উপার্জন বেশ ভালো হলেও ব্যয়বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে সঞ্চয় তেমন একটা হবে না। শরীর খুব একটা ... বিশদ
উরি: দ্য সার্জিকাল স্ট্রাইক। ২০১৬-র ১৮ সেপ্টেম্বর জম্মু-কাশ্মীরের উরির সেনা ক্যাম্পে হামলা চালিয়েছিল পাক জঙ্গিরা। ১৯ জন সেনা নিহত হয়েছিল সে দিনের হামলায়। এর বদলা নিতে পাকিস্তানে ঢুকে সার্জিক্যাল স্ট্রাইক চালায় ভারতীয় সেনা। সেই অপারেশনে বহু জঙ্গিঘাঁটি এবং বেশ কয়েক জন জঙ্গিকে খতম করা হয় বলে সেনা সূত্রে জানানো হয়েছিল। আর এই সার্জিকাল স্ট্রাইকের ঘটনাটা হয়েছে নরেন্দ্র মোদির জমানাতেই। যে সার্জিকাল স্ট্রাইক নিয়ে গর্ববোধ করেন খোদ মোদি। একটা ঘটনা, যা গোটা দেশবাসীর মনোবল বাড়িয়ে দিয়েছিল। মনে হয়েছিল, আমরাও পারি। বসে বসে মার না খেয়ে পাল্টা দিতে। আদিত্য ধরের ‘উরি’ সেই গল্পটাই বলতে চেয়েছিল। অনেকটাই হলিউডি স্টাইলে। কিন্তু এত সাফল্যের পরও অভিযোগ তাড়া করে চলেছে গোটা সিনেমাটিকে। ভোটের আগে এ দেশে জাতীয়তাবাদ উস্কে দিতে যেমন সার্জিকাল স্ট্রাইক নিয়ে ছবি তৈরির অভিযোগ, আমেরিকাতেও তেমনই ভিয়েতনাম যুদ্ধের পরে মার্কিনদের মনোবল চাঙ্গা করতে ‘র্যাম্বো’ সিরিজ তৈরি হয়েছিল। অভিযোগ একটাই, ভারতীয় সেনাবাহিনীর কৃতিত্বকে একটি সরকারি প্রোপাগান্ডা হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে।
একই অভিযোগে বিদ্ধ ‘দি অ্যাক্সিডেন্টাল প্রাইম মিনিস্টার’। একই দিনে দু’টি ছবি মুক্তি পেয়েছিল। ‘দি অ্যাক্সিডেন্টাল প্রাইম মিনিস্টার’ এবং ‘উরি: দ্য সার্জিকাল স্ট্রাইক’। বিজেপি নেতারা দিল্লিতে দু’টি সিনেমার জন্যই ‘প্রচার’ চালাচ্ছিলেন। পরিচিতদের সঙ্গে দেখা হলে দু’টি ছবি দেখারই অনুরোধ করেছিলেন। লোকসভা নির্বাচনের আগে তাদের প্রচারের বাজিই ছিল এই দুই ছবি। যদিও প্রথম দিনের ব্যবসার নিরিখে ফেল করেছিল ‘দি অ্যাক্সিডেন্টাল প্রাইম মিনিস্টার’। অনুপম খের অভিনীত ছবিটিকে ব্যবহার করে কংগ্রেসের পরিবারতন্ত্রকে ফালাফালা করতে চেয়েছিল বিজেপি। ছবির ট্রেলারে দেখানো হয়েছিল, মনমোহন সিংকে সোনিয়া গান্ধী বলছেন, এত দুর্নীতির মধ্যে রাহুল কী ভাবে দায়িত্ব নেবে? আবার রাহুল কুর্সিতে বসার আগে পাকিস্তানের সঙ্গে শান্তি-প্রক্রিয়াতেও বাধা দিচ্ছেন তিনি। কিন্তু নরেন্দ্র মোদির দলের অনেক নেতাই মনে করছেন, ছবিটি আদ্যন্ত নিরাশাজনক। মনমোহনের চরিত্রকেই সেখানে বড় করে দেখানো হয়েছে। তাতে বিজেপির আখেরে লাভ কিছু হয়নি। শেষ পর্যন্ত ‘উরি’-তেই কিছুটা মুখরক্ষা হয়েছিল বিজেপির। একটা ছবিতে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মনমোহন সিংকে সোনিয়া গান্ধীর হাতের পুতুল হিসেবে তুলে ধরা। অন্যটিতে সেনার ‘সার্জিকাল স্ট্রাইক’-এর মাধ্যমে মোদি সরকারের সাফল্য প্রচার করে জাতীয়তাবাদ উস্কে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে বলে বিরোধীদের অভিযোগ। ইন্দিরা গান্ধীর জরুরি অবস্থা জারির সময়কে কেন্দ্র করে গত বছর মধুর ভান্ডারকর তৈরি করেছিলেন ‘ইন্দু সরকার’। তখনও অভিযোগ উঠেছিল, এসব গান্ধী পরিবারকে বিপাকে ফেলতে বিজেপির কৌশল। মধুর ভান্ডারকরের যুক্তি ছিল, গণতন্ত্রে এটা ঠিক নয়। মত প্রকাশের স্বাধীনতা থাকা উচিত।
