একটি করমর্দনের মূল্য কত? সাদা চোখে, হাত মেলানোর জন্য কোনও মূল্য দিতে হয় না। দুই ব্যক্তি সৌজন্য দেখানোর জন্যই হাত মেলান। এটাই রীতি। আবার তিনি যদি হন ভারতের প্রধানমন্ত্রী! তাহলেও কি সযত্নে লালিত এই সৌজন্য বজায় থাকবে? প্রধানমন্ত্রীর নাম নরেন্দ্র মোদি হলে উত্তরটা হল ‘না’। রীতিমতো গাঁটের কড়ি খরচ করলে, তবেই প্রধানমন্ত্রী মোদির সঙ্গে করমর্দনের সুযোগ মিলবে। ঘুরপথে তাঁর বন্দনায় এই ‘সামান্য’ আয়োজনের জন্য কোটি কোটি টাকা খরচ করবে সরকার। সবটাই জনগণের করের টাকা। কত কোটি তা হয়তো কোনওদিনই জানা যাবে না। কিন্তু মোদি-পুজোয় এভাবে জলের মতো টাকা খরচ করার জেরে দেশের ২০ জন স্কুল পড়ুয়া প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে হাত মেলানোর সুযোগ পাবে। হয়তো সেই হাসি মুখের ছবি ছড়িয়েও পড়বে সরকারের উদ্যোগে। এও তো এক ধরনের রাজনৈতিক প্রচার। লোকে বলে, দুর্জনের ছলের অভাব হয় না। এক্ষেত্রে বাহানা অবশ্য অন্য। এর আগে মোদির জন্মদিনে তাঁকে ৫ কোটি পোস্ট কার্ড পাঠানোর উদ্যোগ নিয়েছিল ডাক বিভাগ। প্রধানমন্ত্রীর বন্দনায় সরকারি অর্থের এমন বিপুল অপচয় দেখে সেবার সোচ্চার হয়েছিল বিরোধীরা। কিন্তু তাতে কী! চক্ষু-কর্ণের বিবাদ ভঞ্জন করে এবারও একই পথে হাঁটার পরিকল্পনা নিয়েছে মোদি সরকারের যোগাযোগ মন্ত্রক। বাহানা তৈরি করতে এবার সামনে আনা হয়েছে পড়ুয়াদের। স্কুল পড়ুয়া! স্বাধীনতার ৭৫তম পূর্তির বছর চলছে। অতএব এই উপলক্ষকে সামনে রেখেই মোদি ভজনার পরিকল্পনা। ঠিক হয়েছে, নরেন্দ্র মোদিকে ৭৫ লক্ষ পোস্ট কার্ডে চিঠি লিখে পাঠাবে ছাত্রছাত্রীরা। প্রতিটি স্কুল ১০টি করে পোস্ট কার্ডে লেখা চিঠি পাঠাবে। এটা বাধ্যতামূলক। কোনও স্কুল এই নির্দেশ অমান্য করছে কি না তা দেখার জন্য মহকুমা স্তরে নোডাল অফিসার নিয়োগ করা হয়েছে। গোটা প্রক্রিয়ায় তাঁরা সজাগ দৃষ্টি রাখবেন। নিজ স্কুলের পড়ুয়াদের লেখা সেরা ১০টি চিঠি বাছাই করবেন স্কুল কর্তৃপক্ষ। এসবের নিট ফল কী? দেশের সেরা ২০ জন পোস্ট কার্ড লিখিয়ে পড়ুয়াকে বেছে নিয়ে তাদের পুরস্কৃত করা হবে। কী পুরস্কার? প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে করমর্দনের সুযোগ! মোদি ভজনার এই কর্মযজ্ঞে ৭৫ লক্ষ বাছাই করা পোস্ট কার্ড যাবে মোদির ঠিকানায়। তার মানে, এর কয়েকগুণ বেশি পোস্ট কার্ড লেখা হবে। একটি পোস্ট কার্ডের দাম ৫০ পয়সা। কিন্তু তা ছাপানো ও ডাক মারফত নির্দিষ্ট ঠিকানায় পাঠানোর খরচ অনেক বেশি। এর আগে অবশ্য বিপুল ক্ষতির বোঝা কমাতেই নাকি গোটা দেশে পোস্ট কার্ড ছাপানো অনেক কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। যার ফলে প্রায়ই ডাকঘরে হয় পোস্ট কার্ড অমিল। এই অভিজ্ঞতা বহু মানুষের। অথচ এখন ঘুরপথে মোদি বন্দনার জন্য সেই বিপুল টাকার বোঝাকেই আবার সাদরে ডেকে নিয়ে এসেছে যোগাযোগ মন্ত্রক। এসবই হয়েছে প্রধানমন্ত্রী অফিসের নির্দেশে। তা জনগণের করের টাকা হলেও এই অপচয় রুখবে কে?
