বিদ্যার জন্য স্থান পরিবর্তন হতে পারে। গবেষণামূলক কাজে সাফল্য আসবে। কর্মপ্রার্থীরা কোনও শুভ সংবাদ পেতে ... বিশদ
প্রথমত, এই ভোট অন অ্যাকাউন্ট থেকেই মোদিকে বোঝাতে হবে যে তিনি নিজের ইচ্ছে মতো আর অর্থনীতি চালাতে চান না, তাঁকে যাঁরা ক্ষমতায় আনছেন শুধু তাঁদের প্রতি তিনি দায়বদ্ধ নন। দেশের সকল শ্রেণীর মানুষকে ভুলে যাবেন না তিনি। গত পাঁচ বছর ধরে নরেন্দ্র মোদির ব্যক্তিগত হস্তক্ষেপে অর্থমন্ত্রী জেটলির সিদ্ধান্তও অর্থ মন্ত্রকের রিপোর্ট বা রিজার্ভ ব্যাঙ্কের সুপারিশ অগ্রাহ্য করে দেশের অর্থনীতিকে ত্রিমুখী ভাবনায় পরিচালিত করেছেন। এক, নোট বাতিলের মত হঠকারী সিদ্ধান্ত নিয়ে এবং অপ্রস্তুত অবস্থায় জিএসটি চালু করে রাতারাতি অর্থনীতির খোল নলচে বদলের চেষ্টা করেছেন, যা সর্বস্তরে একটি জোর ধাক্কা দিয়ে অর্থনীতির বৃদ্ধি কমিয়ে দিয়েছে। দ্বিতীয়ত, দেশের ক্ষুদ্র, মাঝারি, এমনকী বৃহৎশিল্প চাঙ্গা করতে ব্যর্থ হয়ে কেবলমাত্র আম্বানি-আদনি-পেটিএম-এর মতো কিছু নির্দিষ্ট দেশি-বিদেশি পুঁজিনির্ভর লগ্নির নামে দেশের অর্থে পছন্দের শিল্পপতির বিকাশ ঘটিয়েছেন,তার জন্য ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থায় রিজার্ভ ব্যাঙ্কের উপর নিয়ন্ত্রণ চাপিয়ে তাদের রিজার্ভ অর্থে দেউলিয়া পুঁজির ক্ষত মেরামত করার চেষ্টা করছেন। তাতে যে দেশের ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থা আরও দুর্বল হবে, বিপন্ন হবে আম জনতা, সেটা জেনেও তিনি তা-ই করতে চেয়েছেন। ক্ষমতায় মোদি সরকার ফিরলে যে দেশের আপামর জনতা শুধু এই কারণেই চোখে সর্ষে ফুল দেখবে, নির্বাচনের ময়দানেও সেটা মোদিজির পক্ষে অশনিসংকেত হিসেবেই স্পষ্ট। তৃতীয়ত, দেশের স্বয়ম্ভর খাদ্য উৎপাদন ব্যবস্থার বদলে কৃষি অর্থনীতিকে পশ্চিমি বাজারমুখী উন্নয়নের ভাবনায় ঢেলে সাজাতে চাইছেন। তাতে ক্ষুদ্র চাষিদের লাঙ্গল ছেড়ে মাল্টি ন্যাশনাল ফুড কর্পোরেটদের কাছে নিজের জমি লিজ দিয়ে সেই জমিতেই চাষ করতে হবে। দেশের কৃষি সমস্যা না মিটিয়ে বাজেটে কৃষি বরাদ্দ বাড়িয়ে বৃহৎ পুঁজির এগ্রি-কর্পোরেট ভেঞ্চারগুলির স্বার্থে বরাদ্দ হচ্ছে কৃষি ও গ্রামীণ বিকাশের নামে। সেটি বুঝে গিয়েছে দেশের কৃষক শ্রেণী। এমনকী, বিজেপি অনুমোদিত কৃষক সংগঠনগুলিও তাই গত দু’বছর মোদি সরকার বিরোধী আন্দোলনে। বস্তুত, কৃষি ও সাধারণ কৃষকের কল্যাণে মোদি সরকারের বাজেটে বিশেষ কিছু থাকে না, যা কিছু থাকে তা কৃষি পণ্যের বিপণন, কৃষি বাণিজ্যকরণ, কৃষিক্ষেত্রের