উপার্জন বেশ ভালো হলেও ব্যয়বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে সঞ্চয় তেমন একটা হবে না। শরীর খুব একটা ... বিশদ
সবথেকে বেশি সন্ত্রাসের রিপোর্ট কোথা থেকে আসছে?
বেঙ্গল থেকে। কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি?
সবরকম ব্যবস্থাই নেওয়া হয়েছে। কিন্তু, বিপজ্জনক হল ওই বাংলার চরমপন্থী সন্ত্রাসবাদীরা। যাঁরা নিজেদের স্বাধীনতা সংগ্রামী আখ্যা দিচ্ছে। ভয় দেখানো, আন্দামানে নির্বাসন, ফাঁসি সব হয়েছে। কিন্তু কোনওভাবেই তো থামানো যাচ্ছে না। আর এই বাংলার ‘সন্ত্রাসবাদীরা’ দেশের অন্যত্র প্রভাব বাড়াচ্ছে। লন্ডন থেকে দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে বম্বে বন্দরে জাহাজ থেকে নামার চারদিন পর দিল্লিতে ভাইসরয় হাউসে বসে ভাইসরয় লর্ড চেমসফোর্ডের থেকে প্রাথমিক রিপোর্ট নিচ্ছিলেন জাস্টিস সিডনি রাউলাট। লন্ডন হাইকোর্টের বিচারপতি। তাঁকেই তিক্তকন্ঠে এসব কথা বলছেন লর্ড চেমসফোর্ড। কারণ, বেঙ্গল তাঁকে ব্যতিব্যস্ত করে রেখেছে। সেখানে আইসিএস অফিসাররা চাকরি করতে যেতে ভয় পাচ্ছে। এমন অবস্থা! জাস্টিস রাউলাট মন দিয়ে শুনছেন। তাঁকে পাঠানো হয়েছে ভারতে একটা কঠোর আইন নিয়ে ভাবনাচিন্তা করতে। কারণ, আচমকা বিগত বছরগুলিতে চরমপন্থী বিপ্লবের একটা প্রবণতা শুরু হয়েছে। বোম্বাই, পাঞ্জাব আর মাদ্রাজে তো আছেই। তবে, এসবের প্রধান শক্তিশালী শিকড় বেঙ্গল। হঠাৎ এরকম একটা সিদ্ধান্ত নেওয়ার কারণ কী? ব্রিটিশ সরকার ভয় পেয়ে গেল নাকি চরমপন্থীদের? কিছুটা তো বটেই। তার অন্যতম একটি কারণ আছে। কয়েকমাস আগেই রাশিয়ায় একটা সাংঘাতিক কাণ্ড ঘটেছে। বলশেভিকরা ক্ষমতা দখল করে ফেলেছে। তাই দুমাসের মধ্যেই অর্থাৎ ১৯১৭ সালের ডিসেম্বরেই ব্রিটিশ সরকার একটা কমিটি গড়ে ফেলল। কমিটির উদ্দেশ্য হল —‘দ্য নেচার অ্যান্ড এক্সটেন্ট অব দ্য ক্রিমিন্যাল কন্সপিরেসি কানেকটেড উইথ দ্য রেভোলিউশনারি মুভমেন্ট ইন ইন্ডিয়া’। কমিটি গঠনের নোটিফিকেশনে এরকমই লেখা হয়েছিল। সোজা কথায় ভারতের বিপ্লবী আন্দোলনের প্রকৃতি আর অপরাধমূলক চক্রান্ত সম্পর্কে অবগত হওয়া। এই কমিটির চেয়ারম্যান করা হল ওই জাস্টিস সিডনি রাউলাটকে। আরও দুজন সদস্য আছেন। দুজন ব্রিটিশ। দুজন ভারতীয়। মাত্র চারমাসের মধ্যেই জাস্টিস রাউলাট তৈরি করে ফেললেন রিপোর্ট। সেই রিপোর্টের ভিত্তিতে আইন তৈরি করা হবে। যাতে এইসব বিপ্লব প্রবণতাকে কঠোর হাতে দমন করা যায়। কারণ, রাশিয়ার মতো এখানেও যে আবার বিপ্লবীরা ক্ষমতা দখল করে নিতে সক্ষম হবে না কে বলতে পারে! তাই দ্রুত শিকড়ে আঘাত করতে হবে। রাউলাট রিপোর্টের দুটি ভাগ। প্রথম ভাগে রয়েছে এ পর্যন্ত যতরকম হিংসাত্মক ঘটনা ঘটেছে