বিদ্যার জন্য স্থান পরিবর্তন হতে পারে। গবেষণামূলক কাজে সাফল্য আসবে। কর্মপ্রার্থীরা কোনও শুভ সংবাদ পেতে ... বিশদ
শহর সত্যিই বড়সড় একটা জটিল ব্যাপার। সেখানে থাকবে পরিবেশ, জীবিকা, আবাসন, পরিবহণ, নিরাপত্তা, নাগরিক স্বাচ্ছন্দ্য এবং বিনোদনের এক সুচারু আয়োজন। এর কোনও একটি বিষয়ের ব্যবস্থাপনা দুর্বল হলে তা সহজেই অন্যান্য ক্ষেত্রগুলিকে প্রভাবিত করে। গাড়ি বা প্লেন চালানোর মতো বাইরে থেকে চাপানো কোনও ব্যবস্থা দিয়ে সুশাসনের ব্যাপারটা ওপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া যায় না। মানবিক সম্পর্কনির্ভর এই ব্যবস্থাটা বেড়ে ওঠে ভেতর থেকে। তাকে শুধু বেড়ে ওঠার সেই পরিসরটুকু দিতে হয়। সুশাসন মানে আধুনিক পরিষেবার সঙ্গে সেখানে বসবাসকারী বা যাতায়াত করা মানুষের সমন্বয় সাধন। এটা না করা গেলে তাঁরা সেই সুযোগ নিতে পারবেন না।
কিন্তু আমরা দেখছি স্মার্ট সিটি বলে বিজ্ঞাপিত দেশের বহু শহরেই সে কাজটা এখনও সেভাবে হচ্ছে না। এর প্রধান কারণ প্রযুক্তির কল্যাণে শহরটি ঝাঁ-চকচকে হয়ে উঠলেও সেখানে এমনকী ন্যূনতম নাগরিক পরিষেবারও অভাব থেকে গেছে। আধুনিকীকরণ সেখানে আটকে গেছে গ্যাজেটে, তা মানবিক স্পর্শ পায়নি। রাত-বিরেতে অসুস্থ হলে সে শহরে বাড়ি থেকে হাসপাতালে পৌঁছানো কঠিন, অ্যাপ নির্ভর ক্যাব ছাড়া সেখানে নিকট দূরত্বে যাওয়াও সম্ভব নয়। সুশাসন মানে কিন্তু প্রযুক্তির সঙ্গে মানবিক পরিষেবার ধারাবাহিক সমন্বয় সাধন। এটা কোনওভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়লে তা সামলে উঠতে অনেক বেশি সময় লাগে। সেই বিপর্যয় সামাল দেওয়া কঠিন, সময় সময় অসম্ভবও বটে। নীতি আয়োগ সম্প্রতি স্মার্ট সিটি’র চেহারা-চরিত্রের যে ধারণা দিয়েছে সেখানে জোর দেওয়া হয়েছে নিরাপত্তা, মানুষের পারস্পরিক সম্পর্ক ও মেলামেশা, ব্যক্তিগত গোপনীয়তা, জরুরি নাগরিক পরিষেবা ইত্যাদি ক্ষেত্রের ওপর। কিন্তু অভিজ্ঞতায় আমরা দেখছি দেশের প্রায় প্রতিটি স্মার্ট সিটিতেই এ ব্যাপারে অনেক সমস্যা রয়ে গেছে। শুধু সিসি টিভি, হেল্পডেস্ক, পুলিস কিয়স্ক এই সমস্যার সমাধান করতে পারবে না।
বাড়ির কাছেই স্মার্ট সিটিতে সন্ধ্যা সাতটার পর বাড়ি চেনার জন্য ঠিকানা জিজ্ঞাসা করার কোনও লোক খুঁজে পাওয়া যায় না। শহর মানে তো শুধু তার বাসিন্দা নয়, সেখানে নানা সূত্রে যাতায়াত ও কাজ করা মানুষজনও। নিজের অভিজ্ঞতায় দেখেছি সেখানে পরিচারক থেকে শুরু করে মিস্ত্রি ও অন্যান্য পরিষেবা ক্ষেত্রের কর্মীরা হঠাৎ অসুস্থ হলে উচ্চকোটির গুটিকতক হাসপাতাল ছাড়া অন্যত্র চিকিৎসার জন্য ভর্তি হতে পারে না। হোম ডেলিভারি বা রুম সার্ভিস আছে, কিন্তু তা চাহিদা ও প্রয়োজনের