বিদ্যার জন্য স্থান পরিবর্তন হতে পারে। গবেষণামূলক কাজে সাফল্য আসবে। কর্মপ্রার্থীরা কোনও শুভ সংবাদ পেতে ... বিশদ
শ্রীশ্রীঠাকুর সত্যানন্দদেব উত্তরে বললেন—‘‘এ যুগের কথা পবিত্রতা। পবিত্রতা লাভ করলেই সব হবে।’’
স্পষ্ট, দৃঢ়, অথচ করুণমথিত জলদমন্ত্র কণ্ঠের এই উক্তি আধ্যাত্মিক জগতে এক বিরাট ভরসার কথা। ‘‘সব হবে’’। নিষ্কাম কর্ম, ব্রহ্মজ্ঞান, পরাভক্তি, প্রেম সব হবে যদি পবিত্রতা লাভ করা যায়। ‘‘এ যুগ কৃপার যুগ। এ যুগে বাইরের টান তিনিই বেশী করেছেন। কাজেই কৃপাও বেশী করতে হবে’’। এও শ্রীসত্যানন্দের বিশেষ আশ্বাস। একটি মাত্র শব্দ ‘‘পবিত্রতা’’কে শর্ত রেখে শ্রীঠাকুর চরম অঙ্গীকার করেছেন। এখন আমাদের ভাবতে হবে কিভাবে পবিত্রতা লাভ করা যায়। শ্রীঠাকুর সত্যানন্দদেব বলেছেন— ‘‘দেহের মনের শুদ্ধির দরকার। দেহের দ্বারা যা গ্রহণ করবে তাও বিশুদ্ধ হওয়া প্রয়োজন। আর মনের দ্বারা যা গ্রহণ করবে তাও যেন শুদ্ধ হয়। দেহের মনের পারে যে বুদ্ধি অহংকার সেগুলির অশুদ্ধতাও দূর করতে হবে।’’
পাতঞ্জল দর্শনের সাধনপাদে শৌচের কথা বলা হয়েছে। সূত্রের ব্যাখ্যায় বলছেন—‘শৌচং শুদ্ধত্বম্। তচ্চ বাহ্যাভ্যন্তর-ভেদেন দ্বিবিধম্’’ শৌচ অর্থাৎ শুদ্ধ থাকা। শরীরকে নিয়মিত ভাবে স্নানাদি দ্বারা পরিষ্কার রাখতে হবে। শুদ্ধ পরিষ্কার বস্ত্র পরিধান করতে হবে। সত্ত্ব বৃদ্ধিকারক বুদ্ধিবর্দ্ধক পবিত্র দ্রব্য আহার করতে হবে। সে আহার হবে পরিমিত ও সাত্ত্বিক। অনেকে দেহকে একটু ঘৃণার অবজ্ঞার চোখে দেখেন। তা কিন্তু ঠিক নয়। কারণ দেহ ভগবানের মন্দির, তাঁর লীলার ক্ষেত্র। এই দেহই তাঁকে লাভ করার একমাত্র প্রকৃষ্ট যন্ত্র। কাজেই দেহের পবিত্রতা অক্ষুণ্ণ রাখার ব্যাপারকে শ্রদ্ধার সঙ্গে গ্রহণ করতে হবে। দেহ ও মন পরস্পরাপেক্ষিক। মনের চাঞ্চল্য যেমন দেহে প্রকাশিত হয়, তেমনি দেহের চাঞ্চলতা মনকে প্রভাবিত করে। বেশভূষার প্রভাব মনের ওপর বিশেষ ভাবেই লক্ষ্য করা যায়। শ্রীরামকৃষ্ণদেব যেমন বলেছেন—কালো-পেড়ে কাপড় পরে আছে, অমনি দেখবে, তার নিধুবাবুর টপ্পার তান এসে জোটে। তাই দেহকে স্নানাহার পরিচ্ছদ সর্ব বিষয়ে শুদ্ধ পবিত্র করে তুলতে হবে। Cleanliness is next