উপার্জন বেশ ভালো হলেও ব্যয়বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে সঞ্চয় তেমন একটা হবে না। শরীর খুব একটা ... বিশদ
মৌলানা মাসুদ আজহার। ওয়াহাবি ও দেওবন্দ সংস্কৃতির জারজ সন্তান। টাডা আসামির মুক্তি বা প্রত্যর্পণ কোনও অবস্থাতেই অসম্ভব। ১৯৯৯-র বড়দিনের প্রাক্কালে ‘কান্দাহার কাণ্ডে’ টাডা দণ্ডাজ্ঞাপ্রাপ্ত আসামী মাসুদের অত্যাশ্চর্য্য অলৌকিক মুক্তি! তারপর বিগত ২০ বছর ধরে শুধু কাশ্মীর নয়, গোটা ভারতকেই মৃত্যু উপত্যকায় পরিণত করার জেহাদি কারবারি মাসুদ আজহার। বিশ্ব-সন্ত্রাসবাদী হাফিজ সইদের স্থলাভিষিক্ত, পাকিস্তান সরকার ও আইএসআইএর নয়নের মনি; ‘সাইদা’ ছদ্মনামে নিরন্তর হুমকিবানে পাকিস্তানকে জর্জরিত করলেও মাসুদ অধরাই? যদিও ২০০২-র ১৪ জানুয়ারি থেকে পাকিস্তানের ‘ন্যাশনাল কাউন্টার টেররিজম অথরিটি’ জয়েশ ও তার কর্ণধার ‘মাসুদকে’ আরও ৩৩টি সংগঠনের সাথে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। ফাউস্টের মতই দোজখে নির্বাসিত, কাফকা-র সেই ‘লার্জেস্ট ভারমিন’ বা ভয়াল কৃমিকীটকে বারবার ভেটো প্রয়োগ করে, রাষ্ট্রসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদের ১২৬৭ কমিটিকে অগ্রাহ্য করে চীন বুকে আগলে রাখছে। কেন?
বাদল মেঘের ঘনঘটায় মুখখানি তার কোমল। বুদ্ধিদীপ্ত দীঘল মায়াবি চোখ। চশমার আড়ালে তেজস্বী। কখনও বা প্রতিহিংসার আগুনে ধিকিধিকি। নির্বিচারে নিরপরাধ মানুষ খুনে সোহাগী। মেদবহুল স্থূলকায়। অল্পেতেই হাঁপ ধরে। কার্বাইন-মেশিনগান নিয়ে দৌড়ঝাঁপে মোটেই স্বচ্ছন্দ নয়। তাই বোমা গুলি চালানোর উদয়াস্ত পরিশ্রম তার পোষায় না, মাঝপথেই দাঁড়ি পড়ে আফগানিস্তানে তালিবানি প্রশিক্ষণের। মোহময়ী অগ্নিগর্ভ বক্তৃতায় অক্লেশে সে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখতে পারে হাজার হাজার মানুষকে। সাল ১৯৯৪। হরকত-উল-আনসারের মহাসচিব সে। কাশ্মীরের অনন্তনাগের কাছে ‘খানাবালে’ অটোরিকশায় পরিভ্রমণরত। ধরা পড়ে গেল পুলিশের জালে। তার উপর ভার পড়েছিল হরকত উল-জিহাদ আল-ইসলামি ও হরকত-উল-মুজাহিদিনের দীর্ঘদিনের মনকষাকষি দূর করার।
জন্ম তার পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের ভাওয়ালপুরে। জন্মতারিখ ১০ জুলাই ১৯৬৮। মতান্তরে ৭ আগস্ট ১৯৬৮। ১১ জন ভাইবোনের সংসারে সে তৃতীয়। বাবা আল্লা বক্স সাব্বির, একটি সরকারি স্কুলে হেডমাস্টারি করতেন। সঙ্গে ‘দেওবন্দ’ মৌলবিগিরিও চলত। ছিল খাটাল ও আর হাঁস-মুরগির ব্যবসা। ক্লাস এইটের পরে পড়াশোনায় দাঁড়ি পড়ে। তারপর জামিয়া-উলুম-ইসলামিক স্কুল থেকে ১৯৮৯তে স্নাতক। হরকত-উল-আনসারের সূতিকাগৃহ ছিল এই মাদ্রাসাটি। সটান যোগদান সোভিয়েত-আফগান যুদ্ধে। যুদ্ধক্ষেত্র থেকে নিষ্কৃতি দিয়ে তাকে ‘হরকত’-এর মোটিভেটর বা