তার বিবরণ এবং কিছু ব্যবস্থাগ্রহণ সংক্রান্ত চার্ট, নথি। একটা করে গোটা পরিচ্ছদ জুড়ে পৃথক প্রদেশের হিংসাত্মক কাণ্ড-কারখানা। অর্থাৎ একটা চ্যাপ্টার বম্বের ঘটনাবলী, একটা চ্যাপ্টার শুধুই পাঞ্জাব নিয়ে, একটা পরিচ্ছদ মাদ্রাজের বিপ্লবী কার্যকলাপ। কিন্তু, রাউলাট রিপোর্টের পাঁচটি চ্যাপ্টার শুধুমাত্র বেঙ্গল নিয়ে। বাংলার বিপ্লবীরা কতটা মারাত্মক, কতটা বিপজ্জনক তার বিবরণ এবং বিস্তারিত কিছু তথ্য কোথায় কোথায় গুপ্তসমিতি রয়েছে। সেইসব গুপ্তসমিতিতে বোমা তৈরি হয়। তবে, সবথেকে ইন্টারেস্টিং হল রাউলাট রিপোর্টে এটাও বলা হল, বেঙ্গলের এই সন্ত্রাসীদের সিংহভাগ হিন্দু যুবক যারা নিজেদের গুপ্তসমিতিতে কালী নামক একটি ভয়ঙ্কর দেবতাকে পুজো করে। এই কালীকেই আবার বেঙ্গলের গ্রামে ডাকাতরাও পুজো করে। জাস্টিস রাউলাটের রিপোর্টের দ্বিতীয় অংশ সাংঘাতিক। সেখানে বলা হয়েছে যে কোনও ব্যক্তিকে যদি সন্দেহ হয় সে সন্ত্রাসবাদ কিংবা ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে চক্রান্তে যুক্ত তাহলে গ্রেপ্তার করা হবে। আর সেক্ষেত্রে না উকিল, না আপীল না দলিল। অর্থাৎ কোনও ওয়ারেন্ট কোনও আবেদন কোনও আইনজীবী লাগবে না। সবরকম বিচারপ্রক্রিয়া হবে গোপনে। অর্থাৎ কোনও সংবাদমাধ্যম কিংবা পাবলিক দেখতে পাবে না কীভাবে শুনানি হচ্ছে। আর শুনানির কোনও অংশ প্রকাশ হবে না। কেউ জানতেও পারবে না। সাক্ষীর দরকার নেই। বিচারক রায় শোনানোর আগে জুরিদের কথাও শুনবেন না। কারণ, রাউলাট আইনে জুরি নেই। জাস্টিস রাউলাটের এই আশ্চর্য স্বৈরাচারী রিপোর্টের ভিত্তিতে বিল তৈরি হবে দুটো। সে দু’টি বিল পাশ হয়ে গেলেই রাউলাট আইন কার্যকর হবে। ভাইসরয় ফ্রেডরিক চেমসফোর্ডের খুব পছন্দ হল এই রিপোর্ট। দ্রুত পাঠিয়ে দিলেন লন্ডনে। লন্ডনে বিলের কপি হাতে পেয়ে হতভম্ব এডউইন মন্টেগু। ব্রিটিশ সরকারের ভারতসচিব। এক বছর আগে তিনি ভারতে গিয়ে ভারতে শাসন সংস্কারের জন্য চেমসফোর্ডকে সঙ্গে নিয়ে একটি চুক্তি করে এসেছেন। আর এখন সম্পূর্ণ বিপরীত পন্থা? মন্টেগু ভারতের প্রতি সামান্য হলেও বেশ নরমপন্থী মানুষ। তিনি কালবিলম্ব না করে ভাইসরয় চেমসফোর্ডকে একটা লম্বা চিঠি লিখলেন, যেখানে যুদ্ধ প্রায় শেষের পথে (প্রথম বিশ্বযুদ্ধ) আর ডিফেন্স অফ ইন্ডিয়া অ্যাক্টই বাতিল করার কথা ভাবা হয়েছে, তখন আবার নতুন করে এরকম একটা আইন আনা উচিত নয়। কোনও ট্রায়াল ছাড়া যে কোনও ভারতবাসীকে হাজতে রেখে দেওয়ার মতো আইন মেনে নেওয়া যায় না। মন্টেগুর এসব যুক্তি মানতে অরাজি ভাইসরয় চেমসফোর্ড। তিনি পালটা চিঠিতে জানিয়ে দিলেন, এখন আর কিছু করার নেই। বেঙ্গলে যা অরাজক পরিস্থিতি চলছে তারপর আর আমার সরকারের পক্ষে সম্ভব নয় অন্য কিছু ভাবা। অতএব রাউলাট কমিটির রিপোর্ট গ্রহণ করা ছাড়া উপায় নেই।
