বিদ্যার জন্য স্থান পরিবর্তন হতে পারে। গবেষণামূলক কাজে সাফল্য আসবে। কর্মপ্রার্থীরা কোনও শুভ সংবাদ পেতে ... বিশদ
আচ্ছা, হৃদয়টাকে (হৃদপিণ্ড মানে হৃদয় ধরে নিয়ে) সত্যি সত্যিই কি কোথাও ফেলে আসা যায় না? যদি সত্যিই না যায়, কুমিরটা সেটা বিশ্বাস করল কী করে? উপকথার কুমিররা হয়তো বোকা হয়, তবে তার তথাকথিত বোকামিকে অনেক ক্ষেত্রেই আমার নেহাতই সরলতা বলে মনে হয়েছে। আর এত বড় বয়স্ক একটা কুমির জানে না যে হৃদয়খানা আদপে শরীরেরই এক অচ্ছেদ্য অঙ্গমাত্র! একটু বড় হতে হতে আমার নিজের সে সন্দেহটা কিন্তু দৃঢ় হয়েছে। আমরা আমাদের হৃদয়কে অনেক ক্ষেত্রেই হারিয়ে ফেলি, কখনও বা চুরি হয়ে যায় হৃদয়খানা। ওই কুমিরটার হৃদয়খানার খানিক অংশও নির্ঘাৎ বাঁধা পড়েছিল তার কুমিরনীর কাছে। তাই তো সে কুমিরনীর অন্যায় আবদারে বাঁদরের হৃদয় আনতে ছুটেছিল। আর কুমিরনীর হৃদয়ের একটা টুকরো সেই সুস্বাদু জামের জালে জড়িয়ে গিয়েছিল কি না, তা অবশ্য ভিন্ন প্রসঙ্গ। তবু, হৃদয় চুরি তো হতে পারে নানাভাবেই। কবি যতীন্দ্রমোহন বাগচীর 'জন্মভূমি' কবিতায় যেমন দেখেছি, ‘‘ঐটি আমার গ্রাম—আমার স্বর্গপুরী,/ ঐখানেতে হৃদয় আমার গেছে চুরি!”
হৃদয় চুরির প্রসঙ্গ নিয়ে এত আলোচনা কেন, তা এবার একটু খোলসা করা যাক। নাগপুরের এক পুলিস স্টেশনের এক চমকপ্রদ ঘটনা সর্বভারতীয় খবরে এসেছে সম্প্রতি। এক তরুণ থানায় ঢুকে অভিযোগ জানায় যে তার হৃদয় গিয়েছে চুরি। তার অভিযোগ একটি মেয়ের প্রতি, যে নাকি চুরি করেছে তার হৃদয়খানা। পুলিসের কাছে তার আবেদন, চুরি যাওয়া তার হৃদয়টা খুঁজে দেবার জন্যে। চুরি যাওয়া জিনিসের তালিকা-সহ অনেক অভিযোগ পেয়েছে পুলিসরা। কিন্তু এমন অভিযোগ যে কস্মিনকালেও পায়নি, সে কথা বলাই বাহুল্য। স্বভাবতই নাগপুরের থানার এই পুলিসকর্মীরা যোগাযোগ করে তাদের উপরওয়ালার সঙ্গে। তারপর নিজেদের মধ্যে বিস্তর আলোচনা করে তারা ঠিক করে যে, ভারতের আইনের কোনও ধারাতেই এমন অভিযোগের অবকাশ নেই। তারা তাদের অক্ষমতার কথা জানিয়ে দেয় তরুণটিকে। ব্যস।
ঘটনাটি ছোট্ট। আমি কিন্তু এ বিষয়ে আমার কল্পনা বিলাসিতার লাটাইয়ের সুতো একটু ছাড়তে চাই। বিষয়টি নিয়ে একটু ভেবে দেখা যেতে পারে অবশ্যই। সর্বভারতীয় মিডিয়াতে প্রকাশিত খবর অনুসারে পুলিস জানিয়েছে, এমন অভিযোগের কোন অবকাশ নেই। তাই হৃদয় চুরি যেতে পারে না, এমন কথা কিন্তু বলা হয়নি একবারও।