সিনেমায় রাজনীতি নতুন কিছু নয়। আমেরিকায় ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারি নিয়ে একের পর এক ছবির পিছনেও নাকি বিরোধীদের মদত ছিল। কিন্তু রাজনীতিতে সিনেমা ভারতের একশ বছরের চলচ্চিত্রের ইতিহাসে এই প্রথম। দোরগোড়ায় লোকসভা ভোট। সব রাজনৈতিক দল নিজেদের প্রচার তুঙ্গে নিয়ে গিয়েছে। দেশের শাসক দল বিজেপি সর্বদাই হাইটেক প্রচারে বিশ্বাসী। এবার তারা বলিউডকেই প্রচারের অংশ হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করেছে। ট্রেন্ডটা গত বছর থেকেই শুরু হয়েছিল। পরপর বেশ কয়েকটি এমন সিনেমা মুক্তি পেল বা পেতে চলেছে, যার প্রধান বিষয় হল শাসক দলের গুনগান, সরকারি প্রচার বা বিরোধীদের ভূমিকার সমালোচনা। উরি, দ্য অ্যাক্সিডেন্টাল প্রাইম মিনিস্টার, থ্যাকারে বা পি এম নরেন্দ্র মোদি। এই সব ক’টি নামের সঙ্গে পরোক্ষে নয়, প্রত্যক্ষে জড়িয়ে বিজেপির নাম। সরাসরি রাজনৈতিক না হলেও নরেন্দ্র মোদির স্বপ্নের ‘স্বচ্ছ ভারত প্রকল্প’-র প্রচার দেখা গিয়েছিল ‘টয়লেট-এক প্রেম কথা’য়।
তবে বিজেপি রূপালী পর্দায় শেষ কামড়টা মারতে চলেছে লোকসভা ভোটের প্রথম দফা শুরুর এক সপ্তাহ আগে। ভোট-মরসুমে দেশের একাধিক ভাষায় মুক্তি পাবে ‘পি এম নরেন্দ্র মোদি’। নাম থেকেই স্পষ্ট প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির জীবনী নিয়ে তৈরি বিজেপির প্রোপাগান্ডামূলক সিনেমা। নির্বাচনী আচরণবিধি চালু হয়ে যাওয়ার পর কীভাবে এইরকম ছবি মুক্তি পেতে পারে, প্রশ্ন তুলেছে বিরোধীরা। নির্বাচন কমিশনও বিরোধীদের প্রশ্নকে গুরুত্ব দিয়ে ভাবনাচিন্তা শুরু করেছে। কিন্তু আইনের বাধা আছে। সেন্সর বোর্ডের ছাড়পত্র পাওয়া কোনও সিনেমার প্রদর্শন বন্ধ করা যায় না।
লোকসভা ভোট চলাকালীনই মুক্তি পাবে ‘দ্য তাসখন্দ ফাইলস’। তাসখন্দে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রীর রহস্যজনক মৃত্যু নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে এই সিনেমা। স্বাভাবিকভাবেই তৎকালীন কংগ্রেস নেতাদের ভূমিকাও আতসকাচের তলায় ফেলা হবে। ইতিমধ্যে মুক্তি পেয়েছে ‘দ্য তাসখন্দ ফাইলস’-এর ট্রেলার, যেখানে পরতে পরতে রহস্যের হাতছানি। ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রীর মৃত্যু রহস্যকে ঘিরেই তৈরি হয়েছে ‘দ্য তাসখন্দ ফাইলস’-এর প্লট। ১৯৬৬ সালের ১০ জানুয়ারি। লালবাহাদুর শাস্ত্রী সই করেন ‘তাসখন্দ’ চুক্তি। আর এই সই করার ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই রহস্যজনকভাবে মৃত্যু হয় দেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীর। যেই মৃত্যুরহস্য আজও জানা যায়নি। কী ছিল সেই মৃত্যু কারণ? বিষক্রিয়ায় মৃত্যু ঘটেছিল তাঁর না হার্ট অ্যাটাকে? না এর নেপথ্যে রয়েছে অন্য কোনও রাজনৈতিক চক্রান্ত? এসব প্রশ্নের উত্তর আজও মেলেনি। তাঁর পরিবার তথা গোটা দেশের কাছে গোপন করা হয় লালবাহাদুর শাস্ত্রীর মৃত্যুরহস্য। কেন এবং কীভাবে? এই রহস্যের উন্মোচনই ঘটবে ‘দ্য তাসখন্দ ফাইলস’-এর হাত ধরে। ট্রেলারে অন্তত সেই ইঙ্গিতই মিলেছে।
বলিউডের শাসক দলের প্রতি ভক্তি প্রদর্শন অবশ্য এই প্রথম নয়। জওহরলাল নেহরুর আমলে একাধিক হিন্দি ছবিতে তাঁকে তুলে ধরা হয়েছে। লালবাহাদুর শাস্ত্রীর ‘জয় জওয়ান, জয় কিষান’ স্লোগান মনোজ কুমারের ‘উপকার’ ছবিতে ব্যবহার করা হয়। সবটাই ভক্তি প্রদর্শন নয়। সমালোচনার সাহসও দেখিয়েছে বলিউড। জরুরি অবস্থার সময় তৈরি ‘কিসসা কুর্সি কা’তে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর প্রবল সমালোচনা করা হয়। গুলজারের ‘আঁধি’ ছবিও ইন্দিরা গান্ধীর জীবনের ছায়া অবলম্বনে তৈরি হয়।
কিন্তু সব কিছু ছাপিয়ে ২০১৯-এর লোকসভা ভোটের আগে যে ছবিগুলি ঘিরে বিতর্ক শুরু হয়েছে, তাতে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, এ দেশেও কি ক্রমশ রাজনৈতিক প্রচারের মাধ্যম হয়ে উঠছে সিনেমা? কে না জানে, একটা উরিই তো যথেষ্ট একটা দলকে জিতিয়ে দেওয়ার জন্য।
আসলে মোদি জমানায় রূপালী পর্দায়ও ‘রাজনীতির সার্জিকাল স্ট্রাইক’ চলেছে অহরহ!