এরকম একটা রিপোর্ট তৈরি হয়েছে ভারতীয়দের শায়েস্তা করতে এটা প্রথমে জানা যায়নি। জাতীয় কংগ্রেসের নেতারাও জানতে পারেননি। সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ব্যস্ত ছিলেন কলকাতার কংগ্রেস অধিবেশনের রেজোলিউশন নিয়ে। ১৯১৮ সালের ডিসেম্বরে কলকাতায় হবে কংগ্রেসের অধিবেশন। সুতরাং প্রস্তুতিতে ব্যস্ত। বালগঙ্গাধর তিলক আজকাল মামলার ব্যাপারে বারংবার যাচ্ছেন লন্ডনে। বেশি থাকতেই পারছেন না। এলাহাবাদের আনন্দভবন থেকেই প্রধানত কংগ্রেসের কাজকর্ম চালাচ্ছেন ব্যস্ত আইনজীবী মতিলাল নেহরু। এঁদের কাউকেই প্রাথমিকভাবে জানানোই হল না যে রাউলাট কমিটির রিপোর্টে কী সুপারিশ করা হয়েছে। আর মাত্র তিন বছর আগে দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ফেরা মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী আজকাল আমেদাবাদের সবরমতী আশ্রমে। তাঁর ইদানীং পেটের গোলমাল বেড়েছে। তার মধ্যেই আবার অর্শের একটা অপারেশন করতে বম্বেতে যেতে হল। সেই অপারেশনের পর এত ওষুধ খেতে হচ্ছে যে তিনি ভয়ানক ক্লান্ত দুর্বল। তাঁর সঙ্গী মহাদেব দেশাই সর্বক্ষণ ঘুমের ওষুধ দিয়ে কিছুটা যন্ত্রণা লাঘব করার চেষ্টা করছেন। তবে মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী তাঁকে একটা অদ্ভূত কাজ দিয়েছেন। ঘুমের মধ্যে তিনি যদি কোনও কথা বলেন তাহলে সেসব যেন লিখে রাখা হয়। পরে হয়তো কোনও কাজ তিনি ভুলেও যেতে পারেন। মহাদেব দেশাই একদিন শুনলেন ঘুমের মধ্যেই গান্ধীজি সল্ট ট্যাক্স নিয়ে উত্তেজিত! আমেদাবাদে কিছুদিন বিশ্রামের পর মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী যখন বম্বে গেলেন ঠিক তখনই সরকারিভাবে প্রকাশ করা হল রাউলাট বিল। স্তম্ভিত গান্ধীজি। এ কেমন আইন! আমেদাবাদে একটা মিটিং ডাকলেন। সেই প্রথম একটি নতুন রকমের আন্দোলনের কথা বললেন। এরকম আন্দোলন তিনি দক্ষিণ আফ্রিকায় করেছেন। প্রচন্ড শক্ত। কিন্তু, তাঁর ধারণা এতে কাজ হয়। সেই মিটিংয়ে ছিলেন কয়েকজন যুব নেতা। বল্লভভাই প্যাটেল, সরোজিনী নাইডু। কিন্তু, এই আন্দোলনের প্রস্তাব যখন কানে গেল সেই সময় অ্যানি বেশান্ত আর লোকমান্য তিলকরা তেমন আগ্রহ দেখালেন না। বিশেষ করে তিলক অত্যন্ত চরমপন্থায় বিশ্বাসী। এরকম উপবাস, সারাদিন ধরে প্রার্থনা, অবস্থান করা এসব করে ব্রিটিশকে ভয় পাওয়ানা যায় নাকি? মহারাষ্ট্র, বেঙ্গল আর পাঞ্জাবে তখন যুব সমাজ চরমপন্থায় বিশ্বাসী। শিক্ষা দিতে হবে ব্রিটিশকে। ভয় দেখাতে হবে। এরকম সময় সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী একটি আন্দোলন? কিন্তু ধীরে হলেও