ভর্তুকি ও সুযোগ-সুবিধা যার সিংহভাগ পায় বৃহৎ চাষিদের একাংশ। কৃষি মন্ত্রকের সরকারি তথ্য বলছে, মোদির চার বছরে কৃষিঋণের বেশিরভাগ অর্থ জমা হয়েছে মাত্র ৬৭০টি অ্যাকাউন্টে। ভাবুন, এই হল বাজেটের বাস্তব-দর্শন! স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী বলছেন, ছোট কৃষকরা চাষের খরচ তুলতে না-পারলে ফসল ফলায় যেসব কোম্পানি তাদের কাছে জমি দিয়ে দিক, তাদের কাছে কাজ করুক! এই প্রধানমন্ত্রীর শেষ বাজেটে কৃষকের আয় দ্বিগুণের প্রতিশ্রুতি দিয়ে যদি লক্ষ কোটি টাকাও ক্ষুদ্র কৃষকের জন্য বরাদ্দ হয়, তাকে নির্বাচনী চমক ছাড়া আর কীই-বা ভাবা যেতে পারে? সারা ভারতকে আধপেটা খাইয়ে শুধু ৪০কোটি উচ্চ আয়ের বাজার ধরার বাজেট না-করে যদি প্রকৃত একটি জনস্বার্থের বাজেট হয়, তাতে সব পক্ষেরই মঙ্গল।
ঘটনা যা-ই হোক, মোদিকে ক্ষমতায় ফেরার জন্য একটা স্থায়ী ও স্থির সিদ্ধান্তে আসতে হবে। কোনও দেশ, অর্থনীতি বা দেশের মানুষের কল্যাণ কোনওদিন দুমদাম সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বিনা প্রস্তুতিতে তা কার্যকর করার জন্য ঘোষণার মধ্যে দিয়ে হতে পারে না। এবারে ভোট অন অ্যাকাউন্টে মোদিকে বোঝাতে হবে যে তিনি রাজনৈতিক প্রয়োজনে অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন না, অর্থনীতির প্রয়োজন বুঝলেই বরং তো সকলের পক্ষে মঙ্গল, নইলে বাজেটে ঘোষিত হলেই যে কার্যকর হয় না তার দৃষ্টান্ত অজস্র। নির্বাচনের বছরে বাজেট পেশ করতে গিয়ে মোদিজি যেন গতবারের মতো বিদেশ থেকে কালো টাকা উদ্ধার করে প্রত্যেক নাগরিকের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে ১৫ লাখ করে দেওয়ার মতো প্রতিশ্রুতি না দেন, তাতে মোদিজির বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়েই প্রশ্ন ওঠে।
এবারের বাজেটে মোদিজি মানুষের জন্য অনেক জনহিতকর প্রতিশ্রুতি দেওয়ার মতো অনুকূল অবস্থায় আছেন। গত চারবছরে মোদি জমানার সব চাইতে বিতর্কিত যে নোট বাতিল কাণ্ড, তা পরোক্ষে রাজকোষের অভূতপূর্ব উন্নতি ঘটিয়েছে। গত চারবছরে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে আয়কর সংগ্রহ বেড়েছে ৪০ শতাংশ, এবং এর ফলে রাজকোষ ঘাটতি কমানোয় দারুণভাবে সাফল্য এসেছে। এই বিষয়টিকে যে ‘ট্যাক্স টু জিডিপি’ অনুপাতের হিসেবে বিবেচনা করা হয়, তাতে ৫৬% উন্নতি হয়েছে। এর ফলে বাজেট ঘাটতি রয়েছে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী জিডিপি সাড়ে তিন শতাংশের