বিবেকানন্দের উত্তরাধিকার অথবা রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দের উত্তরাধিকার। যাহাই ভাবি না কেন, এই প্রসঙ্গে কিছু আত্মসমালোচনামূলক বিশ্লেষণ এবং কিছু ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা করিবার সময় আসিয়াছে। দিকে দিকে যেন অশান্তির রণদামামা বাজিতেছে, সাধারণ মানুষের হৃদয় প্রকম্পিত হইতেছে। সম্মুখের আলো কি ক্রমশ নিভিয়া আসিতেছে? যে বাতাবরণে আনাচে-কানাচে হিংসা, দুর্বৃত্তায়ন, অশান্তির আগুন ক্রমশ উদ্দীপিত হইতেছে, আমাদের চক্ষু অন্ধ হইবার উপক্রম হইয়াছে—কিছুই দেখিতে পাইতেছি না। ঈশ্বর, আত্মা, সত্য, প্রেম—সবই যেন ঝাপসা হইয়া যাইতেছে। সাম্প্রতিক সামাজিক অস্থিরতার কারণেই কি এই তমসার গাঢ় অন্ধকার ঘনাইতেছে, না কি দৃষ্টিশক্তির স্বচ্ছতা আমরা ক্রমশ হারাইতেছি? আমাদের দৃষ্টিশক্তি বিলুপ্ত হয় নাই। যে ব্যক্তি চক্ষু উন্মীলনে সমর্থ সে দেখিতেছে, ঐ দূরে সবকিছুর ঊর্ধ্বে স্বামীজী প্রসন্ন কিন্তু আরক্তিম নয়নে আমাদের পানে চাহিয়া রহিয়াছেন, বেদনায় জর্জরিত হইয়া কি যেন বলিতে চাহিতেছেন। কিন্তু সেই স্বর আমাদের নিকট পৌঁছাইতেছে না। আমরা নিজেকে তাঁহার উত্তরাধিকারী বলিয়া জানি না অথবা ভাবিতে চাহি না। কারণ ঐরূপ ভাবিলে কষ্ট হইবে, কষ্ট পাইতে হইবে। অথচ ইতিহাস এই উত্তরাধিকার-তত্ত্বের উপর প্রতিষ্ঠিত। বিজ্ঞানী আইনস্টাইন তাঁহার গ্রন্থে (Ideas and Opinion) লিখিয়াছেন: ‘‘A hundred times a day I remind myself that my inner and outer life depends upon the labours of other men, living or dead, that I must enert myself in order to give in the same measure as I have received and am still receiving.’’ অর্থাৎ দিনের মধ্যে শতবার আমি নিজেকে স্মরণ করাইতে চাহি, আমার অন্তর্জীবন এবং বহির্জীবন মৃত বা জীবিত অসংখ্য মানুষের ত্যাগের উপর নির্ভর করিতেছে এবং আমারও উচিত তীব্র উদ্যমের সহিত একইভাবে তাঁহাদের ঋণ শোধ করা।
ইহা তাঁহার উত্তরাধিকারবোধ এবং দায়বদ্ধতাবোধের পরিপূর্ণ অনুপম আত্মপ্রকাশ। যেদিক হইতেই দেখা হউক না কেন, বুঝিতে পারি আমাদের সমাজ এই উত্তরাধিকার সূত্রের উপর প্রতিষ্ঠিত রহিয়াছে। অবশ্য সাংবিধানিক উত্তরাধিকারের কথা বলিতেছি না। উত্তরপুরুষের অধিকারই উত্তরাধিকার। পূর্বে যাহার বা যাহাদের অধিকার ছিল তাহারা এখন নাই। এখন পরবর্ত্তী প্রজন্ম আসিয়া প্রাক্তনদিগের স্থান দখল করিয়াছে। কিন্তু ‘‘সেই tradition সামনে চলেছে।’’ একই দীপশিখা জ্বলিতেছে যুগ যুগ ধরিয়া। একই সংস্কৃতি, একই ধর্ম, একই আবেগমথিত উত্তরাধিকার প্রজন্মের পর প্রজন্ম ভোগ করিয়া আসিতেছে এই চিরন্তন ভারতবর্ষে। প্রশ্ন হইতে পারে, যুগ যুগ ধরিয়া যদি সেই একই বৈদিক উত্তরাধিকার আমরা ভোগ করিয়া আসিয়াছি, তাহা হইলে ‘বৈদিক উত্তরাধিকার’ না বলিয়া ‘বিবেকানন্দের উত্তরাধিকার’ বলিবার প্রাসঙ্গিকতা কোথায়? তাহার কারণ খুবই স্বচ্ছ। দৈনন্দিন সামাজিক জীবনে প্রায়শই দেখা যায়, উত্তরাধিকারী নিজে উত্তরাধিকার সম্পর্কে সচেতন নহে। কেউ আসিয়া মনে করাইয়া দিলে তাহার মনে পড়ে অথবা অজ্ঞাত তথ্য জানিতে পারিয়া অবাক বিস্ময়ে সে ভাবিতে থাকে, ‘তাই তো! আমি এই এত কিছুর মালিক!’ যে তাহাকে স্মরণ করাইয়া দিল, সে তাহার হিতাকাঙ্ক্ষী। কখনো কখনো এমনও ঘটে, স্মারক কেবল স্মরণ করাইয়াই নিবৃত্ত রহিলেন না, কেমন করিয়া সেই সম্পত্তি রক্ষা করিতে হইবে তাহাও সবিশেষ বলিয়া দিলেন।
স্বামী সর্বগানন্দের ‘ভাবপ্রচার ও সংগঠন’ থেকে