ব্যবসায় অগ্রগতি ও শুভত্ব বৃদ্ধি। ব্যয়ের চাপ থাকায় সঞ্চয়ে বাধা থাকবে। গলা ও বাতের সমস্যায় ... বিশদ
দেশের ছোট রাজ্যগুলির মধ্যে ত্রিপুরা অন্যতম। এ-হেন ত্রিপুরার পুরভোট নিয়ে ভিনরাজ্যের বাসিন্দাদের খুব একটা আগ্রহ থাকার কথা নয়। থাকেও না। কিন্তু, এবার ত্রিপুরা পুরভোটের প্রেক্ষিতটা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। বাংলায় সরকার গঠনে হ্যাটট্রিক করার পর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মোদি-বিরোধী অন্যতম মুখ হয়ে উঠেছেন। সেই সুযোগে তিনি অন্য রাজ্যেও তাঁর দলের নীতি ও আদর্শকে ছড়িয়ে দিতে চাইছেন। লক্ষ্য, ২০২৪ সালে বিজেপিকে ক্ষমতাচ্যুত করা। তার আগে ২০২৩ সালে ত্রিপুরার বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপিকে ধাক্কা দিয়ে ভিতটা নড়বড়ে করে দিতে চাইছেন মমতা। তবে, ত্রিপুরায় গুছিয়ে বসার আগেই এসে যায় পুরসভা নির্বাচন। পুরভোটে তৃণমূল লড়ার কথা ঘোষণা করা মাত্র ত্রিপুরা নিয়ে মানুষের আগ্রহের পারদ চড়তে থাকে।
বড় বাড়ি তৈরির আগে সয়েল টেস্ট করে তার ভার ধারণক্ষমতা যাচাই করা হয়। ত্রিপুরার পুরভোট তৃণমূলের কাছেও ছিল বড় অট্টালিকা তৈরির আগে সয়েল টেস্ট। বিজেপির লাগামছাড়া হুমকি সন্ত্রাস সত্ত্বেও আগরতলায় তৃণমূল দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই করেছে। তার ফলও পেয়েছেন। সিপিএমকে পিছনে ফেলে হয়েছে দ্বিতীয়। বলাই বাহুল্য, ত্রিপুরার মাটি পরীক্ষায় সসম্মানে উত্তীর্ণ জোড়াফুল।
চার বছর আগে ত্রিপুরার ক্ষমতা দখলের প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই সিপিএমের কোমর ভেঙে দিয়েছিল বিজেপি। পার্টি অফিস ভাঙচুর, আগুন লাগানো, কমরেডদের খুন করার পাশাপাশি বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দিয়েছিল লেনিনের মূর্তি। ফলে আতঙ্কে ময়দান থেকে হাওয়া হয়ে গিয়েছিল সিপিএম। সেই সুযোগে পঞ্চায়েতের ৯৬ শতাংশ আসন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় দখল করে নিয়েছিল বিজেপি।
ত্রিপুরার পুরভোট তৃণমূল কংগ্রেসের কাছে সয়েল টেস্ট হলেও সিপিএমের জন্য এই ভোট ছিল অ্যাসিড টেস্ট। বিজেপির অ্যান্টি ইনকামবেন্সি ফ্যাক্টরকে কাজে লাগিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগ বামেদের সামনে ছিল। কিন্তু সিপিএম সেই সুযোগ কাজে লাগাতে পারেনি। মানুষের আস্থা ফেরাতে ব্যর্থ হয়েছে। তার প্রমাণ, রাজ্যের রাজধানী শহরের নির্বাচনে তৃতীয় স্থানে দৌড় শেষ করেছে সিপিএম। অথচ পাঁচ বছর আগেও এই সিপিএমই ছিল ত্রিপুরার দণ্ডমুণ্ডের কর্তা।