প্রেরণাদাতা করা হল। সম্পাদনার ভার পড়ল উর্দু পত্রিকা ‘সাদে মুজাহিদিন’ ও আরবি ভাষার ‘সতে কাশ্মীরে’র। ততদিনে সে পরিব্রাজন করেছে বহু দেশ। জেহাদি ইসলামের নামে টাকা সংগ্রহ করে ফিঁদায়ে জঙ্গিদের তুলে আনছে। সস্নেহে লালন পালন করছে। শেখাচ্ছে কী করে জীবন মৃত্যুকে পায়ের ভৃত্য করতে হয়। মুজফফরাবাদের বক্তৃতায় বলছে, ইজরায়েল-আমেরিকা-ভারতের সব কাফেরগুলোকে শ্মশানে না পাঠানো পর্যন্ত তার শান্তি নেই।
জন্মু-কাশ্মীর পুলিশ ও কেন্দ্রীয় বাহিনীর চিরুনি তল্লাশিতে অটোরিকশা থেকে ধরা পড়ল ‘ওয়াহাবি’ সংস্কৃতির ধারক ও বাহক মাসুদ আজহার। যত বেশি কাফের বধ তত বেশি আল্লার করুণালাভ। ১৯৮৭-র কাশ্মীরি নির্বাচন ‘ওয়াহাবি’ সংস্কৃতির বেসামাল বিস্তারে অনুঘটকের কাজ করেছিল। পুলিশের হাতে ধরা পড়ার পর কড়া নিরাপত্তায় জম্মুর ‘কোট ভালওয়াল’ জেলে রাখা হল মাসুদ আজহারকে। বেশ কয়েকবার জেল ভেঙে পালানোর চেষ্টা ব্যর্থ হল। একবার সুড়ঙ্গ খুঁড়ে পুলিশ-পাহারাদারদের চোখে ধুলো দিয়ে প্রায় ভেগে পড়েছিল। বাধ সাধল তার পৃথুলা শরীর। সবার আগে বেরোতে গিয়ে বেঢপ শরীর নিয়ে আটকে গেল সুড়ঙ্গের মুখে। ফাঁদে পড়া ইঁদুরের মত সদলবলে ধরা পড়া গেল। পুলিশের বেধড়ক ঠ্যাঙানিতে গড়গড় করে বলে গেল আইএসআই-র যাবতীয় গোপন কর্মকাণ্ড। বলে গেল তার হানাদাড়ির ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা। ততদিনে সন্দেহভাজন উগ্রপন্থীদের হাতে খুন হয়ে গিয়েছেন কাশ্মীর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মুশির-উল-হক, হিন্দুস্তান মেশিন টুলসের জেনারেল ম্যানেজার হরবংশ লাল খেরা, অপহৃত হয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মুফতি মহম্মদ সইদের কন্যা ড. রুবাইয়া সইদ। প্রতিটা ঘটনার নেপথ্যে অভিযুক্ত মাসুদ আজহার। হরকত-উল-আনসার ও পাকিস্তান সেইসময় আজহারকে জম্মুর জেল থেকে বের করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিল। ছ’জন পশ্চিমী পর্বতারোহীকে হরকত অপহরণ করে, একজন পালিয়ে বাঁচলেও বাকিদের শিরশ্ছেদ করা হয়। মার্কিন গোয়েন্দা দপ্তরের হাজারো জেরাতেও মাসুদ আজহারের কাছ থেকে অপহৃত পর্বতারোহীদের সম্বন্ধে কোনও তথ্য মেলেনি। ১৯৯৯-র সেই কালা দিন, ২৪ ডিসেম্বর। কাঠমাণ্ডু থেকে দিল্লি যাওয়ার পথে ছিনতাই হল ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের আইসি—৮১৪ বিমান। বিশ্বত্রাস সেই আট দিনে, ২৪—৩১ ডিসেম্বর, মাসুদ আজহারের অবিশ্বাস্য-অলৌকিক ললাটলিখন পূণর্লিখিত হল।
কুড়ি বছর আগে