তাঁরা নিমরাজি হয়ে গেলেন অন্যদের উৎসাহ দেখে। প্যাটেল যেমন খুব আগ্রহী। আর গান্ধীজি যখন এই বিশেষ আন্দোলনের প্রস্তাব নিয়ে এলাহাবাদে গিয়ে মতিলাল নেহরুর বাড়িতে উঠেছিলেন, তখন মতিলাল অতটা আগ্রহ না দেখালেও তাঁর যুবক পুত্রটি অত্যন্ত উত্তেজিত হয়ে পড়েছিল এটা শুনে। তাঁর নাম জওহরলাল। ইংল্যান্ডের কেমব্রিজে সায়েন্স পড়েছেন। তারপর হ্যারো থেকে পাশ করে এসেছেন আইনশিক্ষা। এলাহাবাদ বার বোর্ডে প্র্যাকটিস করেন। তবে, নিছক আইনব্যবসায় মন নেই। কিছু একটা করতে চান রাজনীতিতে। গান্ধীজির পছন্দ হয়ে গেল যুবকটিকে। জওহর ঝাঁপাতে রাজি। তবে, চুড়ান্তভাবে আন্দোলন শুরুর আগে একবার সরকারকে সুযোগ দিতে হবে। সেইমতোই গান্ধীজি ভাইসরয় লর্ড চেমসফোর্ডকে একটা চিঠি লিখে বললেন, রাউলাট রিপোর্ট প্রত্যাহার করুন। সরকার কিন্তু চলে শাসিত জনসাধারণের মনোবাসনা অনুযায়ী। এই দুদিন আগে দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে আসা লোকটিকে পাত্তাই দিলেন না লর্ড চেমসফোর্ড। তিনি উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন মনে করেননি। হাল ছাড়লেন না গান্ধীজি। তিনি নিজেই দিল্লি চলে এলেন দেখা করতে। ৫ মার্চ দেখা করলেন। এর আগে ভারতসচিব মন্টেগুর সঙ্গেও দেখা করতে এসেছিলেন গান্ধীজি। মন্টেগু কিন্তু তাঁর ডায়েরিতে লিখেছিলেন, লোকটা কুলিদের মতো পোশাক পরে বটে, কিন্তু কথাবার্তা শুনে আমি নিশ্চিত ইনি একজন সোশ্যাল রিফর্মার। ভারতবসীকে খুব ভালো করে চেনেন। একটা দীর্ঘমেয়াদী ভিশন আছে। মন্টেগু চেমসফোর্ডকে বলেওছিলেন। কিন্তু, চেমসফোর্ড গান্ধীজির সঙ্গে খুব ভালো করে কথাবার্তা বললেও, তাঁর অভিমত অগ্রাহ্য করলেন। অর্থাৎ রাউলটা আইন পাশ হবেই। এবং সত্যিই হয়ে গেল। মার্চ মাসে একটি বিল পাশ করে দিল হাউস অফ কমন্স। গান্ধীজি যখন বম্বেতে । সেখানে তিনি একটি আমন্ত্রণ পেলেন মাদ্রাজ যাওয়ার। আমন্ত্রণ পাঠিয়েছেন মাদ্রাজ হাইকোর্টের এক আইনজীবী। চক্রবর্তী রাজাগোপালাচারী। ভদ্রলোক বহুদিন ধরেই মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর একজন ফ্যান। সেই দক্ষিণ আফ্রিকায় তিনি নিয়মিত গান্ধীজীকে টাকা পাঠাতেন নানাবিধ আন্দোলনের ফান্ডে। এমনকী, গান্ধীজির অনেক লেখাও তিনি অনুবাদ করেছেন তামিলে। তাঁর আমন্ত্রণে মাদ্রাজ গেলেন গান্ধীজি। আর সেখানেই একাধিক সমাবেশ, সভার মধ্যেই ২৮ মার্চ ১৯১৯ সালে গান্ধীজি তামিলনাড়ুর তুতিকোরিন থেকে ঘোষণা করলেন, আগামী ৬ এপ্রিল দেশজুড়ে হবে আন্দোলন। রাউলাট আইনের প্রতিবাদে। সেদিন প্রত্যেক ভারতবাসী উপবাস করবেন। একইসঙ্গে সর্বত্র হবে বিক্ষোভ সমাবেশ। আন্দোলনের নাম কী? সত্যাগ্রহ! ভারতে সেই প্রথম শোনা গেল এরকম এক আন্দোলন!