বলা হবেই-বা কী করে? যুগ যুগ ধরে হৃদয়খানা চুরি গিয়েছে বলেই তো গড়ে উঠেছে মহৎ শিল্প, যুগোত্তীর্ণ সাহিত্য। সামাজিক, অর্থনৈতিক শ্রেণীভেদ না মেনেই। কোনও নগরনটীকে হৃদয় দিয়ে ফেলেন নৃপতি। এক নগণ্য নটীর প্রেমে হাবুডুবু খায় বৌদ্ধ সন্ন্যাসী। চুরি যাওয়া হৃদয়খানার সঙ্গে বিরহের তীর্থগামী ভাষা মিলিয়েই তো গড়ে ওঠে আষাঢ়ের প্রথম দিনের গান! রোমিও-জুলিয়েট, লায়লা-মজনু, সেলিম-আনারকলির গল্প তো ইতিহাস আর ভূগোলের গণ্ডি পার করে ফেলে। তবে কে যে কার হৃদয় চুরি করেছিল—রোমিও জুলিয়েটের, নাকি জুলিয়েট রোমিওর, না দুজনে দুজনের—বলা কঠিন বইকি। প্যারিস আর হেলেনের প্রেম ধ্বংস করে দিল ট্রয়। তার কতটা হৃদয়ের সত্যিকারের চুরি যাওয়া, আর কতটা সেই চুরির বিলাসিতা মাত্র, তা বলা কঠিন। তাজমহল তো সম্রাট কবির হৃদয়ের ছবি বলেই জানিয়েছেন রবি ঠাকুর। সম্রাট তাঁর যে হৃদয়ের ছবিকে অমর করে রাখতে চেয়েছেন, তাকে কি সত্যিই চুরি করতে পেরেছিলেন মমতাজ? দেসদোমিনা কি চুরি করতে পেরেছিল ভেনিসের মুরের হৃদয়?
শাহরুখ খান অভিনীত হিন্দি ছবি ‘অঞ্জাম’-এর কথা মনে পড়তে পারে। তাতে ছিল একটি জনপ্রিয় গান—‘‘বড়ি মুশকিল হ্যায়, খোয়া মেরা দিল হ্যায়...যাকে কঁহা মে রপট লিখাউ কোই বাতলায়ে না!’’ নাগপুরের যুবকটি সেই কাজেই তবে পৌঁছেছে পুলিস স্টেশনে। নাগপুরের এই ছোট্ট ঘটনাটার সূত্র ধরে তবে কি আইন-কানুন বদলাতে হবে? হৃদয় চুরির অভিযোগ পেলেই ‘ধরে আন চোর’ বলে ছুটবে পাইক বরকন্দাজ? আচ্ছা, তাহলে এমন অভিযোগের বন্যা বয়ে যাবে নাতো? সমস্ত পুলিস স্টেশনে। কেউ এসে বলল, পাশের বাড়ির ‘খেঁদি’ তার হৃদয় চুরি করেছে। তাকে হয়তো তখন প্রশ্ন করা হতে পারে, কত শতাংশ হৃদয় চুরি গিয়েছে। হয়তো পুরোটা হৃদয়, হয়তো আধখানা, কখনও-বা এক টুকরো। অভিযোগটা জটিল হয়ে উঠবে যদি হৃদয়ের খানিকটা ‘খেঁদি’, খানিকটা ‘বুঁচকি’, আর কিছুটা ‘সোনা’ চুরি করে নেয়। অভিযোগগুলো উল্টোদিক থেকেও আসতে পারে। ‘খেঁদি’ এসে ‘খোকন’ বা ‘দুলাল’-এর বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ জানাতে পারে। পুলিস স্টেশনগুলিতে কি তবে ঢাকঢোল পিটিয়ে হার্ট ডিপার্টমেন্ট খোলা হবে? তাতে থাকবে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত অফিসাররা। হৃদয়ের চুরি এবং চোর ধরায় বিশেষ ট্রেনিং পাওয়া। আচ্ছা, সোশ্যাল মিডিয়ায় অদেখা বন্ধু বা বন্ধুনী হৃদয় চুরি করলে কী হবে, সেটাও ঠিক করতে হবে বইকি। ভার্চুয়াল মাধ্যমে হৃদয় চুরি গেলে সেটা চুরি নয়, তেমনটা তো নয়। (আগেকার যুগ হলে না হয় টেলিফোনের ক্রস কানেকশনের ফলে হৃদয় চুরির বিষয়টাকেও হিসেবে রাখতে হতো।) আবার, এমনটাও তো সম্ভব যে, হৃদয় যে চুরি করেছে সে জানেই না যে সে চোর। কানু যে ঠিক কত গোপিনীর মন চুরি করেছে, কানু নিজেই কি তা জানত? তাই হৃদয় চুরিকে পেনাল কোডে ঢোকাতে গেলে বিস্তর সমস্যা রয়েছে বইকি। তাহলে উপায়? আচ্ছা, পুলিস ফোর্স কি তবে চুরি-ডাকাতি-রাহাজানি, খুন-জখম, রাজনৈতিক ঝগড়া-ঝঞ্ঝাট, ইত্যাদি আইনশৃঙ্খলার অন্যান্য বিষয় না দেখে শেষে মন-দেওয়া-নেওয়ার কীর্তন গাইতে বসবে?