আইসি—৮১৪ বিমান ছিনতাই সংক্রান্ত রিপোর্টের বিশ্লেষণের ভার পড়েছিল রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালিসিস উইং বা ‘র’এর প্রাক্তন প্রধান এ এস দুলাতের উপর। বছর দুয়েক আগে তিনি রিপোর্টটির মূল্যায়নে দু’টি মাত্র শব্দ খরচ করেছিলেন। goof up অর্থাৎ জগাখিচুড়ি। দুলাত তাঁর বই ‘কাশ্মীর: দি বাজপেয়ি ইয়ারস’-এ লিখছেন বিমান ছিনতাইয়ের পর দিল্লি বা পাঞ্জাবে এমন কেউ ছিলেন না যিনি বেড়ালের গলায় ঘণ্টাটা বাঁধতে পারেন। সকলেই ব্যস্ত পারস্পরিক দোষারোপে। চুলোয় গিয়েছিল জাতীয় নিরাপত্তা। দুলাত আটদিনের ছিনতাই পর্বের স্থবির প্রশাসনিক নৌটঙ্কীকে বিভূষিত করেছেন। ২৪ ডিসেম্বর ১৯৯৯। ১৭৮ জন যাত্রী ও ১১ বিমানকর্মীকে নিয়ে ৫.৩০ মিনিটে কাঠমাণ্ডু থেকে দিল্লির উদ্দেশে পাড়ি জমিয়েছিল ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের আইসি—৮১৪ বিমানটি। আকাশে ওড়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই চার মুখোশধারী বিমানটিকে লাহোর উড়িয়ে নিয়ে যেতে আদেশ করে। পাইলট ‘ক্যাপ্টেন দেবী শরণ’ জানালেন বিমানে তেল প্রায় শেষ। সুতরাং অমৃতসরে রাজা সাঁসী বিমানবন্দরে অবতরণ করা ছাড়া গত্যন্তর নেই। ৪৫ মিনিট বিমানটি টারম্যাকে স্থাণু। বিভিন্ন প্রশাসনিক মহল থেকে বারেবারে জরুরি ফোন আসছে কিছুতেই যেন জ্বালানি ভরে বিমানটি অমৃতসর ছাড়তে না পারে। প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ি তখন এয়ারফোর্সের বোয়িং বিমানে দেশের অভ্যন্তরে পরিভ্রমণরত। সঙ্গে রয়েছেন পিএমও-র সহায়ক বিজেপি নেতা কাঞ্চন গুপ্তা। দেশের মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত বিচরণের জন্য ইন্ডিয়ান এয়ারফোর্সের বুড়ো বোয়িং-এ তখন ‘স্যাটেলাইট ফোনের’ কোনও ব্যবস্থা ছিল না। ফলে প্রধানমন্ত্রীর বিমানের পাইলট বা তাঁর পারিষদেরা ঘুণাক্ষরেও টের পেলেন না যে আইসি—৮১৪ ছিনতাই হয়েছে। ১ ঘণ্টা ৪০ মিনিট পরে দিল্লির পালাম বিমানবন্দরের টেকনিক্যাল এরিয়ার ভিআইপি বে-তে যখন প্রধানমন্ত্রীর বিমান মাটি ছুঁল, তখন দেখা গেল বিমান থেকে নামার সিঁড়ির মুখে উদ্বিগ্ন মুখে দণ্ডায়মান জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ব্রজেশ মিশ্র। তিনি গোটা ঘটনাটা আনুপুঙ্খিক প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর পারিষদদের জানালেন। ছিনতাই হওয়া বিমানটি যে ৪৫ মিনিট ঠায় অমৃতসরে দাঁড়িয়ে আছে জানালেন তাও। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগের অভাবে কোনও দিশা নির্ধারিত হচ্ছিল না। স্বরাষ্ট্র থেকে বিদেশ থেকে পাঞ্জাব পুলিসের উচ্চ পদাধিকারীরা মুণ্ডহীন মুরগির মতো ছটফট করে দাপরে মরছিল। বিদেশমন্ত্রী যশবন্ত সিনহা মাথার চুল ছিঁড়তে ছিঁড়তে ফোনটাকে আছড়ে ফেলে চিৎকার করে বললেন, ছিনতাই হওয়া বিমানের সামনে খাড়া করে দিন অন্তত একটা তেলের ট্যাঙ্কার বা বড় ট্রাক নিদেন একটা রোড রোলার। ইতিমধ্যে খবর এল ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট গ্রুপ বা সিএমজি