আর ওই ঘোষণার সাতদিন আগে জলন্ধরে অস্থায়ীভাবে ব্রিটিশ আর্মির একজন ব্রিগেডিয়ার জেনারেলকে ট্রান্সফার করে আনা হয়েছিল। তাঁর নাম রেজিনাল্ড আব্রাহাম ডায়ার। জলন্ধরে হেডকোয়ার্টার হলেও তাঁর ব্রিগেড হল থার্ড লাহোর ডিভিশনের অঙ্গ। সেই ব্রিগেডের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ শহরের নাম অমৃতসর। গান্ধীজী ঠিক করলেন ৬ এপ্রিলের সত্যাগ্রহে তিনি থাকবেন বম্বে। ভোর সাড়ে ৬ টায় চৌপাট্টিতে তিনি পৌঁছনোর দু’তিন ঘন্টার মধ্যে দেড় লক্ষ মানুষের জমায়েত হয়ে গেল। হিন্দু মুসলিম, জৈন, পার্সি সকলেই। সেই প্রথম ভারত দেখল মাস মুভমেন্ট। গণআন্দোলন। পাটনায় সব দোকান বন্ধ রইল। কেউ অফিসে গেল না। বেঙ্গলে সর্বাত্মক। কলকাতা, ঢাকা, মেদিনীপুর, মুর্শিদাবাদ। সর্বত্র হরতাল। সফল এক সত্যাগ্রহ। দেশজুড়ে। এবার যেতে হবে পাঞ্জাব। ৮ এপ্রিল। দিল্লি থেকে ট্রেনে উঠলেন তিনি। কিন্তু, সরকার স্থির করল আর বাড়তে দেওয়া যায় না এই আন্দোলনকে। অতএব গান্ধীজিকে আটকাতেই হবে। কোশি কালান স্টেশনে ট্রেন পৌঁছতেই গান্ধীজিকে গ্রেপ্তার করা হল।
১৩ এপ্রিল ১৯১৯। অমৃতসরের স্বর্ণমন্দির লাগোয়া জালিয়ানওয়ালাবাগে বিকেল সাড়ে চারটের সময় একটি মিটিং চলছে। রামনবমীর সময় আসা কিছু মানুষ তখনও রয়ে গিয়েছেন। কেউ মিটিংয়ে এসেছেন। কেউ বা স্বর্ণমন্দির ঘুরে একটু বিশ্রাম নিচ্ছেন। অনেকে ঘুমিয়েও আছে সারাদিনের ক্লান্তি শেষে। প্রায় ২৫ হাজার মানুষ উপস্থিত। হঠাৎ ঝাঁকে ঝাঁকে বুটের শব্দ। কারা যেন ছুটে আসছে। সচকিত হয়ে সকলে তাকিয়ে দেখতে পেল উত্তরের একমাত্র এন্ট্রি পয়েন্ট গেট থেকে পুলিশ ঢুকছে। ডানদিকে গোর্খা ফোর্স। বাঁদিকে ফ্রন্টিয়ার ফোর্স। তারপর...।
অমৃতসর ১০০ বছর আগে
রামনবমীর মিছিল বেরিয়েছে অমৃতসরে। ৯ এপ্রিল ১৯১৯। শহরের সবথেকে সম্মানীয় দুই জাতীয়তাবাদী নেতা ডক্টর সত্যপাল এবং ডক্টর সইফুদ্দিন কিচলু। তাঁদের সকলেই খুব মান্য করে। হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের এই দুই নেতার যৌথ নেতৃত্ব এই শহরের যেন সাম্প্রদায়িক সৌভ্রাতৃত্বের প্রতীক। তার প্রতিফলন আজকের রামনবমীর সমাবেশেও। মুসলমানরা হাতে জল নিয়ে হিন্দুদের খাওয়াচ্ছেন। হিন্দুদের স্লোগানে গলা মেলাচ্ছেন মুসলমানরা। শান্তিপূর্ণ মিছিল। অমৃতসরের ডেপুটি কমিশনার মাইলস আরভিং। একটি ব্যাঙ্কের ব্যালকনিতে বসে বসে গোটা শোভাযাত্রাটা