বিদ্যার জন্য স্থান পরিবর্তন হতে পারে। গবেষণামূলক কাজে সাফল্য আসবে। কর্মপ্রার্থীরা কোনও শুভ সংবাদ পেতে ... বিশদ
আরও শোনা গেল, ঘটনায় ক্ষুব্ধ সিবিআই যাচ্ছে সুপ্রিম কোর্টে। গেল। এবং মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে নির্দেশ দিলেন, যাঁকে কেন্দ্র করে এতকিছু, কলকাতার সেই পুলিস কমিশনার রাজীব কুমারকে সিবিআইয়ের ডাকে হাজিরা দিতে হবে, তাদের সঙ্গে সহযোগিতা করতে হবে, জিজ্ঞাসাবাদের জবাব দিতে হবে। কিন্তু, কোনও অবস্থাতেই সিবিআই অফিসারেরা রাজীব কুমারের ওপর কোনও শক্তিপ্রয়োগ করতে বা তাঁকে গ্রেপ্তার করতে পারবেন না! আর মহামান্য আদালতের এই নির্দেশকে ‘নৈতিক জয়’ হিসেবে চিহ্নিত করে মুখ্যমন্ত্রী মমতা ধর্মতলার ধর্না তুলে নিয়ে দিল্লিতে বৃহত্তর প্রতিবাদ আন্দোলনের ডাক দিলেন। সিবিআই ততক্ষণে ফিরে গেছে ডেরায়! এর পর কী হবে সেটা সময় বলবে। কিন্তু, আপাতত সিবিআইয়ের যুদ্ধ শেষ। আদালতের নির্দেশ মানতে ৮ ফেব্রুয়ারি পুলিস কমিশনার সিবিআইয়ের কাছে যেতে চেয়েছিলেন। সিবিআই জানিয়ে দিয়েছে, ডেট ঠিক করার রাজীব কে? সিবিআই ডেট বলবে। ব্যাস্, হয়ে গেল।
এর আগেও কি আমরা এ রাজ্যে সিবিআইয়ের এমন অতিতৎপরতা দেখিনি? দেখেছি। হইহই করে সব আসেন, কয়েকদিন হাঁকাহাঁকি ডাকাডাকি গরম গরম মন্তব্য হাঁকেন ক্ষেত্রবিশেষে একে তাকে ধরে নিয়ে ওড়িশায় যান তারপর সব একসময় কোথায় যেন হারিয়ে যায়! হ্যাঁ, ইতিমধ্যে অবশ্য সারদা-রোজভ্যালির মতো আর্থিক বিষয়ের মামলায় কয়েকজনকে জেলেও পুরেছে সিবিআই, আবার তাঁদের অনেকে পরে জামিনে ছাড়া পেয়ে ঘরেও ফিরেছেন। একথা ঠিক, সারদা-রোজভ্যালির মতো আর্থিক কাণ্ডে এ রাজ্যের ও ভিন রাজ্যের বহু মানুষ প্রতারিত হয়েছেন, সর্বস্ব খুইয়েছেন অনেকে, একাধিক আত্মহননের ঘটনাও ঘটেছে। সেদিক থেকে প্রতারিত সর্বস্ব খোয়ানো মানুষজনের মতো শুভবুদ্ধিসম্পন্ন সকলেই চাইবেন এবং চানও যে ওইসব আর্থিক দুর্নীতির সঙ্গে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক সাজা হোক। কিন্তু, দোষীদের ‘সাজা’ দেওয়ার সদিচ্ছা সত্যিই কি দিল্লির মহাকর্তাদের আছে? প্রশ্ন উঠেছে বহুদিনই। উঠেছে তার কারণ, কোনও সারদা-রোজভ্যালির মতো কোনও আর্থিক কেলেঙ্কারির তদন্তই তো শেষ করতে পারেনি কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা! একবার করে তাঁরা তেড়েফুঁড়ে ওঠেন, জিজ্ঞাসাবাদ ধরপাকড় চলে, সাময়িক একটা উত্তেজনা তৈরি হয়—তারপর হঠাৎ করেই যেন সব হাওয়ায় মিলিয়ে যায়! দিনের পর দিন, বছরের পর বছর সিবিআইয়ের এমন কীর্তিকাণ্ড দেখে লোকে যদি তাঁদের অভিযানকে ‘নাটক’ হিসেবে চিহ্নিত করেন, দোষ দেওয়া যাবে?
