মূল্য দিয়া মানুষের পরিশ্রমকে কিনিতে পার, কিন্তু শ্রমের মালিককে কিনিয়া লইতে পার না। ভগবানের রাজ্যে মাথা কেনা-বেচার অধিকার কাহারও নাই। মানুষের বিবেকের বিপণী কোথায়ও থাকিতে পারে না। তবু যে মানুষ নিজের দৈহিক অস্তিত্বটাকে পরের পায়ে বাঁধা দিয়া বসে, তাহা শুধু পশুশক্তির প্রচণ্ড আক্রোশকে স্বশক্তিতে পূর্ণতঃ প্রতিহত করিতে পারে নাই বলিয়া। কিন্তু, তার জন্য একথা কখনও বলা চলিবে না যে, তাহার মনোময় বিদ্রোহ মাথা তুলিয়া দাঁড়ায় নাই। দেহশক্তি যোগ্য প্রতিকূলতা দিতে পারিল না বলিয়া সে নতশির হইয়া বশ্যতা স্বীকার করে; কিন্তু মনঃশক্তিকে অনুকূল করিবার পক্ষে উহা যথেষ্ট নহে। জাগতিক প্রভুত্বের উদ্ধত নেশায় তুমি আমাকে পদাঘাতে অপমান করিতে পার, আমি প্রতিঘাত করিতে পারি না বলিয়া সবই নীরবে সহিয়া লইলাম; কিন্তু তুমি যাহা করিলে তাহাতে তোমার স্বাধিকার প্রসার পাইল না, সঙ্কুচিত হইল। কারণ, গায়ের জোরে তুমি আমার দেহখানির উপরে কর্ত্তৃত্বের লীলাখেলা করিতে পার, কিন্তু যতই আমার স্বাধীন ইচ্ছার অবাধ গতিকে তুমি তোমার স্বেচ্ছাচারের পাশবন্ধনে বাঁধিয়া ফেলিতে চাহিবে, আমার মনের উপরে তোমার অধিকার ততই কমিয়া যাইবে। আমাকে যদি পিঞ্জরে পুরিয়া রাখ, আমি তোমাকে ভালবাসিতে পারিব কি? আমার অঙ্গকান্তি যদি কষার আঘাতে কালী করিয়া দাও, মনোরাজ্যের মণিময় মধুর-সিংহাসনে বসাইয়া আমি তোমাকে পূজার অঞ্জলি ঢালিব কি? তুমি আমার দেহকে চাহিয়া মনকে হারাইয়াছ, কাঁচের কদর করিয়া জহরতের খনির মুখে বাধা-প্রাচীর গাঁথিয়া লইয়াছ। আমার মনটা যে আমার দেহের চাইতে অনেক বড়, অনেক সুন্দর! উৎকর্ষের যতগুলি মাপকাঠি তোমার ঐ দৃপ্তযুগের জ্ঞান-বিজ্ঞান আবিষ্কার করিতে পারিয়াছে, সবগুলির হিসাবে দেখ, আমার মন কত প্রকারে কতটা শ্রেষ্ঠ। যে রাজ্যে লক্ষ কোটি সৌরজগৎ অনন্তযুগ ভ্রাম্যমাণ রহিয়াও প্রান্ত হইতে প্রান্তান্তরে যাইতে পারিল না, যে রাজ্যে সংখ্যাতীত শক্তি-প্রস্রবণ অনুক্ষণ প্রবাহিত হইয়াও জন্ম-জন্মান্তরে সমুদ্রের সন্ধান খুঁজিয়া পাইল না, সেই মনোরাজ্য হইতে নির্ব্বাসন-দণ্ড তুমি স্বেচ্ছাচারে অর্জ্জন করিয়াছ। আমার এই হীনশক্তি ক্ষীণ দেহকে ইচ্ছার ইঙ্গিতে চালিত করিয়াই তুমি দর্পদম্ভে ফাটিয়া মরিতে পার, কিন্তু ‘‘আমাকে’’ তুমি পাও নাই, পাইয়াছ আমার ক্ষণভঙ্গুর কায়াকে অথবা ক্ষণস্থায়ী ছায়াকে। আমাকেই যদি পাইতে, তবে সে পাওয়ার সাথে সাথে তোমার জন্য মলয়-পবন চন্দনগন্ধ বহিয়া আনিত, বর্ষাধারায় আশিস-কুসুম ঝরিয়া পড়িত। সকল শ্রম-সমস্যার ইহাই চাবিকাঠি।
তোমার কাছে অনুগ্রহ চাহিবার জন্যই যদি কাহারও জন্ম হইয়া থাকে, তবে সে জন্মিয়া আসিয়া তারপরে তোমার কাছে অনুগ্রহ চাহিত না, জন্মিবার আগেই তোমার অপার অনুগ্রহের মুখ চাহিয়া তবে সসম্ভ্রমে মাতৃগর্ভে প্রবেশ করিত। দেহাত্ম অভিমানে আমরা নিজেদের ক্ষুদ্র ‘‘আমিকে’’ জগজ্জোড়া ভাবিয়া নিজেদের মধ্যে অনুগ্রহকারিণী শক্তির আরোপ করি। মিথ্যাকেই জীবন ভরিয়া ভালবাসিয়াছি, তাহারই অপরিহার্য্য ক্রমপরিণতি আমাদের মনোবৃত্তির গঠনকে পঙ্গু এবং ধারাকে পঙ্কিল করিয়া ফেলিয়াছে। তাই, আমরা মিথ্যাকেই শতবার সত্য বলিয়া ভাবি, আবার সত্যকে মিথ্যা বলিয়া অগ্রাহ্য করি। তাই, আমরা, ভুল করিয়া তাহাকেই ভাবি ঠিক, চঞ্চল হইয়া তাহাকেই ভাবি স্থিরতা। তাই, আমরা জীবনের প্রতিষ্ঠাকে পতন বলিয়া ভাবি, আবার অধঃপতনকে উন্নতি বলিয়া মনে করি। তাই আমরা জীবনকে মৃত্যু ভাবিয়া পরিহার করি, মৃত্যুকে জীবন জানিয়া আলিঙ্গন পাশে বাঁধিয়া লই। নহিলে, কুসুম-গন্ধ উপভোগ-কালে বিষধর আসিয়া দংশন করে কেন? দণ্ড-পুরস্কারের মালিক যদি মানুষ হইত, তবে আমি জগৎ ভরিয়া শুধু মানুষেরই কথা শুনিয়া যাইতে মুক্ত কণ্ঠে বলিতাম। মানবাত্মা আপন অন্তরে যদি স্বেচ্ছাদত্ত শাস্তি লাভ না করিল, দু’দিনের জীব মানুষ আসিয়া তাহার কি করিবে? মানবাত্মা আপন অন্তরে যদি আত্মপ্রসাদ উপলব্ধি না করিল, জগতের পুরস্কারের পসরা মাথায় চাপাইয়া তুমি কি করিতে পার?
শ্রীশ্রী স্বামী স্বরূপানন্দ পরমহংসদেবের ‘কর্ম্ম-ভেরী’ থেকে