বাংলার নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদি-অমিত শাহ জুটিকে পর্যুদস্তু করায় ভিনরাজ্যের মানুষের চোখেও মমতাই মোদি বিরোধী প্রধান মুখ। ত্রিপুরা পুরভোটের ফল সেটাই প্রমাণ করেছে। অথচ এই ত্রিপুরায় তৃণমূল পা রাখতেই সিপিএম এবং কংগ্রেস নেতৃত্ব রে-রে করে উঠেছিল। সুজন চক্রবর্তী এবং অধীর চৌধুরীরা ‘বিজেপির সুবিধে করে দিতে মমতা বিরোধী ভোট ভাগ করতে চাইছেন’ এই ফাটা রের্কডটি লাগাতার বাজিয়ে গিয়েছেন। কিন্তু, আগরতলা জানিয়ে দিল, কংগ্রেস যতই নিজেদের বিজেপির ‘বিশুদ্ধ প্রতিপক্ষ’ বলে দাবি করুক না কেন, তাদের ভোট মাত্র এক শতাংশ। আর সিপিএমের স্থান তৃণমূলের পিছনে। এরপর তৃণমূল বলতেই পারে, বিজেপি যাতে কঠিন প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখে না পড়ে তার জন্যই কংগ্রেস এবং সিপিএম পরিকল্পিতভাবে মমতাকে আটকাতে চাইছে।
বিজেপি বিরোধী লড়াইয়ে মমতার সঙ্গে এঁটে উঠতে না পারায় সিপিএম বারবার ঘেঁটে দেওয়ার চেষ্টা করেছে। বাংলার বিধানসভা ভোটের আগে ‘বিজেমূল’ থিওরি বাজারে ছেড়ে মানুষের মনে সন্দেহের বীজ পুঁতে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু মানুষ বিশ্বাস করেনি। তাই বাংলায় ভরাডুবির জন্য ‘বিজেমূল’ থিওরি ভুল ছিল বলে স্বীকার করলেও সিপিএম সেখান থেকে কিছুতেই বেরিয়ে আসতে পারছে না। সেইজন্য আগরতলা পুরভোটে থার্ড হওয়ার পিছনেও সিপিএমের কেউ কেউ বিজেপির যোগসাজশে তৃণমূল দ্বিতীয় হয়েছে বলে দাবি করেছেন। এভাবে বালিতে মুখ গুঁজে সিপিএম সত্যকে আড়ালের চেষ্টা যত করবে, ততই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যাবে।
মুম্বইয়ে গিয়ে মমতা তাঁর রণনীতি স্পষ্ট করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘যেখানে কংগ্রেস সমঝোতা করেছে কিংবা লড়াই করতে পারছে না, সেখানে লড়াই করব। সেখানে বিজেপিকে বাড়তে দেব না।’এটা যে কথার কথা নয়, সেটা তাঁর কাজের ধারাতেই স্পষ্ট।
এখনও পর্যন্ত তৃণমূল সুপ্রিমো যে সমস্ত রাজ্যে সংগঠন গড়ার উদ্যোগ নিয়েছেন, প্রতিটিই বিজেপি শাসিত। বিজেপিকে বেগ দেওয়ার মতো অবস্থায় কংগ্রেস নেই। কারণ বলিষ্ঠ নেতৃত্বদানে অক্ষমতা। তার ফলে বিজেপির ওয়াকওভার প্রায় নিশ্চিত। মমতা সেই সব জায়গায় ‘বিনাযুদ্ধে নাহি দিব সূচ্যগ্র মেদিনী’ মানসিকতা নিয়ে বিজেপিকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিতে চাইছেন। আর যেখানে শক্তিশালী বিজেপি বিরোধী দল আছে, সেখানে তিনি সেই দলকেই সমর্থন করছেন।
উত্তরপ্রদেশে বিজেপি বিরোধী তিনটি দলের মধ্যে অখিলেশ যাদবের পার্টিই সর্বাধিক শক্তিশালী। তাই মমতা তাঁর দলকেই সমর্থন করছেন। বিজেপির ভোট ভাগ করা মমতার উদ্দেশ্য হলে তিনি কংগ্রেসকে সমর্থন করতেন। তাতে কংগ্রেসকে খুশি করা যেত, আর বিজেপিরও সুবিধে হতো। কিন্তু, মমতা অখিলেশের পাশেই দাঁড়িয়েছেন। কারণ এখনও পর্যন্ত উত্তরপ্রদেশে বিজেপির প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী মুলায়ম পুত্রই। মায়াবতী ও কংগ্রেস অনেকটাই পিছনে।