সত্যি বলতে কী, আজ যে সারদাকাণ্ড নিয়ে সিবিআই এত কাণ্ড করল তার একনম্বর অভিযুক্তকে কিন্তু পাকড়েছিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গোয়েন্দা বাহিনী, সিবিআই নয়! এবং সেই অভিযুক্ত ও তাঁর এক সহকর্মী এখনও জেলজীবন কাটাচ্ছেন যে তার কারণ নিশ্চয়ই রাজ্যের গোয়েন্দা পুলিসের কর্মকুশলতা, মহামান্য আদালতে দাখিল করা তাঁদের অভিযোগপত্রের বলিষ্ঠতা। সিবিআই সেই কুশলতা দেখাতে পারল কই? তাঁরা যাঁদের ধরেছেন তাঁদের প্রায় সকলেই তো সাময়িকভাবে হলেও জামিন পেয়ে গেছেন! গেরো ফসকা না হলে এমনটা ঘটে? এই তো গত রবিবার শেষ বিকেল থেকে রাত অব্দি যা ঘটল তাতেও কি ওই ফসকা গেরোটাই প্রকট হয়ে উঠল না? পুলিস কমিশনারের বাড়িটা ঠিক কোন থানার সেটা পর্যন্ত সঠিকভাবে জেনে আসেননি তদন্তকারীরা? নাহলে শেক্সপিয়র সরণি থানার বদলে পার্ক স্ট্রিট থানায় কেন নথি নিয়ে যাওয়া! এভাবে কলকাতার মতো একটি মহানগরীর নগরপালের বাড়িতে ঢুকতে গেলে বাধা আসতে পারে সেটাও ভাবেননি তাঁরা! তৃতীয়ত, রাজ্য প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানিয়ে বুঝিয়ে এলে ক্ষতিটা কী হতো, কমিশনার পালিয়ে যেতেন? কলকাতার পুলিস কমিশনার পদাধিকারী একজন দক্ষ বিচক্ষণ অফিসারের পক্ষে সেটা সম্ভব বলে মনে করেছিলেন তদন্তকারীরা? নিশ্চয়ই না। তাহলে এমন আকস্মিকতার প্রয়োজনটা ছিল কি? শেষমেশ তো কিছুই হল না। যথা পূর্বং তা-ই রইল। জিজ্ঞাসাবাদ। স্থানটা ওড়িশা বা দিল্লি থেকে সরে গেল শিলঙে—এই যা! তার জন্য এত হুডুমদুড়ুম! এত ধস্তাধস্তি! নাটক ছাড়া কী?
দুর্নীতিমুক্ত ভারত, স্বচ্ছ ভারত গড়ার লক্ষ্যে অবিচল বলে লাগাতার বিজ্ঞাপিত নরেন্দ্র মোদি সরকারের দুর্নীতিদমন প্রকল্পে সিবিআই নিঃসন্দেহে অন্যতম সেরা হাতিয়ার। একসময় সিবিআইয়ের নাম শুনলে অনেক ৫৬ ইঞ্চিরও বুকের পাঁজরে কাঁপন ধরে যেত, গলা জিব শুকিয়ে আড়ষ্ট হয়ে যেত কথা! আজ সে দিন হয়তো গিয়েছে। সাম্প্রতিক বিতর্ক ও সংস্থার শীর্ষমহলে অপ্রীতিকর সংঘাতে হয়তো আরও বিবর্ণ হয়েছে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দাদের একদা অরণ্যদেব মার্কা ভাবমূর্তি। তবু, আমপাবলিকের কাছে অন্তত এখনও সিবিআই তো সিবিআই-ই না? একটা জবরদস্ত জমকালো সমীহ জাগানো ব্যাপার—তাই না। কিন্তু, সেই সংস্থাকে যখন রাজ্য পুলিসের কাছে হার মানতে দেখছি আমরা (পরে তাঁরা কী করবেন সে পরের কথা। রবিবার যা দেখলাম তার পরিপ্রেক্ষিতে বলছি), দেখছি তাঁদের অফিসারদের পুলিসগাড়িতে তুলে চালান করা হচ্ছে থানায়—তখন আমাদের মনে হবে না কি যে তাঁরা নিজেদের যোগ্যতা দক্ষতা সংস্থার মানমর্যাদা ভুলে কোনও বিশেষ উদ্দেশ্যে বা কোনও বিশেষ প্ররোচনাতেই এমন হঠকারিতা দেখিয়েছেন এবং সেই প্ররোচনা রাজনীতি বিচ্ছিন্ন নয়! মনে হতে পারে না কি যে সিবিআইকে যাঁরা দিল্লির শাসকের ‘তোতাপাখি’ বলে আজকাল কটাক্ষ করেন তাঁরা কেবল অসূয়াবশতই করেন না, করার পিছনে কিছু ব্যাপারও আছে, আছেই!?
