বিদ্যার জন্য স্থান পরিবর্তন হতে পারে। গবেষণামূলক কাজে সাফল্য আসবে। কর্মপ্রার্থীরা কোনও শুভ সংবাদ পেতে ... বিশদ
শুধু মধ্যবিত্ত কেন, কৃষক শ্রমিক? তাঁরাও তো তাঁদের উন্নয়ন সুরক্ষায় বাজেটে অর্থবরাদ্দের বন্যা দেখে নিশ্চয় ‘অভিভূত’। তবে, সরাসরি কৃষিঋণ মকুবের ঘোষণা তেমনভাবে দেখা গেল না বাজেটে। না থাকারই কথা। ওটা যে রাহুল গান্ধী হাইজ্যাক করে নিয়ে গেছেন। তিন রাজ্যে বিজেপিকে দুরমুশ করে ক্ষমতায় এসে করেও দেখিয়েছেন। সে পথে মোদিজি বা তাঁর কার্যনির্বাহী অর্থমন্ত্রী হাঁটেন কী করে? হাঁটলে লোকে তো বলতেই পারে, রাহুল গান্ধীর নীতিকে নকল করছেন প্রধানমন্ত্রী। সে জন্যই বিকল্প পথে কৃষক সন্তোষ বিধানের সর্বাত্মক চেষ্টা হয়েছে বাজেটে। অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের জন্য মাসে তিন হাজার টাকা পেনশন, ‘পি এম কিষাণ’ প্রকল্পে দুই হেক্টর অব্দি জমির অধিকারী কৃষক মাসে দুই হাজার করে বছরে তিনবার অনুদান আর সেটা লাগু করা হল শেষ ডিসেম্বরের পয়লা থেকে। সুতরাং দেশের ১২-১৩ কোটি কৃষকজনের অ্যাকাউন্টে ঠিক ভোটের মুখে দু-হাজার করে টাকা ঢুকে পড়তেই পারে। সেই সঙ্গে ‘রাষ্ট্রীয় গোকুল মিশন’ প্রকল্পে গোরক্ষা ও গোরুদের সুন্দর করে জীবন কাটানোর জন্য বছরে সাড়ে সাতশো কোটি দেবার আয়োজনও আছে বাজেটে! আর কী চাই! এহেন বাজেটের পর দেশের কৃষকসমাজ যদি বিশেষ উৎফুল্ল হয়ে ওঠে এবং মোদি সরকারকে ধন্য ধন্য করে তাতে আশ্চর্য কী? আর শুধু কৃষক কেন, দেশের শ্রমিকমহলের জন্যও তো অন্তর্বর্তী বাজেটে সুরক্ষা ও উন্নয়নখাতে বরাদ্দের অভাব নেই। শ্রমিকের মৃত্যুতে দ্বিগুণ, পি.এফ, গ্রাচুইটি দশ লক্ষ থেকে বাড়িয়ে ত্রিশ লক্ষ করা—আরও কত কী!
শুধু কি তাই? উচ্চবর্ণের জন্য দশ শতাংশ সংরক্ষণ, আর্থিকভাবে অনগ্রসর উচ্চবর্ণের জন্য স্কুলস্তরে ২৫ শতাংশ সংরক্ষণ, রেলের আধুনিকীকরণে শত শত কোটির বরাদ্দ প্রতিরক্ষায় রেকর্ড তিন লক্ষ কোটি—ভাবা যাচ্ছে না! এমন একটা বাজেট যে হতে পারে এমন ‘জনহিতকর’ এমন ‘উদার মুক্তহস্ত’—সত্যি বলতে কী এখনও মানুষজন ভেবেই উঠতে পারছেন না! অথচ হয়েছে। সংসদে প্রধানমন্ত্রীর লাগাতার টেবিল চাপড়ানো সাধুবাদ নিয়ে এমন একটা অভূতপূর্ব বাজেট প্রস্তাবই শুক্রবার পেশ করেছেন ভারপ্রাপ্ত অর্থমন্ত্রী পীযূষ গোয়েল। কেন দিন ফুরোনোর মুখে এমন একটা বাজেট তা আশা করি কাউকেই আজ বলে দিতে হবে না। ভোট এসে পড়েছে। ২০১৯ সালের লোকসভা ভোট। সেই ভোটের আগে জনমন জয়ের লক্ষ্যেই যে বিদায়বেলার অন্তর্বর্তী বাজেটকে এমন বিপুল লোভনীয় সব প্রস্তাবে টইটম্বুর করে পূর্ণাঙ্গ বাজেটের আকারে পেশ করা হল, জিএসটি কমানোর জন্য জিএসটি কাউন্সিলকে অনুরোধ জানানো হল—তা তো রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের প্রায় সকলেই বলছেন। খুব যে ভুল বলছেন এমনও কি বলা যাবে? বলা যেত, যদি দেখা যেত যে ক্ষমতায় এসে ইস্তক মোদিজির অর্থমন্ত্রী দেশের গরিব-মধ্যবিত্ত কৃষক-শ্রমিকের জন্য ফি-বছর বাজেটে এমন দরাজ প্রস্তাব পেশ করেছেন এবং বছরভর সেইসব প্রস্তাব বাস্তবায়নে সচেষ্ট থেকেছেন। কিন্তু, তা তো ঘটেনি। বরং, ‘স্বচ্ছ ভারত’, ‘ডিজিটাল ইন্ডিয়া’, কালাধন উদ্ধার, নোটবন্দি, জিএসটি, জ্বালানি তেল গ্যাসের দাম বৃদ্ধি—একের পর এক সংস্কারী দাওয়াইতে গরিব মধ্যবিত্তের প্রাণ ওষ্ঠাগত করে তুলেছেন। তারপর ২০১৯ মহাযুদ্ধ যখন ঘনিয়ে এসেছে আর তার মুখে পাঁচ রাজ্যের ভোটফলে বিপর্যয় যখন গেরুয়া শিবিরের শক্ত ভিতে ধাক্কা দিয়েছে, বোঝা গিয়েছে পদ্ম-রাজে দেশের মানুষের আস্থা টলেছে—তখন এই বাজেট! বিমুখ দেশের মুখ ফেরাতে শেষ অস্ত্র। কিন্তু, কথা হল—এভাবে বাজেটে ভুলিয়ে দেশের মানুষের মন জেতা যাবে? লোকে পাঁচ বছরের কষ্টগুলো ভুলে কেবল কটা বাজেট প্রস্তাবে মজে গেরুয়া শিবিরের ২০১৯ ভোটবাক্স ভরিয়ে দেবে? বিশেষ করে যখন সেই মানুষজনের মনে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের জ্বালা রীতিমতো সতেজ ও সক্রিয়—তখন! বাজেটের প্রস্তাবগুলোও তো এক ধরনের প্রতিশ্রুতিই—তাই না?
