দশ দিন থেকে এক মাস পর্যন্ত এক বুথ থেকে অন্য বুথে গিয়ে গিয়ে ভোট নিয়েছে। প্রায় ৩৬ কোটি ভারতবাসীর মধ্যে সেই প্রথম ভোটাধিকার প্রয়োগ করে ১৭.৩২ কোটি ভোটার। স্বাধীন দেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি রাজেন্দ্র প্রসাদের সেই উচ্চারণ: আমাদের কৃষকরা চাষের কাজে যে বুদ্ধি প্রয়োগ করে, তা আমাদের বিস্মিত করে, সুতরাং এই দরিদ্র ভারতবাসী সঠিকভাবেই ভোটদান করতে পারবে, এই বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু কমিশন সতর্ক। ভোট দিতে গিয়ে যদি গণ্ডগোল করে ফেলে, সেই আশঙ্কায় এক একজন প্রার্থীর জন্য এক একটি ব্যালট বাক্স ছিল। ব্যালট বাক্সের গায়ে লাগানো থাকত নির্দিষ্ট দলের প্রতীক। বাক্সগুলিও নির্দিষ্ট রঙে রাঙানো থাকত। না, তখনও পর্যন্ত আঙুলের ডগায় বেগুনি কালি লাগাবার ব্যবস্থা ছিল না। ১৯৫৭ সালের ভোটেই দেখা গেল ভোটের কারচুপি। একই ভোটার অন্য অন্য নামে একাধিক ভোট দিচ্ছে। কারচুপি রুখতে তৃতীয় লোকসভা নির্বাচনে অর্থাৎ ১৯৬২ সালে প্রথম ব্যবহার হল বেগুনি কালির চিহ্ন, তর্জনীতে। বিজ্ঞানী ডঃ এম এল গোয়েল দিল্লির ন্যাশনাল ফিজিকাল ল্যাবরেটরির গবেষণাগারে আবিষ্কার করলেন এক অদ্ভুত ধরনের রাসায়নিক কালি যা রৌদ্রের অতি বেগুনি রশ্মির সংস্পর্শে এলে চামড়ায় দীর্ঘস্থায়ী দাগ রেখে দেয়। সেই কালির দাগ আঙুলে নিয়ে হাসি হাসি গ্রামীণ ভারতবাসীর ছবি আজও উজ্জ্বল সরকারি প্রচারে। ওই টুকুতেই যেন আটকে গেল নির্বাচন কমিশনের কাজ। ভারতের সাধারণ নাগরিকদের কাছে নির্বাচন কমিশনের অস্তিত্ব ছিল অনেকটা কাগজের বাঘের মতো।
হঠাৎ নব্বইয়ের দশকের গোড়ায় কাগজের শিরোনামে একটি নাম। তিরুনেল্লাই নারায়ন আইয়ার সেশন। সংক্ষেপে টি এন সেশন। চেয়ারে বসেই তিনি দেশকে প্রথমেই জানালেন নির্বাচন আচরণবিধি। নতুন কিছু যে করলেন তা নয়! কিন্তু তার প্রয়োগের বিষয়টি নিয়ে মানুষকে সচেতন করা ও মিডিয়ার মাধ্যমে সর্বজনের গোচরে আনার প্রাথমিক কাজটাই করলেন সেশন। রাজনৈতিক দলগুলিকে বোঝালেন কড়াভাবেই। আর জনগণের উদ্দেশে প্রচার করলেন: ভোট কোনও উৎসব নয়, আপনার গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত জানাবার পদ্ধতি। অফিসে তাঁর মন্ত্র ছিল, ‘Zero delay, zero deficiency’ । ১৯৫৫ সালের আইএএসের ব্যাচ। বইপ্রিয়, সত্যনিষ্ঠ মানুষটি ভালোবাসতেন জ্যোতিষশাস্ত্র। চর্চাও করতেন। জ্যোতিষীর কথার বিরুদ্ধে গিয়েই দশ মিনিটের আলাপে বিয়ে করেছিলেন জয়ালক্ষ্মীকে, ১৯৫৮ সালে। জয়ালক্ষ্মী তাঁর জীবনের শেষ সময়ে দেওয়া সাক্ষাতকারে তাঁর ষাট বছরের সঙ্গী সেশন সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘সত্যের খাতিরে