ব্যবসায় অগ্রগতি ও শুভত্ব বৃদ্ধি। ব্যয়ের চাপ থাকায় সঞ্চয়ে বাধা থাকবে। গলা ও বাতের সমস্যায় ... বিশদ
২০১৭-র ১৭ জুন। হোয়াইট হাউসের লনে সাংবাদিকদের মুখোমুখি মোদি। বক্তব্য রাখার জন্য মোদি যখন তৈরি, ঠিক তখনই দমকা হাওয়ায় উড়ে যায় ডায়াসে রাখা বক্তৃতার কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কাগজ। প্রথম সারিতে তখন ভারতের বিদেশ সচিব এবং ভারতীয় রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে বসেন অজিত দোভাল। চোখের পলকে দৌড়ে গিয়ে উড়ে যাওয়া সেই কাগজ তুলে এনে সযত্নে ডায়াসে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। সেদিন বক্তব্য রাখতে কোনও অসুবিধা হয়নি মোদির। এমন তুচ্ছ ঘটনাকে বেশিরভাগ সাংবাদিক কোনও পাত্তা না দিলেও, একটি ইংরেজি পত্রিকা সেদিন লিখেছিল, হোয়াইট হাউস ইভেন্টে কীভাবে প্রধানমন্ত্রী মোদিকে উদ্ধার করেছিলেন দোভাল।
প্রধানমন্ত্রী হওয়ার অনেক আগে থেকেই মোদির সঙ্গে দোভালের ঘনিষ্ঠতা। দোভাল তখন বিবেকানন্দ ফাউন্ডেশনের প্রধান। সঙ্ঘ পরিবারের অনুগত। অনেকেই বলেন, গোয়েন্দা ব্যুরো থেকে অবসর নেওয়ার পরে তিনি বিজেপি এবং নরেন্দ্র মোদিকে পর্দার আড়ালে থেকে অনেক সাহায্য করেছেন। একসময় বিজেপির ঘনিষ্ঠ স্বামীনাথন গুরুমূর্তি টুইট করে বলেছিলেন, ‘দোভাল ছত্রপতি শিবাজি এবং ভগৎ সিংয়ের সমসাময়িক সংস্করণ।’ তাঁর বর্ণময় কেরিয়ারে মিলেছে পুলিস মেডেল, প্রেসিডেন্ট মেডেল, কীর্তিচক্র। দোভালকে ঘিরে তৈরি হয়েছে মিথের বলয়। ‘প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ’—এই রক্ষাকবচ তাঁকে ঘিরে রাখে সব সময়। মোদি সরকারে মন্ত্রিসভা সমতুল্য পদ মর্যাদার জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা। ক্রমেই সমান্তরাল ক্ষমতার কেন্দ্রও হয়ে উঠেছেন অজিত দোভাল।
অবসরপ্রাপ্ত আইএএস অফিসার এম জি দেবসহায়মের কথায়, ‘১৯৬৮ সালের ৩/৪ জুলাই মুসৌরির ন্যাশনাল অ্যাকাডেমি অব অ্যাডমিনিস্ট্রেশনে ভারতের সংবিধানের প্রতি আনুগত্যের শপথ নিয়েছিলাম দু’জনই। সেদিন, দোভাল পুলিস পরিষেবা এবং আমি ভারতীয় প্রশাসনিক পরিষেবাতে প্রবেশ করেছিলাম। কিন্তু কখনওই উদ্ভট মতবাদটি কল্পনা করতে পারিনি, যা বলেছেন অজিত দোভাল।’ সম্প্রতি হায়দরাবাদে সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল ন্যাশনাল পুলিস অ্যাকাডেমির অনুষ্ঠানে তিনি বলেছেন, নাগরিক সমাজই এখন নতুন যুদ্ধক্ষেত্র। চতুর্থ প্রজন্মের যুদ্ধক্ষেত্র। দেশের নাগরিক সমাজই জাতীয় নিরাপত্তার ক্ষেত্রে বড় বিপদ হয়ে উঠতে পারে!
