বিদ্যার জন্য স্থান পরিবর্তন হতে পারে। গবেষণামূলক কাজে সাফল্য আসবে। কর্মপ্রার্থীরা কোনও শুভ সংবাদ পেতে ... বিশদ
আমাদের হাসি, আমাদের কান্না, আমাদের হরষ, আমাদের বিষাদ, আমাদের সুখ, আমাদের দুঃখ প্রভৃতি সকল বিরুদ্ধ ভাব ও অবস্থা লইয়া যে সামঞ্জস্য অখণ্ড-জীবন—সে অখণ্ড-জীবনে আমাদের একটিমাত্র সাধনা আছে, উহা মনুষ্যত্বের সাধনা। জীবনের সকল ছোট বড় খুঁটিনাটিটুকু পর্য্যন্ত লইয়া উহা পূর্ণতার পূর্ণাঙ্গ সাধনা। এই সাধনায় বিশ্বজগতের সকল কৃচ্ছ্র সংযুক্ত হইয়াছে এবং সকল কল্যাণ ইহার অনুসরণ করিয়াছে। সুখ-দুঃখের পুঁজি লইয়া বিশ্বেদেবতার পূজার নৈবেদ্য সাজাইতে গিয়া অবিমিশ্র আনন্দে অর্চ্চনা সমাপন করিয়াছে। শক্ত কথা বলিতেছি কি? তোমার কি বুঝিতে কষ্ট হইবে? কিন্তু বাছা, আমার যে মনের জমি জুড়িয়া কেবল শক্ত শক্ত মাটির ঢেলা ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত হইয়া রহিয়াছে, তাদের আমি নরম করিব কেমন করিয়া? মানুষ নিজে যে বড় শক্ত চীজ্; তার কথা ভাবিতে গেলে মনের নমনীয় বৃত্তিসমূহের প্রত্যেকটি মাংসপেশী যেন বিদ্যুতের চঞ্চলতায় শক্ত হইয়া উঠে। ভয়-ভাবনা ভুলিয়া তখন তাহারা রুদ্র-ভৈরবের তাণ্ডব নাচিতে চায়—দুর্ব্বলের মত শয্যাশায়ী থাকিয়া সাগু-বার্লির শ্রাদ্ধ করিয়াই ‘‘পৌরুষ প্রকাশ করিয়াছি’’, মনে করে না।
এই জন্যই ত’ মনুষ্যত্বের সাধনা প্রকৃতই বিঘ্ন-বহুল আবার বিঘ্ন-বহুল বলিয়াই যথার্থ সাধনা ভীতিরহিত; মানুষ হইতে যে চাহিয়াছে—একমাত্র আমিই বলিব তাহা নহে—সমগ্র জগতের ইতিহাসই বলিবে, ভয়ভীতি শঙ্কাসঙ্কোচকে সে পিপ্ড়ার জাঙ্গালের মত পায়ে দলিয়া মারিয়াছে। কারণ, তখন সে নির্দ্দিষ্টরূপে জানিয়াছে—সাধনের প্রেরণা যখন তাহার বিদ্যুন্ময়ী, মৃত্যু যদি তখন তাহাকে আলিঙ্গন-পাশে বদ্ধ করিয়াই ফেলে, তাহা হইলে মৃত্যুই গৌরবান্বিত হইবে, তাহার গৌরব বাড়িবে না। যে-মৃত্যু চিরদিন অলসের ঘৃতান্নসৃষ্ট দেহে ক্ষয়রূপে প্রবেশ করিয়া প্রাণটুকু হাতের মুঠায় অনায়াসে লইয়া বাহিরিয়া আসিয়াছে, যে-মৃত্যু ভয়ভীতের কম্পমান গ্রীবাদেশে উদয়াস্তকাল নির্ম্মম, নিষ্করুণ কুঠারাঘাত করিতেই অভ্যস্ত, সেই মৃত্যু নির্ভীক সাধকের কাছে আসিতেই অর্দ্ধচন্দ্র পাইয়া বিষণ্ণ বয়ানে ফিরিয়া যায়। যাঁহাদের সমর্থ হস্তের কঠোর স্পর্শ মৃত্যুকে বারবার ব্যাকুল-বিচলিত করিয়াছে, তাঁহারা যে দয়া করিয়া মৃত্যুর নাম রাখিবার ফন্দীতে কায়া পরিত্যাগ করিয়া থাকেন, ইহাতে মৃত্যুরই পরম সৌভাগ্য। শিবাজীকে রামদাস স্বামী সর্ব্বত্র গায়ের জোরে চালাইয়া মানুষ করিয়াছিলেন। শ্রীকৃষ্ণ অর্জ্জুনকে সম্পূর্ণ ইচ্ছার বিরুদ্ধে হত্যাসঙ্কুল যুদ্ধে উত্তেজিত করিয়াছিলেন, কিন্তু তিনি জানিতেন, যুদ্ধই এখানে মনুষ্যত্ব, দয়া এখানে কাপুরুষত্ব। অনেক চিন্তার পর যে পন্থা অবলম্বিত হইয়াছে, আজ ক্ষণিক অবসাদে তাহা ছাড়িয়া দিলে চলিবে না। আজ আমাদিগকে মানুষ হইতে হইলে নিজেদের ব্যক্তিগত জীবনের মধ্যে এক একটি করিয়া ভাবগত প্রতিষ্ঠান গড়িয়া তুলিতে হইবে। সকল নেতৃত্ব, সকল অহংবোধ, সকল কর্ত্তৃত্বাভিমান ভগবানের হাতে ছাড়িয়া দিয়া আমাদের দেহকে তাহার পবিত্র মন্দির, মনকে তাঁহার পায়ের নির্ম্মাল্য এবং আত্মাকে তাঁহার পাদপীঠ করিতে হইবে।
স্বামী স্বরূপানন্দ পরমহংসদেবের ‘আপনার জন’ থেকে