মধ্যেই। ফলে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে। এতে লগ্নির পরিবেশ অনুকূল, তার উপর আশানুরূপ বিদেশি লগ্নি আসছে, বিদেশে তেলের দাম বা টাকার দামে ক্ষেত্রে চাপ থাকলেও চলতি খাতের ভারসাম্য লগ্নি ও বিদেশি মুদ্রা আগমনের নিরিখে সন্তোষজনক। সব মিলিয়ে এখন কোষাগারীয় পরিস্থিতি অনুকূলে। এই অবস্থায় তাই যে-কোনও সরকার চাইলে আম জনতার জন্য কিছু ভালো প্রস্তাব রাখতেই পারে, এটাই স্বাভাবিক প্রত্যাশা। অরুণ জেটলির অসুস্থতায় এখন বাজেট পেশ করতে এসে সকল মহলের জন্য কতখানি দায় ও ঝুঁকি নিতে পারেন পীযূষ গোয়েল, সেটাই দেখার।
অন্তর্বর্তী হলেও এই বাজেটেই সত্যিই কিছু করতে হবে মোদি সরকারকে, এমন বিষয়টা রাজনৈতিক নয় শুধু, অর্থনৈতিক বাধ্যবাধকতাও রয়েছে। দেশের বৃদ্ধির হার ৭ শতাংশের উপরে হলেও ‘জব লেস গ্রোথ’। কর্মসংস্থান বাড়ছে না আশানুরূপ হারে, এটাই মোদির সামনে সব থেকে বড় চ্যালেঞ্জ। ভোটের রায়ে ক্ষমতায় যেই আসুক, আগে দেশ ও জনতার স্বার্থে কর্মসংস্থান সমস্যার গুরুত্ব অগ্রাধিকার দিয়ে মোকাবিলা করতে হবে। এই বাজেটে তাই পরিকাঠামো, হাউজিং, রিয়াল এস্টেটে বাজেট বরাদ্দ বাড়াতে হবে। কর্মসংস্থান বাড়াতে হলে ‘স্টার্ট আপ বিজনেসে’ কর ছাড় দিতে হবে, মাঝারি ও ক্ষুদ্র শিল্পের বাজার ফিরিয়ে দিতে হবে চীনাপণ্যের সঙ্গে লড়াইয়ে, তার জন্য মাশুল সংস্কার করতে হবে, জিএসটি কমানো খুব জরুরি, নইলে দেশের বাজার আরো নিয়ে নেবে চীনারা। দেশ কখনও বিদেশি লগ্নির উপর চলতে পারে না, দেশীয় পুঁজিকে শক্তিশালী করে দেশের বাজার তাদের হাতে রাখাটা খুব জরুরি। ব্যাঙ্কিং ও কর সংস্কারের লক্ষ্য হওয়া উচিত সেটাই। কিন্তু হচ্ছে উল্টো। ফলে সীমিত ও নির্দিষ্ট কিছু কর্পোরেটের বাইরে দেশীয় শিল্পের বিকাশ শ্লথ।
এই বাজেটে সাধারণ আম জনতার জন্য আশা করা যায় করমুক্ত আয়ের ঊর্ধ্বসীমা আরও বাড়িয়ে তিন লাখ করা হবে। তাতে অর্থনীতির লাভ, কিছুটা হলেও চাহিদা বাড়িয়ে বৃদ্ধির হার ত্বরান্বিত হবে। বৃদ্ধির হার আরও ২ শতাংশ বাড়াতে গেলে অবিলম্বে চাই একটি গ্রামীণ বিকাশভিত্তিক সত্যিকারের গণমুখী বাজেট, যাতে সাধারণের ক্রয় ক্ষমতা বাড়ে, কৃষকের আয় বাড়ে, ক্ষুদ্র ও মাঝরি শিল্পের বাজার বাড়ে, চাকরির পাশাপাশি লগ্নির পরিবেশ চাঙ্গা হয়। এইসব একটি অন্তর্বর্তী বাজেটের কাজ নয়, কিন্তু এই লক্ষ্যেই আগামী দিনের পদক্ষেপের জন্য এবারের অন্তর্বর্তী বাজেট সাজাতে হবে, সেটাই চ্যালেঞ্জ। নইলে জবাবদিহির দায় এড়ানো কঠিন হবে ভোটের বছরেই।