ব্যবসায় অগ্রগতি ও শুভত্ব বৃদ্ধি। ব্যয়ের চাপ থাকায় সঞ্চয়ে বাধা থাকবে। গলা ও বাতের সমস্যায় ... বিশদ
তবে চিরদিনই সমাজে কিছু নিন্দুক থাকেন। আজকের মতো সেদিনও তাঁরা অনেকেই বলেছিলেন, কংগ্রেসের এই ভাঙন আখেরে রাজ্যের বামফ্রন্ট সরকারের হাতকেই শক্ত করবে। তাঁদের যুক্তি ছিল, এর ফলে রাজ্যে বাম বিরোধী ভোট প্রায় সমগোত্রীয় দু’টি দলের মধ্যে আড়াআড়ি ভাগ হয়ে যাবে। বিরোধীরা টুকরো হলে ভোটারও নানা সংশয়ে ভোগে, যা থেকে সবসময়ই লাভ হয় শাসকের। ফলে ভোট ভাগের অভিশাপে এ রাজ্যের বাম সরকারকে আর কোনওদিনই হারানো যাবে না, সেদিন এমনই ছিল রাজনৈতিক পণ্ডিতদের যুক্তি। সেই হিসেব কিন্তু মোটেই মেলেনি। পাটিগণিতকে হারিয়ে জয় হয়েছিল শাসক বিরোধী রসায়নের। বরং সেদিন তৃণমূল জন্ম না নিলে বাংলার রাজনীতি আজ এক পঙ্কিল নালায় পরিণত হতো, এটাই আজ প্রতিষ্ঠিত সত্য।
১৯৯৮ সালের পর যত সময় গিয়েছে ততই আমরা দেখেছি যা খোলা চোখে ভোট ভাগ বলে মনে হচ্ছিল তা আসলে সিপিএম বিরোধী মঞ্চকে নতুন করে আরও শক্তিশালী ও সঙ্ঘবদ্ধ করারই নামান্তর মাত্র। উল্টে প্রমাণ হয়েছে, সেদিন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যদি নতুন দল না গড়ে পুরনো জায়গাতেই পড়ে থাকতেন তাহলে বাংলার রাজনীতি একটা ছোট্ট নালাতে আটকে যেত। পরিবর্তন, পালাবদল শব্দগুলি আমাদের অভিধান থেকে ক্রমেই হারিয়ে যেত। লাল পার্টির কেষ্টবিষ্টুরা আজও বুক ফুলিয়ে দাপিয়ে বেড়াতেন। চোখের উপর গণতন্ত্রকে হত্যা করতেন। বামেদের হাতে ভোট লুট আর সন্ত্রাসের ধারাবাহিক নাটক দেখতে দেখতেই শৈশব থেকে বার্ধক্য কেটে যেত এ রাজ্যের সাধারণ মানুষের। ২০১১ সালের ঐতিহাসিক পালাবদল আর দেখা হতো না। আরও প্রমাণ হয়ে গিয়েছে, রাজনীতিতে সব সময় যেমন দুই দুই চার হয় না, তেমনি নেতৃত্ব যদি যোগ্য হয়, তাঁর দাবিতে বিশ্বাসযোগ্যতা থাকে, তাহলে ভোট ভাগাভাগির অঙ্কও সবসময় মেলে না। উল্টে যোগ্য নেতা থেকে সতর্ক ভোটার সবাই ছোটে প্রকৃত রাজনৈতিক বিকল্পের দিকেই।
পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূলের মানুষের পাশে দাঁড়ানোর রাজনীতি এই একটা কারণেই গত কয়েক দশক টানা জয়ী। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মানুষের আস্থা অর্জন করতে পেরেছিলেন এবং এখনও ভোটারের আস্থা তাঁর আঁচলে বাঁধা বলেই চলতি একুশ সালে বিধানসভা দখলের লড়াইতেও কেউ এতটুকু আঁচড় কাটতে পারেননি। ভোট ভাগাভাগির সুযোগ নিয়ে বামফ্রন্ট সরকার সেদিন বেশিদিন টেকেনি। আর আজ জাতীয় স্তরে বিজেপিও মমতার উত্থানে প্রমাদ গুনছে। তৃণমূল তার রাজনৈতিক যাত্রা শুরু করার পর এরাজ্যের দুর্জয় ঘাঁটিতে বামেদের সরকার স্থায়ী হয়েছিল আর মাত্র ১৩ বছর। শেষ কয়েক বছর ক্ষমতায় থাকলেও ভিত নড়ে গিয়েছিল আগেই। এটাই ঐতিহাসিক সত্য! আর বিরোধীরা এবার প্রকৃত অর্থে মমতার নেতৃত্বে দিল্লিতে ঐক্যবদ্ধ হলে মোদি সরকারের আয়ু কতদিন, সেটাই এখন লাখ টাকার প্রশ্ন। সেই অর্থে ২৩ বছর পথ চলার পর এক আশ্চর্য সমাপতনের সামনে মমতার রাজনীতি। বাংলা থেকে যে উড়ান দিল্লি জয়ের জন্য আজ প্রস্তুত।