to Godliness. ইংরেজিতে এটি একটি বিখ্যাত উক্তি। আমরা কিন্তু স্বচক্ষে এরও উপরের কথা দেখেছি—Cleanliness is Godliness itself. যাঁরা শ্রীসত্যানন্দদেবকে দেখেছেন প্রথম প্রভাতে প্রস্ফুটিত শ্বেতপদ্মের মত জ্যোতিস্নাত শুভ্র রূপের স্নিগ্ধ প্রকাশে প্রোজ্জ্বল, তাঁরা সহজেই অনুভব করতে পারবেন একথার তাৎপর্য। ঠাকুর বলতেন,—‘‘হাড়শুদ্ধ হতে হবে।’’ শ্রীঠাকুরের পবিত্র দেবতনু দেখলেই মনে হত যেন স্ফটিকের মতই স্বচ্ছ সর্বাঙ্গ। পবিত্রতার পূর্ণতম রূপ মানুষদেহে মূর্ত্ত হয়েছিল। তাই তো এত দৃঢ়কণ্ঠে বলেছিলেন—‘‘ এই মূহূর্তে মা ভবতারিণী যদি সামনে এসে দাঁড়ান, তাহলে জোর গলায় একটা কথা বলতে পারবো—I am spotlessly clean.’’ পৃথিবীর বুকে চরম আদর্শ স্থাপনই এঁদের মহৎ উদ্দেশ্য। আমাদের এগিয়ে যেতে হবে সেই আদর্শকে সামনে রেখে।
ঠাকুরের বাণীতে পাই—‘‘যে সব কামনা দেহ-মনের বিশেষ ক্ষতিকর সেগুলি ত্যাগ করবে। সর্ব দ্বার রক্ষা করবে। যেন কোন দিক দিয়ে অকল্যাণজনক কিছু না প্রবেশ করতে পারে।’’ মনের পবিত্রতা অর্জনই সাধকের সংগ্রাম। জন্ম-জন্মের অশুভ অদিব্য সংস্কার পুঞ্জীভূত হ’য়ে থাকে মনের গোপন কোণে। অসতর্ক মূহূর্তে সেগুলি কখন যে জেগে উঠবে কেউ জানে না। কারণ, অবচেতনে ইড বা পশুত্বের বৃত্তি অনেকখানি আছে। এই পশুত্বকে জয় করে মনুষ্যত্ব লাভ করতে গেলে এই সংস্কার-পুঞ্জের মোড় ঘোরাতে হবে। তার উপায় আমাদের ঠাকুর বলেছেন—‘‘প্রার্থনায়, নামে, ধ্যানে, ব্রহ্মচর্য্যে, মনঃ শক্তিতে এদের জয় করতে হবে, কল্যাণমুখী করে তুলতে হবে। সেইখানেই আমাদের মনুষ্যত্ব’’। মনের স্থান আজ্ঞাচক্রে কিন্তু মনের গতি নিম্ন তিন ভূমির দিকে। এটাই মনের প্রকৃতি। সে তার নিজস্ব বাড়ীতে থাকে না। বিদেশে বাসা খুঁজে থাকতে চায়, তাই সে দেহের নিম্ন তিন ভূমিকেই আশ্রয় করে থাকে। স্বরগ্রামের ‘নি’তে মন বেশীক্ষণ থাকে না। তাই এবিষয়ে শ্রীঠাকুর উপদেশ দিয়েছেন—‘‘মনটাকে উঁচু সুরে বেঁধে রাখতে হবে। উঁচু সুরে বাঁধা থাকলে নীচের কথা বা ভাবনা আর কি করে করবে? মনে করবে আমাদের ঠাঁই এখানে নয়, অন্য রাজ্যে। আমাদের বাড়ী আনন্দের রাজ্যে, জ্যোতির রাজ্যে—তখন হীন বিষয়ে মন যাবে না।’’