উনি স্ত্রীকেও ত্যাগ করতে পারেন’। এটা যে কতখানি সত্য তা টি এন সেশনের চাকরি জীবনের দিকে তাকালেই বোঝা যাবে। একরোখা, টানটান, স্পষ্টবাদী মানুষটিকে সাধারণ মানুষ যত বেশি পছন্দ করেছে, তত বেশি অপছন্দ করেছে দেশের রাজনৈতিক নেতা-মন্ত্রীরা। সামলেছেন নানা দায়িত্ব, নানা সময়েই। তিনি তখন মাদ্রাজের পরিবহণ দপ্তরের ডিরেক্টর। বাসের ইঞ্জিন সারানো, খুলে ফেলা ও লাগানো শিখেছিলেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা বাস গুমটিতে, দিনের পর দিন কাটিয়ে। এমনকী, মাঝরাস্তা থেকে বাসে উঠে ড্রাইভারকে পাশে সরিয়ে দিয়ে ৮০ কিমি রাস্তা বাস চালালেন। সমস্যার ভেতরে প্রবেশ করে উৎপাটন করতে চাইতেন। দেশের প্রশাসনিক সর্বোচ্চ পদ, ক্যাবিনেট সচিব হয়েছিলেন। সততা, সাহস ও দক্ষতার সঙ্গে সামলানোর পর যোজনা কমিশনের সদস্য ছিলেন বেশ কিছুদিন। ১৯৯০ সালে চন্দ্রশেখর তখন প্রধানমন্ত্রী (সাত মাসের জন্য)। তিনি টি এন সেশনকে এই দায়িত্বে বসালেন। চিফ ইলেকশন কমিশনার অব ইন্ডিয়া। তখন সুব্রহ্ম্যণম স্বামী ছিলেন আইনমন্ত্রী। সুব্রহ্ম্যণম স্বামী যখন হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটিতে পড়াচ্ছেন সেই সময় প্রশাসনিক কোর্স করতে গিয়েছিলেন টি এন সেশন। জহুরির চোখ সুব্রহ্ম্যণমের। তাঁর চোখ ভুল করেনি। তিনি প্রধানমন্ত্রী চন্দ্রশেখরকে টি এন সেশনের নাম প্রস্তাব করেন।
তার আগে সাধারণ মানুষ ভুলেই গিয়েছিল এই কেন্দ্রীয় স্বয়ংশাসিত সংস্থাটির অস্তিত্ব ও গুরুত্ব। একটি স্বয়ংশাসিত সংস্থা তার নিয়মের মধ্যে থেকেও কতখানি কার্যকরী হতে পারে তা দেখালেন শুধু নয়, সংস্থায় প্রাণ প্রতিষ্ঠা করলেন। তখন সংবাদের শিরোনামে রোজ তাঁর নাম। তাঁর সরাসরি কথা বলার সাহস, বাকপটুতা, ক্ষুরধার ব্যঙ্গ তখন ট্রামে-বাসে-ট্রেনের আলোচনার বিষয়। রাজনৈতিক দলগুলি ক্রমশই খাপ্পা তাঁর আচরণে। আর সেশনের সেই মহান উক্তি, ‘আমি একটি ফুটবলের মতো। যত জোরে লাথি মারবে তত জোরে ঠিকরে আসব’। তাইই ঘটেছিল বাস্তবে। তিনি এবং তাঁর অফিসাররা গোটা দেশের জেলায় জেলায় প্রশাসনিক সভা করলেন। প্রশাসনের যেসব আধিকারিকরা নির্বাচন প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত থাকেন তাঁদের বোঝালেন স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা। তিনিই প্রথম হাত দিলেন রাজনৈতিক দলের নির্বাচনে খরচ বেঁধে দেওয়ার প্রয়োগবিধি। সে ক্ষেত্রেও সংবাদ শিরোনামে ছিল তাঁর সেই অসামান্য উক্তি: ‘তু চিজ বড়ি হ্যায় ভ্রষ্ট্ ভ্রষ্ট্’। চটুল হিন্দি সিনেমার গান থেকে সংলাপ উঠে আসত তাঁর কথায়। আর রেভিনিউ সার্ভিসের দক্ষ অফিসারদের নিয়োগ করলেন দেশব্যাপী। রাজনৈতিক দলের