কিন্তু, মুশকিলটা হল—ভুল জায়গায় ভুল অস্ত্র প্রয়োগ করলে ফল বিপরীত হয়। পুলিস কমিশনার রাজীব কুমারের শেষপর্যন্ত কী হবে, না হবে সময় বলবে। কিন্তু প্রশ্ন হল, সিবিআই নাটকে শেষ পর্যন্ত মমতাই কি লাভবান হলেন না? রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের অনেকেই বলছেন, সিবিআইয়ের এই ‘নাটকে’ যদি কেউ লাভবান হন তবে তিনি তৃণমূল সুপ্রিমো তথা রজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সর্বভারতীয় রাজনীতিতে বিরোধীনেত্রী হিসেবে এই ঘটনা যেমন তাঁর প্রতিবাদী ভাবমূর্তির অনন্যতা ফের একবার সর্বজনসমক্ষে উজ্জ্বল করে তুলল, তেমনি বিরোধী শিবিরের মহারথীদের অকুণ্ঠ সমর্থন তাঁর দিল্লি যাত্রার পথটিও পূর্বাপেক্ষা সুগম করে তুলল। মোদি-বিরোধী অভিযানে এখন তিনিই প্রধান মুখ।
বিশেষজ্ঞদের এই অভিমত মানুন আর নাই মানুন একটা কথা পরিষ্কার, ইন্দিরা গান্ধীর স্মৃতি উসকে প্রিয়াঙ্কা ওয়াধেরাকে নামিয়ে রাহুল কংগ্রেস যে চমক দিয়েছিল, ভোট রাজনীতির আলো টানার যে চেষ্টা করেছিল রবিবার রাতের পর তাতে কিছু ভাটা পড়বেই। এবং পড়ার কারণ মমতা। মুখ্যমন্ত্রী মমতার রবিবাসরীয় মোদি-বিরোধী হুঙ্কার, রাজ্যের ওপর সিবিআইয়ের মতো সংস্থা দিয়ে চাপ সৃষ্টির মতো গুরুতর অভিযোগ এবং সেই অভিযোগ সম্বল করে দিল্লি কাঁপানোর ডাক উপেক্ষা করার সামর্থ্য যে বিরোধী শিবিরে বিশেষ কারও নেই সেটা তাঁর ধর্না মঞ্চে উপস্থিত হয়ে বা ফোনালাপে অনেকেই প্রমাণ করে দিয়েছেন। কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধীও কিন্তু তার ব্যতিক্রম নন। সব মিলিয়ে পরিস্থিতি যেদিকে গড়াচ্ছে তাতে প্রায় নিশ্চিতভাবেই বলা চলে, নরেন্দ্র মোদির বিরুদ্ধে লোকসভা মহাযুদ্ধের ময়দানে বিরোধী শিবিরের প্রধান মুখ, প্রধান সেনাপতি হিসেবে শেষ অব্দি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্বীকৃতির যে সম্ভাবনা দানা বাঁধছিল রবিবারের ঘটনার পর সেটা একরকম অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠেছে। মোদি-বিরোধী শিবিরের নেতানেত্রীদের বক্তব্য প্রতিক্রিয়া এবং সমর্থনের তীব্রতায় তার আভাসও স্পষ্ট—অতএব সাধু সাবধান!