কেউ কেউ বলছেন, মোদিজির এই লোভনীয় বাজেট প্রস্তাব ভোটের মুখে দেশের আম-পাবলিকের দরবারে কিছু সাড়া ফেলতে পারে। তবে তা ভোটফলকে কতটা প্রভাবিত করবে সে ব্যাপারে এখনও কেউই নিশ্চিত নন। তার কারণ, প্রাথমিকভাবে এই বাজেট মধ্যবিত্ত শ্রমজীবী জনতার মধ্যে একটা স্বস্তি খুশির আবহ তৈরি করলেও তার আয়ু দীর্ঘ হবার সম্ভাবনা কম। কেননা, এই বাজেট একটি বিদায়ী সরকারের বাজেট। একে যতই পূর্ণাঙ্গ বাজেটের খোলশ পরানো হোক জনতা জানে এটা অন্তর্বর্তী বাজেট। আসন্ন লোকসভা ভোটে দেশের মসনদে রং বদল হলে এইসব প্রস্তাব মূল্য হারাতেই পারে। তখন নতুন সরকার এসে নতুন বাজেট প্রস্তাব রাখতেই পারে। দ্বিতীয়ত, বর্তমান সরকারও যদি ভোট জিতে ক্ষমতায় ফিরে আসে তখনও যে এইসব প্রস্তাব কার্যকর হবে এমন ভরসাও একশো শতাংশ ধরে রাখা মুশকিল। কারণ, এই প্রস্তাব মানতে হলে দেশের আর্থিক ব্যবস্থায় বড় চাপ পড়বে।
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই বিষয়টি নিয়ে ইতিমধ্যেই সরব হয়েছেন। এবং তাঁর মতে, ভোট রাজনীতির স্বার্থে এমন বাজেট কখনওই কাম্য নয়। শুধু মমতাই কেন, অর্থনীতির অনেক বিশেষজ্ঞই মনে করছেন, এই বাজেট প্রস্তাবে একটা তাৎক্ষণিক চমক আছে ঠিকই, তবে এ দিয়ে দেশের বা দেশের মানুষের দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন সম্ভব নয়। কারণ, এইসব প্রস্তাব বাস্তবায়িত করতে গেলে বিপুল পরিমাণ অর্থ চাই। সে অর্থ কোথা থেকে আসবে তার তেমন দিশা বাজেটে কোথায়? তাছাড়া, এতে সরকারি কোষাগারের আয়েও টান পড়ার সম্ভাবনা। কিন্তু, ভোট বড় বালাই। ক্ষমতায় ফিরতে গেলে ২০১৯ মহাসংগ্রামে জিততেই হবে। সে জয় যে সহজ নয় সেটা আজ কে না বোঝেন। একে গেরুয়া-রাজের ওপর দেশের মানুষের আস্থা অনেকটাই ভেঙেছে, তার ওপর বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে যেভাবে সংগঠিত হচ্ছেন দেশের তাবড় বিরোধীরা তাতে ২০১৯ সালের ভোটযুদ্ধে যে মোদিজি ও তাঁর গেরুয়া বাহিনীর জন্য কড়া লড়াইয়ের ক্ষেত্র প্রস্তুত হচ্ছে তাতেও সন্দেহ নেই। এমন অবস্থায় দেশজনতার মন ভোলাতে না পারলে যে সমূহ বিপদ। ‘উরি’ বা ‘অ্যাক্সিডেন্টাল প্রাইমমিনিস্টারে’র মতো কটা সিনেমা দিয়ে যে দেশের মানুষের মনে জাতীয়তাবোধ জাগানো বা কংগ্রেসের প্রতি বাড়তি বিতৃষ্ণা তৈরি করা যে সম্ভব না সেটা কে না বোঝেন। অতএব পদ্মবিমুখ মানুষের মন মজাতে বাকি রইল দান-খয়রাত আর আর্থিক ছাড়ের উপহার। শুক্রবারের অন্তর্বর্তী বাজেটকে তার এক উজ্জ্বল নমুনা বললে কি খুব ভুল হবে? সে ঠিক ভুল যাই হোক, দিনের শেষে প্রশ্ন সেই একটাই—এভাবে বাজেটে ভুলিয়ে দেশের মানুষের মন জেতা যাবে, পার হওয়া যাবে ২০১৯ লোকসভার ভোট বৈতরণী?