দোভালের এই মন্তব্য নতুন করে বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। বিশেষত এমন একটা সময়ে এই কথাগুলো বলেছেন, যার কিছু দিন আগেই খোদ সুপ্রিম কোর্ট বলেছে, জাতীয় নিরাপত্তার জুজু দেখিয়ে রাষ্ট্র অবাধ ছাড়পত্র পেতে পারে না। সাম্প্রতিক অতীতে বারবারই নাগরিক সমাজের বিরোধী স্বরকে দমন করার অভিযোগ উঠেছে বর্তমান শাসক শিবিরের বিরুদ্ধে। বিরোধী রাজনীতিকে দুর্বল ও বিভক্ত করার জন্য শাসকদের চেষ্টার কোনও বিরাম নাই। তার জন্য অর্থের লোভ, ক্ষমতার আকর্ষণ, প্রশাসনিক তদন্ত ও হানাদারির ভয় এবং মামলার চাপ— ছল-বল-কৌশলের কোনও ঘাটতি রাখা হয়নি। জেএনইউ, জামিয়া মিলিয়া, শাহিন বাগ, দিল্লি সংঘর্ষ, কৃষক আন্দোলন থেকে হালের পেগাসাস— অসংখ্য ঘটনায় নাগরিক সমাজের গণতান্ত্রিক অধিকারের উপরে দমননীতি চাপানো হয়েছে বলে ঘরে-বাইরে সমালোচিত হয়েছে মোদি সরকার। এই অন্ধকার সময়েই নাগরিক সমাজের বিভিন্ন স্তর থেকে উঠে এসেছে প্রতিবাদ। কৃষক আন্দোলন এই মুহূর্তে তার সর্বোত্তম দৃষ্টান্ত। আর সেই কৃষক আন্দোলনের সমর্থনে টুইট করলেই তাকে দাগিয়ে দেওয়া হয়েছে দেশবিরোধী ষড়যন্ত্র বলে। বিরোধীস্বরকে স্তব্ধ করতে শাসকদের মুখে ‘আরবান নকশাল’, ‘আন্দোলনজীবী’ ইত্যাদি গালিগালাজের অন্ত নেই। সমাজে বিদ্বেষ এবং বিভাজনের বীজ ছড়িয়ে দেওয়ার কাজটা অনেক বেশি করেছে গেরুয়া শিবিরই। এই প্রেক্ষাপটে দোভাল যে ভাবে নাগরিক সমাজকে কার্যত বিপজ্জনক বলে চিহ্নিত করলেন, তা চলতি বিতর্কে নতুন মাত্রা যোগ করেছে।
মনে করুন, যদি এমন হয় যে, দেশের সমস্ত জটিল সমস্যার মোকাবিলা করা হয় হিংস্র গা-জোয়ারি দিয়ে? যদি অগণিত মানুষের অসহায়তাকে চাপা দেওয়া হয় ধর্মীয়-গোষ্ঠীগত নিরাপত্তার ভুয়ো আতঙ্কের তলায়? যদি ধর্ম-রাজনীতি-রাষ্ট্র-প্রশাসন মিলেমিশে বানিয়ে নেয় এক অখণ্ড নিটোল গুন্ডামি আর বুজরুকির আসর? তখনই বোঝা যায়, এসে পড়েছে সেই কুৎসিত সময়, যখন আমাদের মস্তিষ্ক ও চেতনায় কামড়ে ধরে থাকবে ক্ষমতার প্রতি এক ভীতিমাখা আকর্ষণ, এবং ক্ষমতাহীন মানুষের প্রতি লুকোনো অযৌক্তিক ঘৃণা। আমাদের দেশ সম্ভবত আজ তেমনই এক প্রবল ঢেউয়ে আক্রান্ত। এখনই তো সিভিল সোসাইটির মৌলিকতম প্রশ্নগুলো তোলার আসল সময়! সমাজের নৈতিক বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন। রাষ্ট্রের নৈতিক বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন। ধর্মের নৈতিক বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন। আমাদের সমগ্র নাগরিক অস্তিত্বের মূল শিকড়গুলোর বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন। অজিত দোভালরা আর সেই সব প্রশ্ন শুনতে নারাজ। ভয়টা সেখানেই!
জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হওয়ার কয়েক মাস আগে, দোভাল এক গভীর দর্শন নিয়ে হাজির হয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘আমরা শত্রুকে তিনটি পদ্ধতিতে আটকানোর চেষ্টা করি। একটি হল প্রতিরক্ষামূলক। ঠিক যেমন চৌকিদাররা করেন। অপরটি আত্মরক্ষামূলক-আক্রমণাত্মক। আত্মরক্ষার জন্য, আমরা সেই জায়গায় যাই যেখান থেকে অপরাধ সংগঠিত হয়। আমরা এখন ডিফেন্সিভ মোডে...।’ ক্ষমতার খেলায় চূড়ান্ত ন্যায়বিচার তাঁর কাছেই থাকে যিনি শক্তিশালী। এটি ছিল কাশ্মীরে প্রয়োগ করা দোভালের ‘সামরিক মতবাদের’ বৈশিষ্ট্য।
যে মতবাদে বুলেট, প্যালেট গান, মানব ঢাল— লক্ষ্য একটাই, যে কোনও উপায়ে জয়লাভ করা। রক্ত বয়ে গেলে, শিশুরা মারা গেলে বা অন্ধ হয়ে গেলে, সন্তানহারা মা কেঁদে উঠলে, মানুষ যদি ভোট না দেয়— তাতেও কিছু যায় আসে না। রাষ্ট্রকে আরও বেশি করে সামরিক শক্তি দিয়ে, এমনকী তার নিজের জনগণের উপরেই সেই শক্তি প্রয়োগ করে জয়ী হতে হবে। বিশিষ্ট আইনজীবী এজি নুরানির মতে, দোভাল মতবাদের অন্যতম প্রধান স্তম্ভ ‘নৈতিকতার অপ্রাসঙ্গিকতা’। যদি প্রয়োজন হয়, নিজেকে রক্ষা করাই হবে তাঁর সর্বোচ্চ ভূমিকা। এই নৈতিকতার দৃষ্টিভঙ্গিতেই তাঁর নতুন নাগরিক সমাজের মতবাদ। তাঁর কাছে রাষ্ট্রই প্রধান। জনগণ নয়। দোভালের ভাষণে এটা স্পষ্ট— সংবিধান, গণতন্ত্র এবং সুশীল সমাজ সম্পর্কে তাঁর আলাদা ধারণা রয়েছে। তিনি মনে করেন, ভারত এখনও একটি ঔপনিবেশিক রাজতন্ত্র, যেখানে জনগণ প্রজা মাত্র। অথচ, আমাদের সংবিধান ‘দ্য পিপলস অব ইন্ডিয়া’ শব্দ দিয়েই শুরু এবং এমন একটি সমাজকে সংজ্ঞায়িত করা হয়, যেখানে নাগরিকরা সার্বভৌম। দোভাল কীভাবে তরুণ পুলিস অফিসারদের ‘দ্য পিপলস অব ইন্ডিয়া’-কে শত্রু হিসেবে বিবেচনা করতে এবং তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে বলেন তা তিনিই জানেন। মনে হয়, সমস্ত প্রতিবাদ ও প্রশ্নকে তিনি রাষ্ট্রদ্রোহ বলে মনে করেন, যে কোনও বিরোধিতাকে দমন করার ব্যগ্রতায় গণতন্ত্রের ন্যূনতম শর্ত লঙ্ঘনেও তাঁর আপত্তি নেই।
