ব্যবসায় অগ্রগতি ও শুভত্ব বৃদ্ধি। ব্যয়ের চাপ থাকায় সঞ্চয়ে বাধা থাকবে। গলা ও বাতের সমস্যায় ... বিশদ
ভাঙনও শুরু হয় নানা স্বার্থের সংঘাতে। আজ
ইউপিএ তৈরির ১৭ বছর পর জাতীয় রাজনীতির প্রেক্ষিতটাই আমূল বদলে গিয়েছে। সেই কারণেই কংগ্রেসের মতো ইউপিএ’রও আজ দ্রুত প্রয়োজন ফুরচ্ছে। আন্দোলন বিমুখ কংগ্রেসের ছাতার তলায় আজ আর কোনও আঞ্চলিক দলই সেভাবে আশ্রয় নিতে ইচ্ছুক নয়। একমাত্র অস্তিত্বসঙ্কটে নুইয়ে পড়া কিছু বাম দল ছাড়া। অথচ সিপিএমই ২০০৮ সালে সমর্থন প্রত্যাহার করে ইউপিএ সরকারকে ফেলে দিতে উদ্যত হয়েছিল। আর ভাগ্যের কী পরিহাস, আজ তারাই মমতাকে কটাক্ষ করছে, নেত্রী ‘ইউপিএ এখন আর নেই’ বলায়। ক্রমেই পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে, হীনবল কংগ্রেস আর ছন্নছাড়া বাম শক্তি আজ একে অপরের পরিপূরক।
কিন্তু দেশের সবচেয়ে পুরনো রাজনৈতিক শক্তির আজ এই হতশ্রী দশা কেন? এর একটাই উত্তর যোগ্য নেতৃত্বের অভাব। প্রধানমন্ত্রীর ছেলেও ক্ষমতার লড়াইয়ে একলাফে শীর্ষ আসনে সবসময় বসতে পারেন না। গাভাসকরের ছেলে গাভাসকর হয়নি! উত্তরাধিকার সূত্রে সম্পত্তি মিললেও যোগ্যতা, নেতৃত্ব, রাস্তায় নেমে অক্লান্ত প্রতিবাদের উত্তরাধিকার রক্তের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হয় না। ওটা লড়ে অর্জন করতে হয়। কী রাজনীতি, কী ব্যবসা আর কী খেলাধুলা জীবনের সব ক্ষেত্রেই এটাই ষোলোআনা সত্যি! কোটিপতি ব্যবসায়ী মারা গেলে তাঁর ছেলে সহজেই বিপুল সম্পত্তির মালিক হলেও ব্যবসা যে আগের মতো ফুলে ফেঁপে চলবে তার গ্যারান্টি নেই! যোগ্যতাটা কখনও উত্তরাধিকার সূত্রে মেলে না। ওটা যার যার নিজস্ব। অর্জন করতে হয়। রাস্তায় নেমে বুঝে নিতে হয় শত্রুর হিসেব। আর ওইখানেই হেরে যাচ্ছে কংগ্রেস দল। রাহুল গান্ধীর মধ্যে বাবা রাজীব গান্ধী কিংবা ঠাকুমা ইন্দিরার ব্যক্তিত্ব ও নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতার ছিটেফোঁটাও দেখতে পাচ্ছে না দেশের মানুষ। মোদি জমানায় একের পর অগণতান্ত্রিক আঘাতে সাধারণ মানুষের পিঠ দেওয়ালে ঠেকে গিয়েছে। কাজ নেই, মূল্যবৃদ্ধি আকাশছোঁয়া, তার ওপর হিন্দুত্বের নামে পদে পদে বিভাজন। মোদি নামক খামখেয়ালি নেতার অবিরাম বুলডোজারে মানুষের প্রাণ অতিষ্ঠ। মানুষ ফুঁসছে, কিন্তু গ্রহণযোগ্য বিকল্প নেই বলেই প্রতিবাদ করার সাহস পাচ্ছে না। এমনকী কৃষক প্রধান পাঞ্জাবেও দল আজ টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে। এটা কার অদূরদর্শিতার পরিচয়?