ন্যাশনাল সিকিউরিটি গার্ডদের তৈরি করে দিল্লি থেকে অমৃতসর নিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। মানেসরের কাছে ট্রাফিক জ্যামে আটকে গেল এনএসজি কম্যান্ডোদের গাড়ি। যদিও বা জ্যাম থেকে ছাড় মিলল দিল্লি বিমানবন্দরে, মিলল না কোনও আপৎকালীন বিমান। যাতে করে কম্যান্ডোদের ‘ফেরি’ করা যায় অমৃতসরে। অগত্যা পাঞ্জাব পুলিস প্রধান সর্বজিৎ সিং অনন্যোপায় হয়ে দিল্লিকে জানালেন যে, তার কম্যান্ডোরা এ ধরনের বিমান ছিনতাইয়ের ঘটনাকে বাগ মানাতে যথেষ্ট পারদর্শী। দিল্লি অনুমতি দিলে তিনি মাঠে নেমে কাজ শুরু করতেই পারেন। দিল্লির অনুমতি মিলল না। দিল্লি চাইছে না রক্তপাত। সাংবাদিকরা পৌঁছে গেছেন বিমানবন্দরে। তাদের চোখের সামনেই একটা বিশালকায় ট্রাককে বিমানটির দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা শুরু হল। যার মধ্যে বসে ছিলেন এনএসজি কমান্ডোরা। তারা প্রথমে বিমানের চাকা দুটোকে ফুটো করে দেওয়ার পরিকল্পনা করেন। ছিনতাইবাজরা ভারত-সরকারের দুরভিসন্ধি টের পেয়ে ক্যাপ্টেনকে বাধ্য করল লাহোর উড়ে যেতে। সেখানে আর এক প্রস্থ নাটক। পাকিস্তান নামতে দেবে না বিমানটিকে। ছিনতাইবাজদের ঝামেলায় তারা জড়াতে চায় না। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আদবানি ও বিদেশমন্ত্রী যশবন্ত সিনহা উন্মত্তের মতো ফোন করে যাচ্ছেন পাকিস্তানে। যাতে জ্বালানি ভরার পর কোনওভাবেই বিমানটিকে উড়তে না দেওয়া হয়। জ্বালানি ভরেই আইসি—৮১৪ পাড়ি জমালো দুবাইয়ের পথে। একজন যাত্রীকে ততক্ষণে ছিনতাইবাজরা ছুরি মেরে হত্যা করেছে। কয়েকজন তাদের হাতে মারাত্মক জখম। ২৬ জন যাত্রীকে দুবাই বিমানবন্দরে মুক্তি দেওয়া হল। সেখান থেকে আইসি—৮১৪কে সোজা উড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হল কান্দাহার। যে তালিবানি দেশের সঙ্গে ভারতের তখন নেই কোনও কূটনৈতিক সম্পর্ক। ইতিমধ্যে ক্যাবিনেট সেক্রেটারি, প্রভাত কুমার অপদার্থতার গোটা দায়ভার চাপিয়ে দিয়েছেন এনএসজি প্রধান নিখিল কুমারের ঘাড়ে। ভারতের সর্বোচ্চ প্রশাসনিক স্তরে হাঁটু কাঁপতে কাঁপতে কেটে গিয়েছে অমূল্য পাঁচ ঘণ্টা সময়। তিনটি দেশের তিনটি বিমানবন্দর ছুঁয়েছে আইসি—৮১৪। ব্যর্থ হয়েছে আদবানি, যশবন্ত সিনহার যাবতীয় দৌত্য। দুবাই বিমানবন্দরে আমেরিকার রাষ্ট্রদূতকে ঢুকতে দেওয়া হয়েছে। প্রবেশাধিকার পাননি ভারতীয় রাষ্ট্রদূত। যে মুহূর্তে আইবি অধিকর্তা, শ্যামল দত্ত বিমান ছিনতাইয়ের খবর আদবানিকে জানিয়েছিলেন সেই মুহূর্তেই তিনি ভারতে কর্মরত মার্কিন রাষ্ট্রদূত রবার্ট ব্ল্যাকউইলকে ‘এসওএস’ পাঠিয়ে আমেরিকার সাহায্য প্রার্থনা করেন। আদবানিজির কাতর প্রার্থনায় কর্ণপাত করেনি আমেরিকা-পাকিস্তান-আরবদুনিয়া। যশবন্ত সিনহা তাঁর বই ‘ইন্ডিয়া আ্যাট