এই সেই দোভাল, যাঁর ‘যো হো গয়া সো হো গয়া’— এই গভীর তাৎপর্যপূর্ণ বাক্য উপদেশ হিসেবে ঝরে পড়তেই, দিল্লির দাঙ্গাদীর্ণ মানুষ বড়ই প্রশান্তি লাভ করেছিলেন। ‘যো হো গয়া সো হো গয়া’ মন্ত্রোচ্চারণের মাধ্যমে কোন কোন যন্ত্রণা দিল্লিবাসীদের ভুলতে হয়েছে? স্বজন হারানো, প্রচুর টাকার ব্যবসা ধ্বংস হয়ে রাতারাতি কপর্দকশূন্য হয়ে যাওয়া, মাথা গোঁজার আশ্রয়টুকু হারিয়ে যাওয়া, স্কুল পুড়ে যাওয়ার ফলে পঠনপাঠন অনির্দিষ্ট কালের জন্য স্থগিত হয়ে যাওয়া ইত্যাদি। যে গভীর দার্শনিক বোধ, যে ললিত শান্তির বাণী এই বাক্যবন্ধটিতে সম্পৃক্ত আছে, তার দ্বিতীয় তুলনা কোথায়! ভবিষ্যতেও এই অসামান্য বাণী একইরকম ভাবে জনগণকে সমৃদ্ধ করবে। ব্যাঙ্ক লাটে উঠে সঞ্চিত সব অর্থ গায়েব হলে, স্বল্প সঞ্চয়ে সুদের হার তলানিতে ঠেকলে, জীবনদায়ী ওষুধ ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেলে যদি ভাবা যায় ‘যো হো গয়া...’, তবে গোটা দেশে অনাবিল শান্তি বিরাজ করবে! এর মতবাদের জন্য অজিত দোভালকে কৃতিত্ব দিতেই হবে।
নিরাপত্তা উপদেষ্টা তাঁর ভাষণের মধ্য দিয়ে যে সঙ্কেত দিতে চেয়েছেন, তা হল, পুলিস তথা নিরাপত্তা বাহিনীকে জাতীয় স্বার্থ রক্ষার নামে নাগরিক সমাজের প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ দমনে ‘তৎপর’ হওয়ার সঙ্কেত। নাগরিক সমাজকে রাষ্ট্রের অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ বা প্রতিরোধ কর্মসূচি দমন করার, অর্থাৎ শাসকের ‘অনুগত’ থাকার সঙ্কেত। স্পষ্টতই, এই সঙ্কেতের প্রথমটি দমন-পীড়নে নিরাপত্তা বাহিনীকে অবাধ ছাড়পত্র, দ্বিতীয়টি হুঁশিয়ারি। দুয়ে মিলে এক ভয়ঙ্কর আশঙ্কা জেগে ওঠে। গণতন্ত্রের শ্বাসরোধ করার আশঙ্কা।
দোভালের পূর্বসূরিদের নিজস্ব স্টাইল ছিল। তাঁরা স্বাধীনভাবে কাজ করতেন। তাঁদের কেউই কোনও মেরুকরণ মতাদর্শের প্রতি অনুগত ছিলেন না এবং ভিন্নমতাবলম্বীদের ‘শত্রু’ হিসেবে বিবেচনা করার মানসিকতাও তাঁদের ছিল না। এই শেষ পর্যায়ে দোভাল তাঁর পূর্বসূরিদের পথ অনুসরণ করলেই ভালো। যদি তাঁর কোনও বিশেষ ‘চতুর্থ-প্রজন্মের যুদ্ধের’ দক্ষতা থাকে, তাহলে তিনি সুশীল সমাজকে টার্গেট না করে, দেশের অভ্যন্তরে বিশেষ করে গোবলয়ের বন্দুকধারীদের দখল করা এলাকাগুলিতে তা প্রয়োগ করুন।
জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার কাজ দেশবাসীকে রক্ষা করা। গভীর পাঁকে আটকে যাওয়া গেরুয়া শিবিরকে উদ্ধার করা নয়!