জাতীয় রাজনীতি আজ কিন্তু ১৯৯৮ সালের বাংলার মতোই এক ভয়ঙ্কর সন্ধিক্ষণের সামনে দাঁড়িয়ে। অবিলম্বে ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদ গর্জে না উঠলে ভারতীয় সংবিধানের অন্তরাত্মাই দ্রুত খতম হয়ে যাবে এক গুজরাতির হাতে। খসে পড়বে আমাদের ধর্মনিরপেক্ষতার অহঙ্কার। সংসদীয় রাজনীতির বৃত্তে সবাইকে সঙ্গে নিয়ে চলার যত্নে লালিত মতাদর্শ। বদলে পদে পদে বিভাজন ডেকে আনছে এক অদ্ভুত বিপন্নতা। ধর্মীয় বিপন্নতার সঙ্গে হাত ধরাধরি করেই চলে আর্থিক সঙ্কট। থমকে যায় উন্নয়ন। কংগ্রেস নামক যে মঞ্চ এতদিন অধিকাংশ আঞ্চলিক দলকে একটা সুতোয় গেঁথে রাখত, সেই শতাব্দীপ্রাচীন দলটা নেতৃত্বের অপদার্থতায় আজ কোথায় যেন চোরাগলিতে হারিয়ে গিয়েছে। অন্যদলকে চুম্বকের মতো ধরে রাখার ক্ষমতা দূরঅস্ত, ধরে রাখা যাচ্ছে না দলের নেতা কর্মীদেরও। দলের মধ্যেই ২৩ জন প্রথম সারির নেতার ফুঁসে ওঠা উপদল কোন ভাঙনের ইঙ্গিত। কংগ্রেস মুক্ত ভারতের আড়ালে কিছু গেরুয়া নেতা যা খুশি করার লাইসেন্স পেয়ে যাবেন, এ জিনিস কোনওমতেই মেনে নেওয়া যায় না। কৃষক থেকে শ্রমিক খেটে খাওয়া মানুষ প্রতিবাদে গজরাচ্ছে, কিন্তু সবার প্রতিবাদকে চুম্বকে আটকে সরকারকে নড়িয়ে দেওয়ার মতো ঢেউ উঠছে না। এই সঙ্কটে যদি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সলতে পাকানোর কাজটা করতে এগিয়ে আসেন, তাতে অসুবিধা কোথায়?
আর এইখানেই একেবারে বাম শাসনে পশ্চিমবঙ্গের ‘রিপ্লে’ হচ্ছে যেন! পরিস্থিতিটা ১৯৯৮ সালের পশ্চিমবঙ্গের মতো একপেশে। সেদিনের বাংলার মতো আজ দেশে বিরোধী শিবির দুর্বল। দেশের সবচেয়ে প্রাচীন ঐতিহ্যশালী কংগ্রেস কার্যত রাজ্যে রাজ্যে অস্তিত্ব সঙ্কটে। উত্তরপ্রদেশে দীর্ঘদিনই পায়ের তলার মাটি নেই। পাঁচ বছর আগে যোগীরাজ্যে বিধানসভা ভোটে তাদের জুটেছিল মাত্র পাঁচটা আসন। এবার কেঁদে ককিয়েও কেউ জোট করতে রাজি হচ্ছে না। কংগ্রেসের সঙ্গে হাত মেলান মানেই সর্বনাশ, এই বিশ্বাস থেকেই কেউ ওপথ মাড়াচ্ছেন না। ফলে একলাই লড়তে হবে নুইয়ে পড়া দলটাকে। পাঞ্জাবে মনে করা হয়েছিল সোনিয়া গান্ধী ও তাঁর দল হেলায় বাজিমাত করবে, কিন্তু সেখানেও ভোটের মুখে ক্যাপ্টেন অমরিন্দর দল ছেড়েছেন। সিধু আর নতুন মুখ্যমন্ত্রী চান্নি কী চাইছেন, তা বোঝা ভগবানেরও অসাধ্য। কিন্তু এর মাঝখান দিয়ে দলটা তিন শিবিরে ভেঙে গেলে লাভ কার? বিগত বিধানসভা নির্বাচনে পাঞ্জাবে কংগ্রেস পেয়েছিল ৩৮.৫ শতাংশ ভোট, দ্বিতীয় স্থানে ছিল আপ। পেয়েছিল ২৩ শতাংশ ভোট। তাই কংগ্রেস তিনভাগে ভাঙলে হিসেবটা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে কে জানে! মনে রাখতে হবে, উত্তরপ্রদেশে ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটে কংগ্রেস পেয়েছিল মাত্র ৬ শতাংশ ভোট। সেখান থেকে খুব বেশি ঘুরে দাঁড়ানোর পরিস্থিতি আজও নেই। পশ্চিমবঙ্গে রাহুল গান্ধীর দলের অবস্থা নিয়ে তো আলাদা করে বলার কোনও অর্থই হয় না। রাজ্যে রাজ্যে এভাবেই কংগ্রেসের ভোট ও গ্রহণযোগ্যতা যত কমছে ততই বিকল্প শক্তি হিসেবে উত্থান হচ্ছে তৃণমূলের। এমনকী নেত্রীর সঙ্গে দেখা করতে আসছেন একদা বাজপেয়ি আদবানির রাজনৈতিক কৌশল নির্ধারণের প্রধান চালিকাশক্তি সুধীন্দ্র কুলকার্নির মতো প্রবীণ নেতাও। তাঁর ক্ষমতাকে স্বীকার করতে বাধ্য হচ্ছে সঙ্ঘ পরিবারও।
