ব্যবসায় অগ্রগতি ও শুভত্ব বৃদ্ধি। ব্যয়ের চাপ থাকায় সঞ্চয়ে বাধা থাকবে। গলা ও বাতের সমস্যায় ... বিশদ
নির্দিষ্ট সময় অন্তর শিক্ষা পরিস্থিতির উপর যে বার্ষিক রিপোর্টগুলি (এএসইআর) প্রকাশিত হয় আমি সেসব অভিনিবেশসহকারে অনুসরণ করেছি। আমাদের কাছে ২০১৮ এবং ২০২০-র রিপোর্ট ছিল। গত ১৭ নভেম্বর প্রকাশিত হয়েছে ২০২১-এর এএসইআর রিপোর্ট।
মোটামুটি একই সময়ে প্রকাশিত হয়েছে জাতীয় পরিবার স্বাস্থ্য সমীক্ষা-৫ (২০১৯-২১) রিপোর্ট। এটা এনএফএইচএস-৪ এর প্যাটার্ন মেনেই তৈরি করা। ফলে তুলনার পক্ষে সহায়ক। এএসইআর ২০২১ এবং এনএফএইচএস-৫ নামক রিপোর্ট দুটিতে ভারতের বাস্তব চিত্র উঠে এসেছে। ব্যাপারটা বিএসই সূচক বা নিফটি সূচকের মতো কেবলমাত্র শ’খানেক তালিকাভুক্ত কোম্পানির স্বাস্থ্যচিত্র প্রকাশ করে না। এই রিপোর্টগুলি সপ্তাহ দুই যাবৎ পাবলিক ডোমেইনে রয়েছে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রী কিংবা স্বাস্থ্যমন্ত্রীর কেউই এই দুটি বিষয়ে কথা বলেছেন বলে মনে করতে পারছি না।
দুটি রিপোর্ট, মূল উপসংহার
রিপোর্ট দুটি মহামারীর প্রভাব মূল্যায়ন করেছে। একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনার ফলাফল হিসেবে ধরে নিয়ে এই দুটিকে পাশ কাটিয়ে যাওয়া যাবে না। রিপোর্টের উপসংহার হতাশাজনক। পর্যবেক্ষণের উল্লেখযোগ্য দিকগুলি তালিকাভুক্ত করলাম:
এএসইআর ২০২১ (গ্রামীণ):
১. বেসরকারি থেকে সরকারি স্কুলে পড়ুয়াদের সরে যাওয়ার ব্যাপারটা স্পষ্ট হয়েছে।
২. শিশুদের ‘টিউশন’ নেওয়ার প্রবণতা ক্রমাগত বাড়ছে।
৩. স্মার্টফোন বেশি লোকের হাতে দেখা যাচ্ছে বটে কিন্তু সেগুলি শিশুরা প্রয়োজনে ব্যবহার করতে পারছে কি না সেই প্রশ্নটি থাকছে।
৪. স্কুল আবার খোলার পর বাড়িতে লানিং সাপোর্ট কমেছে।
৫. শিশুদের জন্য শিক্ষার উপকরণের জোগান বেড়েছে সামান্যই।
এনএফএইচএস ২০১৯-২১:
১. মোট উর্বরতার হার (ইংরেজিতে যেটাকে টোটাল ফার্টিলিটি রেট বলে) ২.০-তে পৌঁছেছে (প্রতিস্থাপন হারের সামান্য নীচে)। কিন্তু তিনটি রাজ্যের জনসংখ্যা (সবচেয়ে দরিদ্রদের মধ্যেও) উচ্চ হারে বাড়ছে।
২. গত পাঁচ বছরে জন্ম নেওয়া শিশুদের মধ্যে সেক্স রেশিও বা লিঙ্গ অনুপাত কমে ৯২৯ (পুরুষের অনুপাতে মহিলা)-এ নেমে এসেছে। কেন এমনটি হল, ব্যাখ্যা পাওয়া মুশকিল।
৩. শৌচাগার, পরিবেশ-বান্ধব জ্বালানি এবং স্বাস্থ্য সংক্রান্ত সমস্যাগুলি লক্ষ লক্ষ পরিবারের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়েই রয়েছে।
৪. মৃত্যুর হার কমছে। কিন্তু কমে গিয়েও এতটাই বেশি রয়েছে যে তা কাম্য নয়।
৫. খর্বাকৃতির সমস্যা, স্বাস্থ্যহানি এবং রক্তশূন্যতা শিশুদের জন্য গুরুতর চ্যালেঞ্জ।
স্বাস্থ্য বিষয়ক উপসংহারের দ্বিতীয় সেটের পাশাপাশি রাখা হল শিক্ষার প্রথম সেটের উপসংহার। যে-কোনও দেশের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ যে শিশুরা ভারতে তারাই অবহেলিত। অথচ, এই বিষয়ে পাবলিক ডিসকাশন কানেই আসে না। একান্তভাবেই তাদের কল্যাণের লক্ষ্যে তৈরি হয়েছে যে মহিলা ও শিশু উন্নয়ন মন্ত্রক, মনে হয় যে সেটিও সুখনিদ্রায় মগ্ন।
অসমতা বাড়ছে
মানুষের বিভিন্ন শ্রেণির মধ্যে বৈষম্য সব দেশেই দেখা যায়। প্রধান পার্থক্যটি গড়ে দিয়েছে আয় এবং সম্পদ। ভারতে এই পার্থক্যগুলি আরও বেড়েছে ধর্ম এবং বর্ণের কারণে। সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে বঞ্চিত গোষ্ঠীর মানুষজনই সবচেয়ে দরিদ্র এবং সর্বাধিক বেকারও তাদের মধ্যে। তারাই রাষ্ট্র কর্তৃক বৈষম্যের শিকার এবং অবহেলিত। অন্যান্য শিশুদের তুলনায় এইসব শ্রেণির পিতামাতার শিশুদের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের হাল আপনি কল্পনা করতে পারেন।
