ন্যাশনাল মানিটাইজেশন পাইপলাইন (এমএনপি)। এই গালভরা প্রকল্পটি ঘোষণা করেছেন কেন্দ্রীয় অর্থ ও কর্পোরেট বিষয়ক মন্ত্রী নির্মলা সীতারামন। চলতি অর্থবর্ষের (২০২১-২২) বাজেট পেশ করার সময়। এমএনপি মোট দুটি পর্বে রূপায়ণের লক্ষ্য নেওয়া হয়েছে। অ্যাসেট মানিটাইজেশনের যে ঘোষণা সরকার করেছে, তার ভিত্তি ছকে দিয়েছে নীতি আয়োগ। পরিকাঠামো নির্মাণের সঙ্গে যুক্ত মন্ত্রকগুলির সঙ্গে পরামর্শক্রমে। সোজা কথায় স্কিমটার চূড়ান্ত লক্ষ্য হল—কিছু কেন্দ্রীয় মন্ত্রক এবং চিহ্নিত রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার সম্পদ বিক্রির মাধ্যমে রাজকোষ ভরাবার ব্যবস্থা করা। সরকারের আশা, ২০২২-২৫ এই চারবছরে এমএনপির মাধ্যমে কেন্দ্রীয় কোষাগারে ৬ লক্ষ কোটি টাকা সংগৃহীত হবে। সীতারামনের মন্ত্রকের তরফে অর্থ সংগ্রহের এস্টিমেটটা এইরকম: ২০২২ সালে ৮৮ হাজার ১৯০ কোটি টাকা। ২০২৩ সালে ১ লক্ষ ৬২ হাজার ৪২২ কোটি টাকা। ২০২৪ সালে ১ লক্ষ ৭৯ হাজার ৫৪৪ কোটি টাকা। ২০২৫ সালে ১ লক্ষ ৬৭ হাজার ৩৪৫ কোটি টাকা। পরিকাঠামো নির্মাণের সঙ্গে যুক্ত মন্ত্রকগুলি হল—সড়ক, পরিবহণ ও রাজপথ; রেলওয়ে; শক্তি বা বিদ্যুৎ; পাইপলাইন ও প্রাকৃতিক গ্যাস; অসামরিক বিমান পরিবহণ; সমুদ্রবন্দর ও জলপথ; টেলি যোগাযোগ; খনি; কয়লা; এবং আবাসন ও নগর বিষয়ক। ন্যাশনাল ইনফ্রাস্ট্রাকচার পাইপলাইনে (এনআইপি) মোট সম্পদের আর্থিক পরিমাপ হল ৪৩ লক্ষ কোটি টাকা। আগামী চারবছরে তার ১৪ শতাংশ মানিটাইজ করার পরিকল্পনা সরকার নিয়েছে। এই বিষয়ে সরকারের কাছে অগ্রাধিকারের ক্ষেত্র পাঁচটি—। সেখান থেকে মোট লক্ষ্যমাত্রার ৮৩ শতাংশ অর্থ আসবে বলে সরকার ধরে নিয়েছে। যেমন রাস্তা থেকে ২৭ শতাংশ। রেল থেকে ২৫ শতাংশ। শক্তি বা বিদ্যুৎ থেকে ১৫ শতাংশ। খনিজ তেল ও প্রাকৃতি গ্যাস ক্ষেত্র থেকে ৮ শতাংশ। আর ৬ শতাংশ টেলিকম সেক্টর থেকে। সরকারের ঘোষিত বক্তব্য হল—পরিকাঠামোর উন্নয়ন এবং নতুন পরিকাঠামো নির্মাণের উদ্দেশ্যে এই ক্ষেত্রগুলিতে বেসরকারি বিনিয়োগ আকর্ষণ করা হবে। তবে, কর্পোরেটদের ওনারশিপ বা মালিকানা মঞ্জুর করা হবে না, মানিটাইজেশনের জন্য শর্তসাপেক্ষে তাদের কিছু অধিকার হস্তান্তর করা হবে। সবটাই দেওয়া হবে নির্দিষ্ট একটি মেয়াদের জন্য। মেয়াদ (ট্রানজাকশন লাইফ) উত্তীর্ণ হওয়ার পরে সেইসব ক্ষেত্র যথারীতি সরকারের কাছে ফেরত আসবে। নির্বাচিত বেসরকারি সংস্থার পারফর্ম্যান্সের ভিত্তিতে চুক্তি পুনর্বিবেচনা করারও অধিকার সরকারের থাকবে। মোদি সরকারের দাবি, আরও সম্পদ, আরও আর্থিক সমৃদ্ধি, আরও কর্মসংস্থানই তার ধ্যানজ্ঞান। একইসঙ্গে গ্রাম এবং শহরাঞ্চলের সার্বিক কল্যাণ সরকারের পাখির চোখ।