রিস্ক’-এ লিখছেন যে তাঁর আজও বোধগম্য হয় না, কেন মানেসর থেকে অমৃতসরে এনএসজিকে নিয়ে যাওয়া গেল না। ‘মাই কান্ট্রি, মাই লাইফে’ আদবানিও তাঁর তীব্র হতাশা গোপন রাখেননি। মন্ত্রিসভার জরুরি বৈঠকে ঠিক হল তিনজন অফিসারকে কান্দাহার পাঠানো হবে। তাঁরা হলেন তৎকালীন আইবি-র বরিষ্ঠ অফিসার অজিত দোভাল, বিদেশ মন্ত্রকের যুগ্ম সচিব বিবেক কাটজু ও ‘র’-এর সি ডি সহায়। প্রথমে ছিনতাইবাজরা ১০৩ জন জেলবন্দি জঙ্গির মুক্তির দাবি তুলেছিল। তারপর ৩৬। সর্বশেষ রফা হয় তিন জঙ্গির মুক্তির বিনিময়ে। মাসুদ আজহারসহ মুস্তাক আহমেদ জারগার ও ওমর শেখকে সেযাত্রায় মুক্তি দেওয়া হয়। গোটা ঘটনার চক্রী মাসুদের ভাই আবদুল রউফ আসগর। তিন জঙ্গিকে নিয়ে বিশেষ বিমানে কান্দাহার পৌঁছন যশবন্ত সিনহা। বিরাট অঙ্কের টাকাও দাবি করেছিল ছিনতাইকারীরা। জঙ্গির সংখ্যায় দরকষাকষি চললেও টাকার অঙ্ক কোনও অবস্থাতেই কমাতে রাজি ছিল না ছিনতাইবাজরা। নিরাপদে সেই টাকা ছিনতাইবাজদের হাতে তুলে দেওয়ার জন্যই নাকি যশবন্তকে শিখণ্ডী করে পাঠানো! মাসুদ আজহারের বাড়বাড়ন্ত সেই শুরু।
জয়েশ ও মাসুদ আজহার
জয়েশ-ই-মহম্মদ শব্দের অর্থ মহম্মদের সেনাবাহিনী। ২০০০ সালের গোড়ায় মাসুদের হাত ধরে জয়েশের গোড়াপত্তন। ওসামা বিন লাদেনের সঙ্গে মাসুদের ছিল নিবিড় সখ্য, সেটা নব্বইয়ের দশক। মাসুদ তখন হরকত-উল-মুজাহিদিনের নেতা। লাদেনের ‘ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ফ্রন্টে’র প্রতিষ্ঠাতা সদস্যও মাসুদ। ফেব্রুয়ারি ৪, ২০০০। করাচির বিনোরি মসজিদে এক ধর্মীয় মহাসভায় ‘জয়েশে’র জন্মগ্রহণের কথা মৌলানা মহম্মদ ইউসুফ লুধিয়ানভি ও মুফতি সামজাই মহাসমারোহে ঘোষণা করলেন। নেতৃত্বে মাসুদ আজহার। দিন কয়েকের মধ্যেই গুপ্ত ঘাতকের হাতে খুন হলেন লুধিয়ানভি। হরকত-উল-মুজাহিদিনের তিন চতুর্থাংশ সদস্য জয়েশে যোগ দিল। শুরু হল হরকত ও জয়েশের কামড়াকামড়ি। ঝামেলা মেটাতে ব্যর্থ স্বয়ং লাদেন। হাল ছেড়ে দিয়ে লাদেন ঝুঁকে পড়লেন মাসুদ ও তার জয়েশের দিকে। পোয়াবারো তখন জয়েশের। এপ্রিল ১৯, ২০০০। বাদামিবাগে ভারতীয় সেনাবাহিনীর ১৫ কর্পের হেডকোয়ার্টারের সামনে প্রথম আত্মঘাতী গাড়ি-বোমাবিস্ফোরণ। নিহত এক, আহত সাত। অক্টোবর ২০০১। জম্মু-কাশ্মীর বিধানসভায় বোমা বিস্ফোরণ। চক্রী জয়েশ। মারা গেলেন ৩০ জন নিরপরাধ মানুষ। ডিসেম্বর ১৩, ২০০১। পাঁচজন সশস্ত্র জয়েশ জঙ্গি হামলা চালালো পার্লামেন্টে। নিরাপত্তারক্ষীসহ মারা গেলেন ৯ জন। পার্লামেন্ট আক্রমণের পর মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট জয়েশের গায়ে ‘ফরেন টেররিস্ট অর্গানাইজেশনে’র তকমা সেঁটে দিল। পাকিস্তান ২০০১-র ২৯ ডিসেম্বর ভারতীয় পার্লামেন্টে আক্রমণের অভিযোগে মাসুদ আজহারকে জেলে পুরল। লাহোর হাইকোর্ট