এএসইআর এবং এনএফএইচএস ধর্ম বা বর্ণ ভিত্তিক কোনও গণনা বা ডেটা বিশ্লেষণ করেনি। সব শিশু সম্পর্কে একসঙ্গেই এগুলি করা হয়েছে। আসুন, দেখা করা যাক সমসাময়িক ভারতে কী ধরনের শিশুরা বেড়ে উঠছে, বিশেষ করে যখন দেশে মহামারীর প্রভাব প্রবল। আমার উপসংহার হল:
> দম্পতিদের সন্তান সংখ্যা কম, কিন্তু তাঁরা মোটামুটি সমান সংখ্যায় পুত্র ও কন্যা সন্তানের জন্ম দিচ্ছেন না। যখন সার্বিকভাবে নারী-পুরুষের স্বাস্থ্যকর অনুপাত ১০২০ রয়েছে, তখন ০-৫ বছরের মধ্যে সেটি উদ্বেগজনকভাবে ৯২৯-এ নেমে এসেছে। এই সংখ্যাটি নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। এটি কঠোরভাবে যাচাই করা উচিত। প্রবণতাটি সঠিক হলে কিন্তু একটি বড় উদ্বেগের বিষয়।
> সবচেয়ে গরিব তিনটি রাজ্য খারাপভাবে শাসন করা হচ্ছে। ওই রাজ্যগুলিতে জাতীয় গড়ের চেয়ে বেশি হারে জনসংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। তার মানে, দরিদ্র রাজ্যে অধিক সংখ্যক শিশু যুক্ত হচ্ছে। মনে হচ্ছে, দারিদ্র্য দূরীকরণ ব্যবস্থার রূপায়ণ এই রাজ্যগুলিতে ব্যর্থ হয়েছে।
> লম্বা-চওড়া দাবি সত্ত্বেও, উন্মুক্ত স্থানে মলত্যাগের সমস্যা থেকে ভারত এখনও মুক্তি পায়নি। বিনামূল্যে সিলিন্ডার স্কিম (এখন উজ্জ্বলা বলা হয়) সম্পর্কে যে সাফল্য সরকারের তরফে দাবি করা হয় তা ঠিক নয়।
> স্বাস্থ্য পরিকাঠামো এবং স্বাস্থ্য পরিষেবার উন্নতি হলেও মা ও শিশুর স্বাস্থ্যের দিকটি এখনও অবহেলিত। আমরা এমন পরিস্থিতি মেনে নিতে পারি না যেখানে অনেক শিশু জন্মের সময় (প্রতি হাজারে ২৪.৯), শৈশবকালে (৩৫.২) এবং প্রথম পাঁচ বছরের মধ্যে (৪১.৯) মারা যাচ্ছে।
> এরপর যারা বেঁচে থাকে সেই শিশুদের জন্য পুষ্টি একটি বড় চ্যালেঞ্জ। খর্বকায় হওয়ার সমস্যা (৩৫.৫ শতাংশ), ভগ্নস্বাস্থ্য (১৯.৩) এবং পুষ্টির ঘাটতির (৩২.১) মতো ক্ষেত্রগুলিতে এই বিষয়টি উদ্বেগজনকভাবে উচ্চ শতাংশে ধরা পড়েছে।
> ২০২০-২১ এবং ২০২১-২২ সালে ‘শেখার ক্ষেত্রে ক্ষতি’ যা হয়েছে সেটি বিপুল। বিশ্বব্যাপী স্কুল বন্ধের গড় যেখানে ৩৫ সপ্তাহ সেখানে সংখ্যাটি ভারতের ক্ষেত্রে ৭৩ সপ্তাহ। পরিবারের এক স্থান থেকে অন্য জায়গায় চলে যাওয়া এবং অভিভাবকের আর্থিক অনটনের কারণে বহু শিশু বেসরকারি স্কুল থেকে সরকারি স্কুলে নাম লিখিয়েছে। এই যে নতুন পড়ুয়ারা আসছে তাদের জায়গা দেওয়ার ক্ষমতা সরকারি স্কুলগুলির আছে কি না সন্দেহ রয়ে যায়। বহু শিশুকে একাধিক স্তরের ক্লাস রুমে বসে থাকতে দেখা গিয়েছে। যখন স্কুল বন্ধ ছিল তখন মাত্র ৩৯.৮ শতাংশ ছেলেমেয়ে লার্নিং মেটেরিয়াল (বই খাতা প্রভৃতি) পেয়েছিল। রিডিং দেওয়া এবং পাটিগণিতের জ্ঞান মিলিয়ে শিক্ষার যে ভিত (ফাউন্ডেশনাল স্কিল) ধরা হয়, সেটি দুর্ভাগ্যজনকভাবে কম পাওয়া গিয়েছে। অর্থাৎ ছেলেমেয়েরা যে স্তর বা ক্লাসের পড়ুয়া তাদের এই ভিত সেই তুলনায় অনেকটাই নড়বড়ে।
প্রধানমন্ত্রী, মুখ্যমন্ত্রী এবং কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারগুলি কি আমাদের শিশুদের স্বাস্থ্য ও শিক্ষার এই উদ্বেগজনক পরিস্থিতি সম্পর্কে কিছু চিন্তাভাবনা করবেন এবং বলবেন?
লেখক সাংসদ ও ভারতের প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী। মতামত ব্যক্তিগত