দেখছিলেন। অমৃতসরে ১ লক্ষ ৬০ হাজার জনবসতি। এই গোটা জনসংখ্যা যদি ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে তাহলে আর রক্ষা নেই। তাই লাহোর ডিভিশনাল অফিসে আরও বেশি করে সৈন্য পাঠাতে বলা হয়েছে। কিন্তু, তা পাঠানো হয়নি। বরং আশ্চর্য একটা প্ল্যান পাঠানো হয়েছে। সেটা হল এসবের নেতা ওই ডক্টর কিচলু আর ডক্টর সত্যপালকে ফাঁদে ফেলে গ্রেপ্তার করা হবে। সেইমতোই দুটি চিঠি পাঠানো হয়েছে তাঁদের কাছে। আরভিং এর বাড়িতে মিটিং। আর এসবের আড়ালেই রামবাগ, কেল্লা, হাতি গেটের মতো স্থানে পদাতিক আর অশ্বারোহী সেনা মোতয়েন করা হবে। যাতে কিচলু আর সত্যপালের গ্রেপ্তারির খবর ছড়াতেই যদি শহরজুড়ে বিক্ষোভ শুরু হয়ে যায় তাহলে চরমভাবে দমন করতে হবে। এই প্ল্যানটিও আর ডায়ারের। তিনি পাঞ্জাবের গভর্নর। মাইলস আরভিং এর বাড়িতে যেই কিচলু আর সত্যপাল একসঙ্গে ঢুকলেন তৎক্ষণাৎ পিছনের দরজা বন্ধ করে দেওয়া হল। তাঁদের গ্রেপ্তার করে আলাদা আলাদা দুটো জিপ তুলে সোজা শহরের বাইরে যাওয়ার জন্য স্টার্ট নিল। এক ঘন্টার মধ্যে সেই খবর ছডিয়ে পড়ল গোটা শহরে। সব দোকান বন্ধ। বাড়িঘর থেকে যুবক, পুরুষের দল পিলপিল করে রাস্তায় বেরিয়ে আসছেন। বেলা সাড়ে ১১ টার মধ্যেই হল বাজারের সামনে বিরাট সমাবেশ। যাওয়া হবে ডেপুটি কমিশনারের বাংলোর সামনে। রেলপুলের সামনে আসতেই হঠাৎ দুদিক থেকে দলে দলে পুলিশ সামনে এসে দাঁড়ালো। ছুটে এসেছেন মাইলস আরভিং আর শহরের অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার ক্যাপ্টেন ম্যাসি। আর এক পাও এগোবে না কেউ। গুলি চালানো হবে। যাও...যে যার বাড়ি ফিরে যাও....জনতা গর্জে উঠল। না। আমরা যাব না। আমাদের নেতাদের আগে মুক্তি দাও। এগিয়ে এল জনতার ভিড়। ফায়ার...একে একে গুলিতে লুটিয়ে পড়ছে সাধারণ নিরস্ত্র নিরীহ মানুষ...। মাইলস আরভিং আর ক্যাপ্টেন ম্যাসি অবশ্য ওয়েট করলেন না। গুলির অর্ডার দিয়ে তাঁরা ফিরে গেলেন লাঞ্চের টেবিলে।
বিকেল তিনটে। এত মৃত্যু, এই দমননীতি, এই পোকামাকড়ের মতো ব্যবহার মানবে না অমৃতসরবাসী। আরও মানুষ দলে দলে ছুটে এল। এবার পালটা হামলা। উপড়ে ফেলা হল রেললাইন। ছিঁড়ে ফেলা হল টেলিগ্রাফ তার। ওই তো সামনেই ন্যাশনাল ব্যাঙ্ক, চার্টার্ড ব্যাঙ্ক, অ্যালায়েন্স ব্যাঙ্ক। শোষণের প্রতীক। ইংরেজ মালিক। ইংরেজ কর্মচারী। আর ভারতীয়রা শুধুই তাচ্ছিল্যের শিকার। ধ্বংস করো ওই ব্যাঙ্ক। স্লোগান