একবছর বাদে বেকসুর খালাস করল মাসুদকে। মোশারফ জয়েশকে নিষিদ্ধ করলেন ২০০২-তে। সে বছরেই মার্কিন সাংবাদিক ড্যানিয়েল পার্লের মুণ্ডচ্ছেদ করল জয়েশ। দু দুবার খুন করার চেষ্টা করল মোশারফকে। সাল ২০০৩, জয়েশ-ই-মহম্মদের নাম রাতারাতি পাল্টে তেহরিক-আল-ফারকান। সঙ্গে ১২ জন নেতাকে বহিষ্কার। মাসুদ আজহারের নেতৃত্বে তৈরি হল খুদ্দাম-আল-ইসলাম। বিদ্রোহী নেতা মৌলানা আবদুল জব্বার খুলে ফেললেন নতুন দল জামাত-উল-ফারকান। মাসুদ আরও আগ্রাসী ও হিংসাশ্রয়ী হয়ে উঠল। যত বেশি কাশ্মীরি রক্তপাত তত বেশি পাকিস্তানে জনপ্রিয়তা। তত বেশি তালিবানি, আল-কায়েদার সাহায্য। ২ জানুয়ারি, ২০১৬। পাঠানকোট বায়ুসেনাঘাটিতে হামলা চালাল জয়েশ। সেপ্টেম্বর ১৮, ২০১৬। উরিতে এলওসি-র কাছে প্রত্যুষে সেনা-ক্যাম্পে হামলা চালাল জয়েশ। নিহত ১৭ জন সেনা। পরিকল্পনাকারী কাসিফ জান, রউফ আসগর ও মাসুদ আজহার। ২৯ নভেম্বর, ২০১৬। জয়েশের আফজল গুরু স্কোয়াড জম্মু-কাশ্মীরের ‘নাগ্রোটায়’ খুন করল সাত সেনা জওয়ানকে। ১৪ ফেব্রুয়ারির পুলওয়ামার ৪০ জওয়ানের ঘৃন্যতম হত্যার ঘটনাই প্রথম নয়, ২৬ আগস্ট ২০১৭-তেও জয়েশ পুলওয়ামায় পুলিসের ওপর হামলা চালিয়েছিল। ৮ জন নিরাপত্তারক্ষীর সে যাত্রায় প্রাণ গিয়েছিল। ‘কোয়ালাম উইকলি’ জয়েশের অনলাইন ম্যাগাজিন। উদ্বাহু হয়ে সেখানে মাসুদ আজহারের প্রশংসা করা হয়েছে। ভারতীয় সেনাবাহিনীর উপর আরও অজস্র আক্রমণ শানানোর হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছে। হ্যামেলিনের বাঁশিওয়ালার মতো কাশ্মীরি যুবসমাজকে মুসলিম অধিকার রক্ষায় ‘মারো এবং মরো’ মন্ত্রে দীক্ষিত হতে প্রলুব্ধ করা হচ্ছে। জয়েশ বড় ধাক্কা খেল ডিসেম্বর ২৬, ২০১৭-তে। দক্ষিণ কাশ্মীরের পুলওয়ামার সামবোরায় সেনা সংঘর্ষে নিহত হল তাদের অন্যতম সংগঠক নুর মহম্মদ তান্ত্রে ওরফে নুর ত্রালি। কাশ্মীর উপত্যকায় নতুন করে চেগে ওঠা জঙ্গি কার্যকলাপের সেই ছিল মাথা।
মাসুদ আজহারের জোশের নেপথ্যে
পারভেজ মোশারফ যবে থেকে বিশ্ব সন্ত্রাস রোধে আমেরিকার সঙ্গে হাত মিলিয়ে চলতে প্রতিশ্রতিবদ্ধ হন তবে থেকেই ‘জয়েশে’র শনির দশার শুরু। দল ভাঙতে শুরু করল। ইসলামাবাদের ‘লাল মসজিদ’ জবরদখলে নাম জড়াল জয়েশের। পাকিস্তানের পাঞ্জাব পুলিসের কাছে যে জয়েশ মোটেই উগ্রপন্থী সংগঠন হিসেবে নথিভুক্ত ছিল না তারাই পাকিস্তান বায়ুসেনার বাসে হামলা চালানোর দায়ে ‘জয়েশে’র মহম্মদ হারুন আকবর খান, মতি-উর-রহমান আরান ও মহম্মদ তায়েবকে সপাটে উগ্রপন্থীর কালো-তালিকাভুক্ত করল। মাসুদ আজহারকে ভাওয়ালপুরে কোণঠাসা করে রাখা হল। জয়েশের বিদ্রোহীরা ও ‘ভালো উগ্রপন্থীরা’ বা তালিবান ততদিনে আশ্রয় খুঁজে নিয়েছে তেহরিক-ই-তালিবান পাকিস্তান বা টিটিপির পক্ষপুটে। তারা চোরাগোপ্তা আক্রমণ শানাচ্ছে পাকিস্তান সরকারের সেনা-পুলিসের বিরুদ্ধেই। ২০১৪-র জার্ব-এ-আজব-এ আইএসআই-এর কাতর অনুরোধে ভালো উগ্রপন্থীরা মাসুদ আজহারের নেতৃত্বে পুনরায় একত্রিত হয়ে কাশ্মীর ও আফগানিস্তানে আক্রমণ চালাবে বলে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হল। তাদের বন্দুক আর পাকিস্তানের বিরুদ্ধে গর্জাবে না। মিলবে তালিবানি ও আইএসআইয়ের অঢেল অর্থ সাহায্য।