চিঠি লেখার বিষয়বস্তুও হাস্যকর। প্রথমটিতে বলা হয়েছে, ২০৪৭ সালে তারা দেশকে কোথায় দেখতে চায়? অথবা বিস্মৃতির অতলে থাকা স্বাধীনতা সংগ্রামীদের নিয়ে চিঠি লিখতে হবে। সাত বছর ধরে দেশে মোদি জমানা চলছে। এ সময়ে তিনি দেশবাসীকে অনেক স্বপ্ন দেখিয়েছেন। কিন্তু দেশবাসীকে কোন উন্নত ভারত তিনি উপহার দিয়েছেন তা কারও অজানা নয়। মানুষ সুখে নেই। আছে নিত্যদিনের জীবনযন্ত্রণা। মোদির এখন পড়ন্ত সময়। তাঁর সরকারের ব্যর্থতায় মানুষ তিতিবিরক্ত। তাই ২০২৪-এর লোকসভা ভোটে এই শাসকের ফের নির্বাচিত হয়ে ফিরে আসার সম্ভাবনাও কমছে। কিন্তু দেশের প্রধানমন্ত্রী স্বপ্নবিলাসী। স্বপ্ন দেখাতে ভালোবাসেন। ছাত্রছাত্রীরাই-বা বাদ থাকে কেন? তাদেরকেও এবার তাঁর নিজস্ব পরিসরে আনার প্রচেষ্টা শুরু হল। প্রশ্ন উঠছে। না হলে কেন ২০৪৭ সালে তারা দেশকে কোথায় দেখতে চায় সে বিষয়ে চিঠি লিখতে বলা হল? আসলে তাও ‘স্বপ্ন’ দেখা। জনপ্রিয় হওয়ার অদম্য ইচ্ছাপূরণে এবার স্কুল পড়ুয়াদেরও আর বাদ রাখা গেল না! পড়ুয়াদের কাছে জনপ্রিয় হতেই কি এবার সেরা পত্রলেখকদের জন্য করমর্দনের এমন ব্যবস্থা? বলতে হয়, দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের জ্ঞানের দৌড় এই পড়ুয়াদের অধিকাংশের কতটুকুই-বা। যদি তা থাকেও তবু সেরা চিঠি বাছাইয়ের দায়িত্বে তো সরকার পক্ষই। হবে কি নিরপেক্ষ বিচার? নতুন এই বাহানা করে স্কুল পড়ুয়াদের প্রতিযোগিতার মধ্যে টেনে এনে আত্মপ্রচারের ব্যবস্থা করা হল সুকৌশলে।
অবশ্য ছাত্রছাত্রীদের চিঠি লেখায় উৎসাহিত করতে আগেও ডাক বিভাগ প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছে। কিন্তু তার উদ্দেশ্য নিয়ে কোনও প্রশ্ন উঠেনি। এবার উঠছে। কারণ দেশের মানুষ ইতিমধ্যে দেখেছেন মোদির জন্মদিনে তাঁর জয়ধ্বনি করে পোস্ট কার্ড পাঠানোর কর্মসূচি। এবার দেখতে চলেছে করমর্দন। রাজনৈতিক উদ্দেশ্য স্পষ্ট। পড়ুয়াদের শামিল করে মানুষের করের টাকায় সরকারি উদ্যোগে এমন মোদি পুজোর আয়োজনে চক্ষুলজ্জার বালাই নেই।