উঠলো। লাগানো হল আগুন। এরপর টাউন হল আর পোস্ট অফিস। ইতিমধ্যেই সেনাবাহিনী গুলি চালাচ্ছে। মানুষ রাস্তায় গুলিবিদ্ধ হয়ে ছটফট করছে। পালটা আক্রমণে ততক্ষণে চারজন ইংরেজ কর্মচারী নিহত। দুই ইংরেজ মহিলার উপর আক্রমণ হলেও তাঁরা প্রাণে বেঁচে যান। ব্রিটিশ সেনার গুলিতে কতজন মারা গেল? প্রায় ৫৫ জন। দেড়দিন ধরে এই যুদ্ধ চলল। ১০ এপ্রিল শান্ত হল শহর। কিন্তু, সেদিন সন্ধ্যায় আরভিংয়ের বাংলোয় মিটিং। গোপন। গোটা প্রশাসন উপস্থিত। স্থির হল এবার এমন শিক্ষা দিতে হবে যে শুধু অমৃতসর নয়। গোটা ভারতবাসী কেঁপে উঠবে। আর তার জন্য দরকার একজনকেই। ডায়ার।
১১ এপ্রিল। ব্রিগেডিয়ার জেনারেল রেজিনাল্ড ডায়ার এসে পৌঁছলেন অমৃতসর। ট্রেনে ওঠার আগে ছেলে আরভনকে আদর করে বললেন, হিন্দু আর মুসলিম ইউনাইটেড হয়েছে। বড়সড় কিছু ঘটবে। তুমি মায়ের কাছে থাকবে। এদিকে অমৃতসরে ডায়ারকে দেখে লাহোরের লেফটেন্যান্ট কর্নেল মরগ্যান বললেন, আমি তাহলে চলে যাচ্ছি। ডায়ার বললেন, না, আপনি থাকুন। আপনার ফোর্সকে আমার লাগতে পারে। ১২ এপ্রিল সব শান্ত। ডায়ার দুটি নির্দেশিকা শোনালেন শহরবাসীকে। নির্দিষ্ট অফিসারের অনুমতি ছাড়া কেউ শহর থেকে বাইরে যেতে পারবে না। কোনও হিংসাত্মক কাজ করলে আইনমাফিক ছত্রভঙ্গ করা হবে। সভা সমাবেশ সব বারণ। শহরে চিৎকার করে করে পড়ে শোনানো হল। দেওয়ালে লাগানো হল। অমৃতসরবাসী ক্ষোভে ফুঁসছেন। তাঁদের দুই নেতা এখনও উধাও। ব্রিটিশ লাগাতার অত্যাচার চালাচ্ছে। আর তাদের কথা মেনে চলতে হবে? একেবারেই নয়। রাত আটটার কারফিউ অমান্য করা হবে না। শোভাযাত্রাও হবে। কিন্তু, ১৩ এপ্রিল জালিয়ানওয়ালাবাগে মিটিং হবে। ডায়ার বললেন, মিটিং করতে আমি দেব না।
১৩ এপ্রিল। সকাল ৯ টা। জেনারেল ডায়ার শক্তিপ্রদর্শন করতে চাইলেন। রামবাগ থেকে একটি সেনাবাহিনীর মার্চ শুরু হল। সঙ্গে সাঁজোয়াবাহিনী। যেখানে মেশিনগান রয়েছে। দুপুর একটা পর্যন্ত চললো এই টহলদারি। সঙ্গে ড্রাম বাজাতে বাজাতে সতর্কবার্তা। কেউ বাইরে আসবেন না। আর ঠিক এই গোটা সেনাবাহিনীর পিছনেই দুজন অসমসাহসী মানুষ অনুরূপ একটি ড্রাম বাজাচ্ছিলেন আর চিৎকার করে বলছিলেন, আজ বিকেলে জালিয়ানওয়ালাবাগে সভা হবে। সভায় উপস্থিত থাকবেন সবাই। সেই মানুষদুটির নাম গুরান দিত্তা এবং বালো নামের এক মিষ্টির দোকানের মালিক। বৈশাখী। নববর্ষের দিন। চারদিকে একতলা দোতলা বাড়ি দিয়ে ঘেরা। নামেই