২৬/১১-র মুম্বই হামলার পর থেকেই হাফিজ সইদের উপর আন্তর্জাতিক চাপ গগনচুম্বী হয়ে উঠছিল। ২০০৮-র ১৭ ডিসেম্বর হাফিজ ‘গ্লোবাল টেররিস্টের’ তকমা পেল। জয়েশের থেকে হাফিজের লস্কর-ই-তোইবার সঙ্গেই মধুরতম সম্পর্ক ছিল আইএসআইয়ের। কিন্তু গোটা বিশ্বের কড়া নজরদারিতে দিন গুজরান আইএসআই-এর পক্ষে সম্ভব নয়। তাই বাধ্য হয়ে জয়েশের হাত ধরা। হাফিজ অবশ্য তার মধ্যে দুবার নাম পাল্টেছে লস্করের। প্রথমে জামাত-উদ-দাওয়া পরে তেহরিক আজাদি-জম্মু অ্যান্ড কাশ্মীর। যদিও চিঁড়ে তাতে ভেজেনি। মাসুদ আজহার কখনোই হাফিজ সইদের মতো প্রোজ্জ্বল নন। নিজেকে জাহির করেন না। সাংগঠনিক ক্ষমতা প্রবল। পাকিস্তানের বিভিন্ন গোড়া ধর্মীয় বা উগ্রপন্থী সংগঠনের কাছেও মাসুদের গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নাতীত। যেমন জামাত-ই-উলেমা-ই-ইসলাম ফজলুর রেহমান, সিপাহি-সাহাবা, লস্কর-ই-জাংভি প্রভৃতি। যে ১৩-১৫টি জঙ্গি সংগঠন ‘ইউনাইটেড জেহাদ কাউন্সিল’ বা ইউজেসির ছাতার তলায় কাশ্মীরে সক্রিয় জঙ্গি কার্যকলাপে যুক্ত এবং আইএসআইয়ের সার্বিক পৃষ্ঠপোষণায় পরিপুষ্ট তাদেরও অন্যতম জয়েশ। ২০১৬-র পাঠানকোট বায়ুসেনা ঘাঁটি আক্রমণের পর আল কোয়ালামে ‘সাইদি’ ছদ্মনামে একটি লেখা লেখে মাসুদ আজহার। স্পষ্টতই সে পাকিস্তান সরকারকে হুমকি দিয়ে বলছে জয়েশের গায়ে আঁচড় পড়লে পাকিস্তানের কাছেও তা হবে যথেষ্ট মহার্ঘ্য। ভারত-আমেরিকা-ইজরায়েল থেকে বন্দুকের নল তখন ঘুরে যাবে পাকিস্তানের দিকেই। অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদেই পাকিস্তানের পক্ষে সম্ভব নয় মাসুদ আজহারকে ‘গ্লোবাল টেররিস্ট’ তকমায় ভূষিত হতে দেওয়া। তাই চীনের পদলেহন। রাষ্ট্রসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদের ১২৬৭ কমিটিতে চীনের দুবার বাধাদান, মার্চ ও অক্টোবর ২০১৬। আমেরিকা-ইংল্যান্ড-ফ্রান্স ১৪ ফেব্রুয়ারির পরে যখন এককাট্টা হয়ে মাসুদকে ‘গ্লোবাল টেররিস্ট’ ঘোষণায় বদ্ধপরিকর তখন চীনের পুনরায় ভেটো-প্রদান। চীনের যুক্তি: ব্রিকসের ভদ্রলোকের চুক্তিতে কোনও সংগঠনকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা গেলেও ব্যক্তিকে যায় না। সুতরাং মাসুদ আজহার নিষ্কলঙ্ক। ‘চীন পাকিস্তান ইকনমিক কো-অপারেশন’ বা ৫১ বিলিয়ন ডলারের ‘ওয়ান রোড ওয়ান বেল্ট’ মাসুদ আজহারকে বাদ দিয়ে কি সম্ভব?