দু’সপ্তাহ আগেই স্বীকারোক্তিটা শুরু হয়েছিল আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবতকে দিয়ে। তিনি বাংলায় বিজেপির হারের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেছিলেন, বাংলা থেকে নির্বাচিত ১৮ জন এমপির দু’বছরের কাজ মানুষের মনে দাগ কাটতে পারেনি। অথচ রেলমন্ত্রী হিসেবে মমতা যা করেছেন তার উজ্জ্বল স্মৃতি এখনও বাংলার মানুষের মনে আষ্টেপৃষ্টে গেঁথে রয়েছে। ভাগবতের ওই কথারই প্রায় প্রতিধ্বনি শোনা গেল সম্প্রতি দিল্লিতে বিজেপির পোড় খাওয়া এমপি সুব্রহ্মণ্যম স্বামীর কথাতেও। দিল্লিতে মমতার সঙ্গে কথা বলতে এসে তিনি বাংলার জননেত্রীর সঙ্গে তুলনা করে বসলেন, মোরারজি দেশাই, জয়প্রকাশ, চন্দ্রশেখর, নরসীমা রাওয়ের মতো প্রধানমন্ত্রীর আসন অলঙ্কৃত করা ব্যক্তিত্বের সঙ্গে। স্বামীর এই কথার ইঙ্গিত একটাই, দিল্লির ক্ষমতার অলিন্দেও পালাবদল হতে পারে একমাত্র মমতার নেতৃত্বেই। গেরুয়া শিবিরের পক্ষ থেকে এই সারসত্যটাকে স্বীকার করে নেওয়া কম তাৎপর্যপূর্ণ নয়।
রাজনীতিতে অসম্ভব বলে কিছু হয় না। আগামী দিনে জাতীয় রাজনীতির অভিমুখ কোনদিকে মোড় নেবে তা সময়ই বলবে, কিন্তু যে আশা ও বিশ্বাসের সঞ্চার আজ মরা গাঙে বাংলার নেত্রী করেছেন তাই বা কম কীসে। বিশেষত বাঙালি হিসেবে দেশের বিরোধী শক্তিকে সামনে থেকে চালিত করার এই কীর্তিও বড় কম নয়! বাংলায় ২৩ বছর আগে যা সম্ভব হয়েছে। এবার জাতীয় রাজনীতিতে তা আর একবার প্রমাণিত হওয়ার সুসময় উপস্থিত। সেদিন জ্যোতি বসুকে গদিচ্যুত করার মতো বাংলায় কেউ ছিল না। ধূমকেতুর মতো এসে উত্তরোত্তর এরাজ্যের সিপিএম বিরোধী ভোটকে সুসংগঠিত করার দায়িত্ব নিয়েছিলেন তিনি। আজ তারই যেন প্রতিধ্বনি জাতীয় রাজনীতিতেও। গোটা দেশে ঝিমিয়ে পড়া বিরোধীদের শুকনো গাঙে তিনি তাঁর স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে বিপ্লবের নয়া কেতন উড়িয়ে দিয়েছেন। ত্রিপুরা থেকে গোয়া। এমনকী মেঘালয়ে মুকুল সাংমাও ১৭ জনের মধ্যে ১২ জন বিধায়ককে নিয়ে যেভাবে কংগ্রেস ছেড়ে তৃণমূলে যোগ দিয়েছেন তাতে একটা জিনিস প্রমাণিত হচ্ছে, জাতীয় রাজনীতির মঞ্চেও মমতাই আজ মোদির সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য প্রতিপক্ষ। মানুষও মানছে, মোদিকে শিক্ষা দিতে পারবেন একমাত্র কালীঘাটের ওই অগ্নিকন্যাই।
ভুললে চলবে না, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সৌভাগ্য কিন্তু সর্বদা সাহসীর পক্ষই নেয়। তাঁর কপালেই বিজয়তিলক এঁকে দেয়। এক্ষেত্রেও...।