বাগ। আসলে এবড়ো খেবড়ো একটা বড় জমি। সাঠেওয়ালা বাজার পার হয়ে একটাই সরু গলি। ঢোকার পথ। জালিয়ানওয়ালাবাগের সভায় প্রথম বক্তা শ্রী হংসরাজ। তিনি বললেন, আমরা আজ একটি প্রস্তাব গ্রহণ করব এখানে। রাউলাট আইন রদ করতে হবে। ১০ এপ্রিল যেভাবে নিরস্ত্র মানুষের উপর গুলি চালানো হয়েছে সেটি অন্যায় হয়েছে। সেপাই এসেছে সেপাই এসেছে! আচমকা গুঞ্জন। আতঙ্ক। শ্রী হংসরাজ বললেন, কিছু করবে না সেপাই। তোমরা চুপ করে বসে থাকো। আমরা অন্যায় করব না কিছু। কেউ আক্রমণও করব না সেপাইকে। তিনি নিজে সাদা রুমাল বের করে হাত উঁচু করে ছুটলেন সামনে। সেপাইদের দেখে নাড়াচ্ছেন। বোঝাচ্ছেন গুলি কোরো না। আমরা শান্তিপূর্ণ সমাবেশ করছি। কিন্তু, গুলির শব্দ হচ্ছে। গলা শোনা যাচ্ছে একটি লোকের। তিনিই জেনারেল ডায়ার। চিৎকার করে বললেন, আকাশে গুলি করছো কেন? টার্গেট করে মারো। মেজর ব্রিগসকে ডায়ার জিজ্ঞাসা করলেন, কোনদিকে বেশি ভিড়? ব্রিগস বললেন, ডানদিকে। ডায়ার বললেন, তাহলে ওইদিকে বেশি করে গুলি করো। অগভীর একটা কূপ ছিল। মানুষ প্রাণ বাঁচাতে সেই কূপে ঝাঁপ দিচ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই সেই কূপ পূর্ণ হয়ে গেল। প্রাচীর পেরোলেই তো বেঁচে যাব। তাই প্রাণভয়ে প্রাচীরে উঠছে মানুষ। আর তাদের পিঠ লক্ষ্য করে গুলি করার নির্দেশ দিলেন ডায়ার। প্রায় ১৫ মিনিট! বদ্ধ এক মৃত্যুপুরী! এক সময় শেষ হয়ে গেল গুলি। ডায়ার ঘাম মুছলেন মুখের। বললেন, অ্যাবাউট টার্ন। ফিরে গেল বাহিনী। ১ হাজার ৬৫০ রাউন্ড গুলি চলেছে। ৩৭৯ জন মৃত। ১২০০ জন আহত।
তদন্ত হল। হান্টার কমিটি তদন্ত করছে। উপস্থিত জেনারেল ডায়ার।
প্রশ্ন: গুলি চালানোর পর কী জনতা সরে যাচ্ছিল?
ডায়ার: হ্যাঁ, তারা সরে যাচ্ছিল।
প্রশ্ন: তারপরও কী গুলি চালিয়ে গেলেন?
ডায়ার: হ্যাঁ। গুলি না চালিয়েই ভিড় সরাতে পারতাম। কিন্তু সময় বেশি লাগতো।
ঠিক ১০০ বছর পর ১০ এপ্রিল ২০১৯ সালে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে সেদিন প্রধানমন্ত্রী টেরিজা মে বললেন, জালিয়ানওয়ালাবাগের ঘটনা দুঃখজনক অধ্যায়।
না। আমরা দুঃখপ্রকাশ চাই না। চাই সোজাসুজি ক্ষমা প্রার্থনা। ভারতবাসী হিসেবে একটাই দাবি— আন্তর্জাতিকস্তরে ভারতের কাছে ক্ষমা চাইতে হবে ব্রিটিশকে। স্পষ্ট করে বলতে চাই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। উই ডিমান্ড আনকন্ডিশনাল অ্যাপোলজি!!