তুলনায় কম। যে নির্মাণ কর্মীরা এ শহরগুলি গড়ে তুলেছেন, যাঁরা নিরাপত্তা দিচ্ছেন, যাঁরা সেখানকার মানুষদের নানা পরিষেবা দেন তাঁরা নিজেরা আপদ-বিপদে কোথায় যাবেন সে ব্যাপারে একটা বিরাট সমস্যা থেকে যাচ্ছে। অনেকে বলেন, জনবসতি বাড়লে লোকজন বেশি বাস করতে শুরু করলে এসব সমস্যার সমাধান হবে। কিন্তু প্রশ্ন হল, স্মার্ট সিটিতে কখনওই পুরনো শহরগুলির মতো ঘন জনবসতি গড়ে উঠবে না। আর এই সমস্যাগুলির সমাধান জনসংখ্যার ওপর নির্ভর করে না, এটা পরিষেবাগত সমস্যা। পরিষেবা প্রদানকারীদের জন্য এলাকাভিত্তিক নির্দিষ্ট কোনও ব্যবস্থা গ্রহণের মধ্যে দিয়েই এই সমস্যা সমাধান করা যায়। এটা মানবিক সমস্যা, শুধু প্রযুক্তি নয়, মানবিক ব্যবস্থার মাধ্যমেই এই সমস্যার সমাধান করতে হবে।
আজ থেকে প্রায় বছর পাঁচেক আগে মোদি সরকার ক্ষমতায় আসার পর স্মার্ট সিটি প্রকল্পের সূচনা। আগে আমরা শুনতাম স্মার্ট ছেলে বা স্মার্ট মেয়ে, তারপর শুনলাম স্মার্ট সিটি। প্রযুক্তি দুনিয়াদারির খোলনলচে বদলে দেবে বলে যাঁদের অগাধ বিশ্বাস তাঁরা এতে পুলকিত হলেন। কিন্তু গত কয়েক বছরের অভিজ্ঞতায় আমরা দেখেছি ভুল দৃষ্টিভঙ্গি ও অপব্যবহারের কারণে প্রযুক্তি আমাদের সামাজিক কাঠামোয় মৌলিক কোনও পরিবর্তন আনতে পারেনি, বরং তা নিয়ে আমাদের ভুল প্রত্যাশা সমস্যা আরও বাড়িয়েছে। এটা দু’ভাবে ঘটেছে, এক, আমরা সব সমস্যার সমাধান শুধু প্রযুক্তিতেই খুঁজছি। শহরে চুরি-ডাকাতি বাড়ছে। আমরা আওয়াজ তুললাম, সিসি ক্যামেরা লাও, নিরাপত্তাহীনতার সমাধান যে শুধু গ্যাজেটে নয়, মানুষে মানুষে সম্পর্কে আছে, একসঙ্গে মিলেমিশে থাকার মধ্যে আছে, এভাবে দেখার চোখটাই নষ্ট
হয়ে যাচ্ছে আমাদের। দুই, আমরা সাধারণ মানুষকে তা ব্যবহারের উপযুক্ত করে তুলছি না। আসলে গলদটা রয়েছে আমাদের ভাবনার গোড়াতেই। নীতি আয়োগ বলছে, স্মার্ট সিটি হচ্ছে নগরজীবনের রূপান্তর ও আধুনিকীকরণ। একই সঙ্গে তারা সতর্ক করে দিয়েছে এখানে বসবাসকারী নাগরিকদের কাছে সুযোগ-সুবিধা পৌঁছে দেওয়া ও গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে তা পাওয়ার ব্যবস্থা নিশ্চিত না করা গেলে অর্থাৎ সুশাসন না থাকলে স্মার্ট কথাটার কোনও অর্থই থাকবে না।
ডিজিটাল সাক্ষরতাবিহীন মানুষের কাছে স্মার্ট রোডস, স্মার্ট কম্যান্ড, স্মার্ট কন্ট্রোল সেন্টার, স্মার্ট পার্কস এসব কথা হিব্রুর মতো শোনায়। সুশাসনের সঙ্গে স্মার্টনেসের কোনও সমন্বয় না থাকায় স্মার্ট সিটিতে ডিজিটাল সাক্ষরতাহীন মানুষ দিশেহারা হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এই শহরে তাদের বাস করার প্রাথমিক আয়োজনটুকু না করা গেলে শহরগুলি কিন্তু স্বার্থপর দৈত্যের বাগান হয়ে থাকবে।