আচ্ছা, তাও নাহয় হল। পুলিস নাহয় শকুন্তলার অভিযোগটা নিল—দুষ্মন্ত তাঁর হৃদয় চুরি করে ফিরে গিয়ে বেমালুম ভুলে গিয়েছে বলে। অর্থাৎ হৃদয় চুরিটা ঠিক অপরাধ নয়, চুরি করে পালানো কিংবা ভুলে যাওয়াটাই কিন্তু এক্ষেত্রে আসল অপরাধ। আপাতদৃষ্টিতে যেমন নাগপুরের যুবকটির অভিযোগ তার হৃদয় চুরি গিয়েছে বলে নয়, চুরি করে চোর পালিয়েছে বলে। কোনও এক দুষ্মন্ত যদি শকুন্তলার হৃদয়খানা চুরি করেই ফেলে, তারপর তাকে তার ক্ষতিপূরণ পেতে কতটা পরিশ্রম করতে হয়, সে গল্প বলতে মহাকবিকে একখানা আস্ত কাব্যই লিখে ফেলতে হল। তাই প্রতিকারটা খুব সহজ হয়তো নয়। পুলিস চোর ধরে আনতে পারলেও ঠিক কী করে চুরি যাওয়া হৃদয়খানা ফেরত দেবার ব্যবস্থা করবে, সেটা সহজবোধ্য নয়।
বিষয়টা মজার হতে পারে। হতে পারে শিল্পীতও। দাঁড়ান, দাঁড়ান, আগে নাহয় দেখা যাক সত্যি সত্যিই হৃদয় চুরি হয়েছে কি না। এত বড় দুনিয়াতে, সহস্র সহস্র বছর ধরে সত্যিকারের হৃদয় চুরির ক’টা ঘটনা ঘটেছে? তাই এই সিদ্ধান্ত করাটাও সহজ নয় নিঃসন্দেহে। দক্ষ হৃদয় বিশেষজ্ঞদের কাজ। এ-কাজ করার জন্যে তৈরি হয়ে যেতে পারে নতুন ধরনের প্রফেশনাল হার্ট স্পেশালিস্টরা। তবে সিদ্ধান্তটা কোনওভাবে ঠিকঠাক নিতে পারলে হয়তো দেখা যাবে যে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই হৃদয় চুরি মরীচিকার মতো ভ্রম মাত্র। তাই পুলিসের এই চুরি যাওয়া হৃদয় খোঁজার কাজটাও কিন্তু হয়ে যেতে পারে বিরল ব্যতিক্রমী কাজ—কোটিতে গুটিক মাত্র।
আচ্ছা, অমিত রায়ের হৃদয় কি লাবণ্য চুরি করেই নিয়েছিল? নাকি অমিত নিজেই উজাড় করে লাবণ্যকে দিতে চেয়েছে নিজের হৃদয় উৎসারিত কথকতা আর কল-কাকলি? লাবণ্যকে হৃদয় দিয়ে অমিতের হৃদয়ের কি সমৃদ্ধি ঘটে না? তার পরিধিও কি ব্যাপ্ত হয় না কুঁজো থেকে দিঘিতে? তবে কিনা অমিতের পরিণতি তো পরিণত রবীন্দ্রনাথের উপলব্ধি। সাধারণ জনতার পক্ষে তার তল খুঁজে পাওয়া দুষ্কর বইকি। গ্রহণ করার সঙ্গে যে ঋণী করে ফেলা যায়, সে তো এক গভীর স্নিগ্ধ অনুভূতি।
ভেবে দেখি যে, হৃদয় চুরি হলে সেটাই কি লাবণ্যে প্রাণের পূর্ণ হয়ে ওঠা নয়? আমার হৃদয়ের এমনকী একটা টুকরোও কেউ চুরি করতে পারলে, সেটা শুধু তার নয়, আমারও যে মহত্তম সাফল্য। নিঃসন্দেহে। চুরি যাওয়া হৃদয়ের টুকরোর সঙ্গে সঙ্গে সে চোরেকে যে অনায়াসে দিয়ে ফেলতে পারি এক পৃথিবী।