বিদ্যার জন্য স্থান পরিবর্তন হতে পারে। গবেষণামূলক কাজে সাফল্য আসবে। কর্মপ্রার্থীরা কোনও শুভ সংবাদ পেতে ... বিশদ
কাম কথাটীর শব্দার্থ কামনা। কামনা মানে ইচ্ছা, কিন্তু ইচ্ছা মাত্রেই কাম নহে। পরসুখের ইচ্ছাও কামনা, দেবসেবার ইচ্ছাও কামনা, কিন্তু তাহারা কাম নহে। একজন ক্ষুধায় মরিতেছে, তোমার ইচ্ছা হইল তাহাকে নিজের মুখের গ্রাস দান করিবার, ইহা তোমার মনের একটী কামনা, কিন্তু ইহা কাম নহে। একজন স্বদেশ-প্রেমিকের রোমাঞ্চকর অত্যদ্ভুত জীবন-কাহিনী শুনিলে, আর তাঁহারই মত স্বদেশের জন্য স্বজাতির জন্য জীবন উৎসর্গ করিবার জন্য ইচ্ছা জন্মিল, ইহাও মনের একটি কামনা, কিন্তু ইহা কাম নহে। কোনও ভগবদ্দর্শী মহাপুরুষের অযাচিত কৃপা তোমার জীবনের উপরে আসিয়া পড়িল, তিনি যেমন অযাচিত-ভাবে লোক-কল্যাণসাধন করিতেছেন, তোমারও তেমনি করিতে ইচ্ছা জন্মিল, তিনি যেমন তাঁহার পুণ্যময় সংসর্গের অন্তর্ভেদী প্রভাবের দ্বারা পাপীর পাপ, তাপীর তাপ, দুঃখীর দুঃখ, ব্যথিতের ব্যথা বিদূরিত করেন, তিনি যেমন তাঁহার প্রাণভরা ভালবাসার শক্তিতে নিরাশের নৈরাশ্য, উদাসীনের ঔদাস্য, অলসের আলস্য বিনাশ করেন, তোমারও তেমন করিতে ইচ্ছা হইল, তিনি যেমন কথার চাইতে মনের শক্তিতেই সমাজের বেশী কল্যাণ করেন, তিনি যেমন প্রকাশ্য ভাবের চাইতে অপ্রকাশ্য ভাবেই মানবজাতির বেশী সেবা করেন, তোমারও তেমনি করিতে আকাঙ্ক্ষা জন্মিল,—ইহা তোমার কামনা, কিন্তু কাম নহে। কামনা ভালমন্দ উভয় প্রকারই হইতে পারে কিন্তু কাম শুধু নীচের দিকেই টানে, পতনের পানেই আকর্ষণ করে। কাম চিত্তের অতি নিকৃষ্ট কামনা। কিন্তু সকল নিকৃষ্ট কামনাই কি কাম? না, তাহা নহে। একজন তোমার অনিষ্ট করিয়াছে, তুমি তাহার এই আচরণের বিরুদ্ধে অত্যন্ত উত্তেজিত হইয়া উঠিয়াছ এবং প্রতিশোধ লইবার জন্য একান্তই ইচ্ছুক হইয়াছ। তোমার এই ইচ্ছাটী একটি নিকৃষ্ট কামনা। কিন্তু তাই বলিয়া ইহাকে কাম বলিব না, ইহার নাম ক্রোধ। হয়ত কাহারও একটী সুদৃশ্য ও মূল্যবান্ রত্নালঙ্কার দেখিতে পাইয়াছ, ইহা পাইবার তোমার ইচ্ছা জন্মিল, অথবা একথালা সন্দেশ দেখিয়াছ, ক্ষুধা পায় নাই, তবু তোমার খাইবার স্পৃহা জন্মিল, ইহাও একটী নিকৃষ্ট কামনা, কিন্তু ইহা কাম নহে, ইহা লোভ। একজন হয়ত আপ্রাণ পরিশ্রমের দ্বারা প্রচুর ধন উপার্জ্জন করিয়াছেন, কিন্তু তোমার ইচ্ছা হইতে লাগিল যেন এই লোকটী তোমারই ন্যায় নির্ধন হইয়া যান—একজন তাঁহার পুত্রগণকে কত ক্লেশ সহ্য করিবার পরে লেখাপড়ায় কৃতী করিয়া তুলিয়াছেন, তোমার হয়ত ইচ্ছা জন্মিল, ইহারা আর বাঁচিয়া না থাকুক, অকালে কালগ্রাসে পতিত হইয়া তাহাদের পিতামাতার সন্তান-সৌভাগ্যের কপালে আগুন ধরাইয়া দেউক,—একজন হয়ত সমগ্র জীবনব্যাপী সাধুতা ও সচ্চরিত্রতার বলে দেশমধ্যে মহাত্মা বলিয়া যশস্বী হইয়াছেন, তোমার ইচ্ছা হইতে লাগিল, এই মহাপুরুষেরও চরিত্রের বিরুদ্ধে দুই চারিটা গ্লানিজনক কলঙ্ককথা আবিষ্কৃত হউক, একজন হয়ত বাগ্মিতায় বা কবিত্ব-প্রতিভায় পৃথিবীময় পূজা লাভ করিয়াছেন, তোমার ইচ্ছা হইতে লাগিল যেন লোকে তাঁহাকে সাধারণ লোকের চাইতে বেশী বড় বলিয়া মনে না করে, শতমুখে তাঁহার প্রশংসা-গুঞ্জন না করে,—তোমার এইরূপ ইচ্ছাও নিকৃষ্ট কামনাই বটে, কিন্তু ইহা কাম নহে, ইহার নাম মাৎসর্য্য।
শ্রীশ্রীস্বামী স্বরূপানন্দ পরমহংসদেব প্রণীত ‘নবযুগের নারী’ থেকে