কেউ বলতেই পারেন, উত্তরপ্রদেশে তৃণমূল কংগ্রেসের কোনও অস্তিত্বই নেই। তাই মমতা সেখানে কাকে সমর্থন করলেন বা বিরোধিতা করলেন, তাতে কিছু যায় আসে না। কিন্তু আমার বিশ্বাস, মমতার সমর্থন অখিলেশ যাদবকে উত্তরপ্রদেশের ভোটে অনেকটা এগিয়ে দেবে। আর অখিলেশ সেটা বুঝেছেন বলেই উত্তরপ্রদেশেও মমতার স্টাইলে ‘খেলা হবে’ স্লোগান তুলে শুরু করে দিয়েছেন লড়াই।
ভোটের রেজাল্ট যে কোনও রাজনৈতিক দলের জনসমর্থনের মাপকাঠি। ত্রিপুরাতে তৃণমূল নির্বাচনে লড়বে শুনে শুধু সিপিএম নেতারাই নন, এরাজ্যের অনেকেই ভেবেছিলেন, মমতার দল কিস্যু করতে পারবে না। কিন্তু, অনেক ভয়ভীতি, মারধর সত্ত্বেও আগরতলার ২০শতাংশ ভোটার তৃণমূলকে ভোট দিয়েছেন। স্রেফ মমতা-ম্যাজিকে। বাংলার পাশাপাশি জাতীয় রাজনীতিতেও মমতার নামের পাশে ‘ম্যাজিক’ শব্দটি জুড়ে যাচ্ছে।
বিজেপির বাড়বাড়ন্ত ঠেকানোর জন্য তৃণমূলনেত্রী বহুবার বামেদের সহযোগিতা চেয়েছেন। চিঠি লিখে বা গোপনে দূত পাঠিয়ে নয়, প্রকাশ্যে। তাতে বামেরা তাঁকে দুর্বল ভেবে ভুল করেছে। সিপিএম নেতাদের কথায় স্পষ্ট হয়েছে ক্ষমতা তাঁদের ছেড়ে চলে গেলেও দম্ভ কমেনি একটুও। সেই কারণেই তাঁরা বলতে পারেন, ‘বিজেপির মোকাবিলার জন্য মমতার হাত ধরার দরকার হবে না। বামেরাই যথেষ্ট।’
হলফ করে বলতে পারি, ত্রিপুরা পুরভোটের আগে বিজেপির বিরুদ্ধে একজোট হয়ে লড়ার প্রস্তাব দিলে বামেদের কাছ থেকে একই উত্তর আসত। তাই মমতার সামনে একটা রাস্তাই খোলা ছিল, নিজের শক্তি প্রমাণের। আর সেটা তিনি করে দেখিয়েছেন।
প্রতিপক্ষ দুর্বল হলে শাসক দলের সুবিধে হয়। এরাজ্যে কংগ্রেসের মতো দুর্বল দল প্রতিপক্ষ ছিল বলেই বামেরা নিশ্চিন্তে ৩৪ বছর রাজ্য শাসন করার সুযোগ পেয়েছিল। উত্তরোত্তর ভোট বাড়িয়ে চলেছিল। ত্রিপুরাতেও সিপিএম ও কংগ্রেস বিরোধী থাকলে সেখানেও পশ্চিমবঙ্গের পুনরাবৃত্তি ঘটত না, এমন গ্যারান্টি কেউ দিতে পারবে না। কিন্তু সূচনালগ্নেই তৃণমূলের এই উত্থান বিপ্লব দেবের কপালে ভাঁজ ফেলার জন্য যথেষ্ট।
ত্রিপুরা কার দখলে যাবে, সেটা ভবিষ্যৎই বলবে। তবে শূন্য থেকে একলাফে কুড়িতে পৌঁছে মমতা বুঝিয়ে দিয়েছেন, তাঁর দলকে বাদ দিয়ে ত্রিপুরায় বিজেপি বিরোধী লড়াই অসম্ভব। মোদি বিরোধী লড়াইয়ে মমতাকে এগিয়ে যাওয়ার সাহস জুগিয়েছে ত্রিপুরা। ‘ডাকাবুকো’ মমতা হয়েছেন আরও সাহসী। শুরু করে দিয়েছেন ২০২৪ সালে মহারণের প্রস্তুতি। তাই এখনই শুরু হয়েছে বাংলার বাঘিনীকে আটকানোর মরিয়া চেষ্টা।