এই পর্যন্ত বিশেষ আপত্তির কিছু নেই। তবু, সারা দেশ আতঙ্কে আছে। কারণ, ভারতবাসী মাত্রই ঘরপোড়া গোরু। সরকারের এই ‘নিরীহ’ ঘোষণাটির মধ্যে স্বভাবতই তাঁরা সিঁদুরে মেঘ দেখতে পাচ্ছেন। আদর্শ পরিস্থিতি আর বাস্তব বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আলাদা। আদর্শ পরিস্থিতি যদি কুসুম কোমল হয়ে থাকে তো বাস্তবটা কঠিন কঠোর। মোদি জমানায় ব্যাপারটা আরও সন্দেহজনক। কারণ, কথার খেলাপে এই সরকার মাত্র সাতবছরে সর্বকালীন রেকর্ড গড়ে ফেলেছে। বহুচর্চিত, বছরে ২ লক্ষ চাকরি থেকে কালো টাকা উদ্ধার ও প্রত্যেক নাগরিকের অ্যাকাউন্টে ১৫ লক্ষ টাকা ক্রেডিট করা-সহ কত ধাপ্পা যে ধরা পড়ে গিয়েছে, তা গুনেগেঁথে রাখা দুঃসাধ্য।
তাহলে কোন কাণ্ডজ্ঞানে দেশবাসী বিশ্বাস করবে যে, এমএনপি একটি সৎ প্রকল্প? প্রতিরক্ষা-সহ নানা ক্ষেত্রে দুর্নীতির কালিমা যে সরকার মুছতে পারেনি, সেই সরকারের কাছে কতটা গ্যারান্টি প্রত্যাশিত যে এমএনপিতে কাঙ্ক্ষিত স্বচ্ছতা বজায় থাকবে! প্রকল্পটি তো কর্পোরেটদের নিয়েই। দেশ থেকে ভেগে যাওয়া ব্যাঙ্ক জালিয়াতদের সঙ্গে এই সরকারের মাখোমাখো সম্পর্কের কথাই আজ দেশজুড়ে চর্চার বিষয়। কংগ্রেস-সহ বিরোধীরা গোড়াতেই ‘এমএনপির আড়ালে বিবিধ রাষ্ট্রায়ত্ত সম্পদ বেচে দেওয়ার কৌশল’-এর বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন। বামপন্থীরা এটাকে ‘দেশ বেচে দেওয়ার চক্রান্ত’ নামে চিহ্নিত করেছেন। ব্যাঙ্ক, বিমা প্রভৃতি ক্ষেত্রে বেসরকারিকরণের পথে মোদি সরকার পা রেখেছে সবার আগে। এই ভয়ঙ্কর জনবিরোধী নীতির আঁচ এবার বাংলার বুকেও পড়তে চলেছে। কলকাতার টেলিফোন ভবন এবং কলকাতা ও জেলার একঝাঁক টেলিফোন এক্সচেঞ্জ বিক্রির প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গিয়েছে। বিক্রি হয়ে যাবে বিএসএনএল এবং এমটিএনএলের সম্পত্তিও। একমাত্র সরকারি টেলিফোন সংস্থাটির পুনরুজ্জীবনে কর্ণপাত না-করা সরকারের এই ভূমিকা কোনওভাবেই সন্দেহের ঊর্ধ্বে নয়, বরং অতীব নিন্দনীয়। মোদি সরকারের মতিগতি বাদবাকি রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলির সামনেও এক গভীর প্রশ্নচিহ্ন ঝুলিয়ে রাখছে।