প্রতিটি প্রার্থী তাঁর নির্বাচনী কেন্দ্রে খরচ করার সীমা বেঁধে দেওয়াই শুধু নয়, সেই খরচের সরকারি হিসেব রাখা এবং রাখলেন পুঙ্খানুপুঙ্খ নজরদারি। নির্বাচনের সময় নানারকম টাকা-মদ-উপহার বিলি, যথেচ্ছ গাড়ির ব্যবহার আর মুড়ি-মুরকির মতো টাকা ওড়াবার প্রথা ছিল দেশের প্রায় সব গ্রাম ও অনুন্নত অঞ্চলগুলিতে। কড়া পর্যবেক্ষণ আর কড়া শাস্তির দাওয়াই চালু হল। তিনিই প্রথম চালু করলেন ভিডিওগ্রাফি করে রাখার পদ্বতি। সমস্ত মিটিং, উত্তেজনাপ্রবণ বুথে ভোট গ্রহণ এবং নির্বাচনের সমস্ত ধাপগুলি ভিডিওগ্রাফ করে সংগ্রহে রাখার প্রচলন শুরু করলেন। ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল রাজনৈতিক দলগুলি। মডেল কোড অব কন্ডাক্টে লিখিত প্রতিটি আদেশনামা প্রয়োগ করলেন দেশের কোণে কোণে।
১৯৯৩ সালের লোকসভা নির্বাচনে ১,৪৮৮ জন নির্বাচনের প্রার্থীর নাম বাতিল করা হল শুধু নয়, খরচের তথ্য না দেওয়ার জন্য শাস্তিস্বরূপ তিন বছর তাঁরা কোনও নির্বাচনে দাঁড়াতে পারবেন না বলে ঘোষণা করা হল। সেশন নিজে ৪০,০০০টি কেস পর্যবেক্ষণ করলেন। তার থেকে ১,৪০০ প্রার্থীর ভোটে অংশগ্রহণ বাতিল করেছিলেন। রাজনৈতিক দলগুলির ভ্রষ্টাচারের বিরুদ্ধে খড়্গহস্ত ছিলেন তিনি। সেই সময় রাজনৈতিক দলগুলি নতুন নতুন আদেশনামায় জেরবার। তার পিছনে সদা জাগ্রত জেনারেল অবজার্ভার ও হিসেব দেখার অবজার্ভার। সেশনের কড়া কড়া নির্দেশানামায় প্রশাসন তটস্থ। দাবি উঠেছিল তাঁকে সরিয়ে দেওয়ার। রাজনৈতিক দলগুলি তখন তাঁর নাম দিয়েছিল, আল-সেশন (অ্যালসেশিয়ান কুকুরের অপভ্রংশ)। টি এন সেশন স্বভাবসুলভ মজা করে এক ইন্টারভিউতে বললেন, ‘আমি একটিও কমা, কোলন, সেমি-কোলন বা ফুলস্টপ যোগ করিনি কোনও আইনে। আমি শুধুমাত্র আইনে যা আছে তার প্রয়োগ করেছি মাত্র’। আসলে ‘অবজার্ভার’ বিষয়টিকেই গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছিলেন সেশনই। নির্বাচনের সময় রাজ্যের প্রশাসন এবং রাজনৈতিক দল ব্যতিব্যস্ত ‘অবজার্ভার’ শব্দেই। দেশজুড়ে রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে ‘সেশন’ নামেই ‘সেনসেশন’ শুরু হল। শুরু হল বিষোদ্গার। ‘ডিক্টেটর সেশন’ থেকে শুরু করে ‘পাগল’, ‘পাগলা কুকুর’ নানা অপবাদ তাঁর জুটেছিল। কিন্তু তিনি অনড়। সৎ, স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষতা তাঁর মন্ত্র। রাজনৈতিক নেতারা, বিশেষত পার্লামেন্টের নির্বাচিত সদস্যরা তাঁকে দু’বার সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন ১৯৯৩ সালে। কিন্তু ব্যর্থ হয়েছে তাঁদের সেই চেষ্টা। তাঁর ক্ষমতা খর্ব করার জন্য সংবিধান সংশোধন করে তিনজন নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের নিয়ম করা হল। সে সংশোধনীতে, নির্বাচন কমিশনের যে কোনও সিদ্ধান্ত কমপক্ষে দু’জনের সহমতে গ্রহণ করার কথা বলা হল। তাঁর সহযোগী দু’জনকে নিয়োগ করা হল। তাঁরা হলেন এম এস গিল এবং সি কৃষ্ণমূর্তি। সেশন সুপ্রিম কোর্টে আপিল করলেন। জিতলেন। এম এস গিল এবং কৃষ্ণমূর্তি তাঁকে সাহায্য করবে, কিন্তু একক সিদ্ধান্ত নেবে নির্বাচন কমিশনার। এই মর্মে রায় দিল সর্বোচ্চ আদালত। সেশন ফিরে এলেন প্রবল বিক্রমে। দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনৈতিক নেতাদের বিরুদ্ধে অবাধ এবং নিরপেক্ষ নির্বাচন পরিচালনা করার লক্ষ্যে। যত জোরে ‘কিক’ করা হল, প্রবল বিক্রমে ‘বাউন্স ব্যাক’ করলেন তত জোরেই।
ভোটার আইডি কার্ড। ভারতের নির্বাচন ইতিহাসে একটি মাইল-ফলক। ভোটার সুরক্ষার নব বিধান। নির্বাচন কমিশনারের সর্বোচ্চ পদে আসীন হওয়ার পরেই যে বিষয়গুলি চিহ্নিত করেছিলেন সেশন, তারমধ্যে অন্যতম ছিল নির্ভুল ভোটার তালিকা প্রকাশ এবং ভোটারদের নির্দ্দিষ্ট পরিচয়পত্র তৈরি করা। তার সঙ্গে ছিল নির্বাচন কেন্দ্র পুনর্গঠন (Delimitation) এবং ভোটার তালিকা ঝাড়াই-বাছাই। বাধাদান ও আপত্তি এসেছিল সব রাজনৈতিক স্তর থেকেই। প্রশ্ন তোলা হয়েছিল এই গরিব দেশে এই কাজে অনর্থক অর্থ অপচয় করছেন সেশন। আর এই অর্থ অপচয়ের অপবাদকে অগ্রাধিকার দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল সবকটি দল। যখন সেশন ঘোষণা করলেন, ভারতের সকল ভোটারদের জন্য ছবিসহ ভোটার পরিচয়পত্র তৈরি করতে হবে সরকারকে। আর তা হবে নির্বাচন কমিশনারের তত্ত্বাবধানে। ১৯৯৩ সালের মাঝামাঝি সময়ের এই ঘোষণা জানানো হল কেন্দ্রীয় সরকারকে। আঠারো মাস কেটে গেল সরকার ভোটার পরিচয়পত্র নিয়ে কোনও আইন প্রণয়ন করল না। সরকারের কোনও গরজ লক্ষ্য করলেন না সেশন। কোনও রাজনৈতিক দলেরও কোনও গরজ দেখা গেল না। অবশেষে সেশনের ঘোষণা, ‘…if voter identity cards were not issued, no election would be held after January 1, 1995.’ তাই করলেন তিনি। দেশের নানা প্রান্তে বিধানসভা ও লোকসভার উপনির্বাচনগুলি আটকে রইল। সেশন অনড়। শেষ পর্যন্ত আবার সুপ্রিম কোর্টে গেল বিষয়টি। নির্বাচন বন্ধ রাখা যায় না। সুপ্রিম কোর্ট রায় দিল সেশনের EPIC বা Electoral Photo Identity Card-এর পক্ষে। দেশজুড়ে শুরু হল ভোটার আইডি কার্ড তৈরির ধুম। বুথে বুথে লাইন। ছবি উঠছে একের পর এক ভোটারদের। কর্মযজ্ঞ। ভোটার কার্ড। ১৯৯৬ সালে সেশনের মেয়াদ উত্তীর্ণের আগেই ভারতের প্রায় দু’কোটি ভোটারের ভোটার কার্ডের কাজ শেষ করেছিলেন সেশন। তারপর তো ইতিহাস। আধার কার্ড আসার আগে ভোটার কার্ড ছিল অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নাগরিকত্বের প্রমাণ। এখনও সমান গুরুত্বপূর্ণ।