বিচারের ফাঁক ফোকর
মাসুদ আজহারের মতো ভয়ঙ্কর জঙ্গির বিচার কখনোই জম্মু-কাশ্মীরের অস্থির পরিবেশে জম্মুর আদালতে হওয়া বাঞ্ছনীয় নয়। কারণ তা অভিযুক্ত, সাক্ষী, বিচারক, পাবলিক প্রসিকিউটর কারুর কাছেই মঙ্গলজনক নয়। তাই ১৭ জুন ১৯৯৫-র নির্দেশনামায় (SO 551E)কেন্দ্রীয় সরকার বলল যে, এই ধরনের ভয়ঙ্কর অপরাধ, অপরাধীর বিচার হবে রাজ্যের বাইরে। টাডা আইনের ১১ ধারার ২নং উপধারা মোতাবেক (১৯৮৭-র ২৮নং) ভারতের প্রধান বিচারপতি কেন্দ্রীয় সরকারের পরামর্শে জম্মুর আদালত থেকে সব স্পর্শকাতর মামলা তুলে রাজস্থানের আজমেঢ়ের কোর্টে স্থানান্তর করলেন। এই আদেশনামাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে পাঁচ কুখ্যাত জঙ্গি, যথা: জাহিদ আহমেদ জারগার, শওকত আহমেদ বক্সী, মহম্মদ সালিম জারগার প্রভৃতিরা (OWP NO.—221/95, 222/95, 223/95 V/S Attorney General of India) জম্মু-কাশ্মীর হাইকোর্টে পিটিশন দাখিল করল। ‘রণবীর পেনাল কোড’ অনুযায়ী জম্মু-কাশ্মীরে সংঘটিত ‘স্থানীয়’ কোনও অপরাধের বিচার বাইরের কোনও রাজ্যের কোর্টে করা সম্ভব নয়। ভারপ্রাপ্ত বিচারপতি পুনরায় হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতিকে অনুরোধ করলেন বিতর্কিত মামলাটি যাতে ডিভিশন বেঞ্চে পাঠানো হয়। ডিভিশন বেঞ্চে ছিলেন বিচারক ভি কে গুপ্তা এবং জি ডি শর্মা। অভিযুক্ত আসামিদের মধ্যে ছিলেন মাসুদ আজহারসহ বেশ কিছু ভয়ঙ্কর জঙ্গি। বিচারকদের মতামত শুনে ‘রণবীর পেনাল কোডের’ স্থানীয় বাধ্যবাধকতার কারণে কেন্দ্রীয় সরকার আদেশ দিলেন বিচার-প্রক্রিয়া অগত্যা জম্মু কাশ্মীরেই শুরু করার। টানাপোড়েনে কেটে গিয়েছে ৫ বছর। দাগী অপরাধীরা ভয় দেখাতে শুরু করেছে সাক্ষীদের। হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি কেসটা পাঠিয়েছেন বিচারপতি ভবানী সিং-এর এজলাসে। ভবানী সিং প্রধান বিচারপতি হওয়ার পর কেসটা প্রেরিত হয়েছে আরেকজন বিচারপতির এজলাসে। ভয়ে, পারিপার্শ্বিক নানা চাপে তিনিও অনাবশ্যক দেরি করেছেন শুনানিতে। টাডা আদালতে কোনও জঙ্গির বিচার সুসম্পন্ন হয়নি। দোষী সাব্যস্ত হয়নি কোনও অভিযুক্ত। সরকার ও আদালত কালের নিয়মে রণে ভঙ্গ দিয়েছে। টাডা আদালতে বিচারাধীন বন্দি কুখ্যাত জঙ্গি মাসুদ আজহারকে সসম্মানে কান্দাহার কাণ্ডে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। বিচারপতি জি ডি শর্মার মতে টাডা আদালতে বিচারাধীন বন্দি মাসুদ আজহারের মুক্তি কোনও অবস্থাতেই সম্ভব নয়। তথাপি বিচারের প্রহসনে মাসুদ আজহার মুক্ত। বিগত কুড়ি বছর ধরে ভারতের মাটিতে চালিয়েও যাচ্ছে সে নিরঙ্কুশ হত্যা-লীলা! বিচারপতি শর্মার বিলাপ: When Judge quails, Justice wails.