সাধারণ মানুষের কাছে টি এন সেশন অত্যন্ত জনপ্রিয় এক মানুষের নাম, কিন্তু রাজনীতির মানুষদের কাছে তাঁর জনপ্রিয়তা কতটা তলানিতে ঠেকেছিল তার প্রমাণ পেলেন সেশন নিজেই। ১৯৯৭ সাল। দেশের দশম রাষ্ট্রপতি নির্বাচন। কংগ্রেসের প্রার্থী, কে আর নারায়ণন আর নির্দল প্রার্থী হিসেবে দাঁড়ালেন টি এন সেশন। চাকরি তাঁর শেষ। স্বপ্ন তাঁর, দেশকে তৈরি করবেন। আবার শুরু করলেন ঘুরে বেড়ানো একা। একক সৈনিক। যে বাড়িতে একসময় সাংবাদিকরা ভিড় করে থাকত, সেশন নিজে হাতে পরিবেশন করতেন ইডলি-ধোসা আর বাটার মিল্ক, সেই বাড়ি থেকে সরে গিয়েছে সংবাদমাধ্যমের নজর। একা সেশন প্রত্যেক রাজ্যের প্রত্যেক রাজনৈতিক দলের কাছে গিয়েছিলেন। প্রত্যেকের কাছে তিনি চেয়েছিলেন আশীর্বাদ, শুভেচ্ছা ও সমর্থন। রাষ্ট্রপতি হিসেবে তিনি দেশকে দূর্নীতি মুক্ত করার স্বপ্ন দেখেছিলেন। কোনও রাজনৈতিক দল তাঁকে সমর্থন করেনি। কোনও নেতার সমর্থন পাননি তিনি। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ১১তম রাষ্ট্রপতি হিসাবে নির্বাচিত হলেন কে আর নারায়ণন। মোট ভোটার ছিল ৪,৮৪৮ জন। কে আর নারায়ণন পেয়েছিলেন ৪,২৩১টি ভোট আর সেশন পেয়েছিলেন মাত্র ২৪০টি ভোট। পশ্চিমবঙ্গে ২৯৪টি ভোটের মধ্যে নারায়ণন পেয়েছিলেন ২৭২ জনের সমর্থন আর সেশন পেয়েছিলেন ৫ জনের ভোট। বোঝাই যায় সরকার বা বিরোধী, সকল রাজনীতির কারবারিদের কাছে কতটা অপ্রিয় ছিলেন তিনি। সবাই বক্তৃতার মঞ্চে শান্তিপূর্ণ ও অবাধ নির্বাচনের দাবি করে বটে, কিন্তু কোনও দল কি চায় অবাধ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন হোক?
তাই তো গোটা দেশে আজও চলতেই থাকে চাপান-উতোরের রাজনীতি। চলতেই থাকে মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগ করার স্বাধীনতাকে হরণ করার তাল-বেতাল রাজনীতি। এক অদ্ভুত লুকোচুরি খেলা চলে নির্বাচন কমিশান ও রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে। নিত্যনতুন প্রদ্ধতির উদ্ভাবন কি এই সমস্যার সমাধান আনতে পারবে? নাকি এই সর্ববৃহৎ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে স্বয়ংশাসিত সংস্থা আসলে প্রকারান্তরে থেকে যাবে শাসকের শাসিত সংস্থা হিসেবে? প্রশ্নগুলো সহজ। উত্তরের অপেক্ষায় প্রায় নব্বই কোটি ভোটার। যাঁরা বুথে বুথে রোদ-জল-ধোঁয়া-বারুদ-রক্তচোখ উপেক্ষা করে দাঁড়াবেন নিজের ভোট নিজে দিতে। তর্জনীর নখের উপর দিয়ে বেগুনি রেখায় ঝরে পড়বে তাদের ঝকঝকে হাসি। কোটি, অযুত, নিযুত সরল উজ্জ্বল চোখ তাকিয়ে আছে অবাধ, নিরপেক্ষ, ও শান্তিপূর্ণ ১৭ তম লোকসভা ভোটের দিকে।