আসলে দেশের নেতা হতে গেলে খিদে লাগে। নেতা হওয়ার খিদে, এগিয়ে যাওয়ার খিদে এবং অবশ্যই শত্রুকে খতম করার সঙ্কল্প। সেইসঙ্গে শাসকের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে আন্দোলনকে তীব্র করার শপথ। নরেন্দ্র মোদি আজও ওই খিদের জোরেই দেশটাকে চালনা করছেন। কিন্তু বুকে হাত দিয়ে বলুন তো গুরুত্বপূর্ণ উত্তরপ্রদেশ নির্বাচনের আগে কংগ্রেস নেতৃত্বের মধ্যে কোথাও সেই তাগিদ দেখছেন? রাহুল গান্ধীকে কতবার লখনউ থেকে বারাণসী ছুটতে দেখা গিয়েছে গত ৬ মাসে। পশ্চিমবঙ্গের ভোটে কবার এসেছেন রাজীব পুত্র। হ্যাঁ প্রিয়াঙ্কা উত্তরপ্রদেশে ঘুরছেন বটে, তবে আহামরি কিছু নয়। অখিলেশ কিংবা রাষ্ট্রীয় লোকদল মোটেই এই কংগ্রেস নেতৃত্বের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধতে রাজি নয়। উল্টে মমতাকেই নেত্রী মানছেন মুলায়ম পুত্র। বলছেন কংগ্রেস শূন্য পাবে। কেন? ২০১৭ সালে সোনিয়ার দলের সঙ্গে জোট করে তারা ডুবেছিল, সেই তিক্ত অভিজ্ঞতা এখনও অখিলেশকে তাড়া করছে। তাই ওই ফুটো নৌকায় আর নয়!
আর এই খানেই প্রশ্ন, যোগ্যতা না থাকলেও খামোকা একজনকে নেতা হিসেবে টানা কেন? একটা জিনিস খুব পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে, কংগ্রেস নামক শতাব্দী প্রাচীন দলটার পরিবার ছাড়া গতি নেই। দলের মধ্যে ২৩ জন শিক্ষিত নেতা যতই চিঠি লিখুন, আড়ালে আবডালে ক্ষোভ উগরে দিন, সাড়ে সাত ঘণ্টা ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকের পর অসুস্থ স্টপগ্যাপ সভানেত্রী বলবেন, এবার দলে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নির্বাচন হবে। কিন্তু তারপরও মাসের পর মাস কেটে গেলেও সেই দিনটা আর আসবে না। আবার সেই অসুস্থ সোনিয়া আর তাঁর দুই অযোগ্য সন্তানের হাতেই দলের ভবিষ্যৎ বন্ধক দিয়ে ছ’মাসের জন্য সবাই ঘুমিয়ে পড়বে। অপেক্ষা করবে কখন বিরোধী রাজনীতির পালে হাওয়া লাগে। তাহলেই লাফিয়ে এসে আবার নেতা হতে হবে যে! কে জানে ফাঁকতালে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সুযোগটাও চলে আসতে পারে। তাই ভোট এলেই শীতঘুম ভেঙে চারপাশটা একটু ঝালিয়ে নেওয়া, এটাই নেহরু গান্ধী পরিবারের এখন একমাত্র কর্তব্য।
কিন্তু আঞ্চলিক দলগুলি আর সেই সুযোগ দিতে রাজি নয়। বিগত সাত দিনে জাতীয় রাজনীতি কয়েক কদম এগিয়ে গিয়েছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মুম্বই সফর এবং ত্রিপুরার পুরভোটের ফল চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে মানুষ বিজেপি ও নরেন্দ্র মোদির বিকল্প চাইছে, কিন্তু পাচ্ছে না। কংগ্রেস এই মুহূর্তে মোদি বিরোধী জোটের আত্মাকে বহন করতে অপারগ। তাহলে কী হবে? আল্লার নাম করে
সবাই রণে ভঙ্গ দেবে? না কংগ্রেসকে ছাড়াই
এগিয়ে যাবে। ভোটের ফল বেরলে তারপর দেখা যাবে কার দম কত। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ইউপিএ বলে কিছু নেই বলায় অনেকের গোঁসা হয়েছে। কিন্তু আমার প্রশ্ন, গত দু’বছরে যখন বিরোধীরা ক্রমাগত কোণঠাসা, তখন কংগ্রেস হাইকমান্ড নামক বায়বীয় নেতৃত্ব ক’টা বৈঠক করেছে শরিকদের সঙ্গে।
তাঁদের ভালোমন্দের খোঁজ ক’বার নিয়েছে। দলের বৈঠকই হয় না, নেতাদের ক্ষোভ বিক্ষোভ শোনা হয় না, তা আবার ইউপিএ’র বৈঠক! আগামী এক বছরে অনেক গুরুত্বপূর্ণ রাজ্যের ভোট আছে। সেই সব রাজ্যের ভোট কৌশল নিয়ে দলে কিংবা ইউপিএতে ক’টা বৈঠক হয়েছে, হিসেব আছে?
ইতিহাস বলছে, ইউপিএ কিন্তু ভোটের আগে তৈরি হয়নি। ২০০৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে অপ্রত্যাশিতভাবে কংগ্রেস যখন দেখল সরকার গড়ার একটা সুযোগ সামনে এসেছে তখন ইউপিএ জন্ম নিয়েছিল। কংগ্রেস সেবার জিতেছিল ১৪৫টি আসন। অর্থাৎ সরকার গড়তে গেলে বাইরে থেকে আরও অন্তত ১২৭ সদস্যের সমর্থন দরকার ছিল। কাজটা মোটেই সহজ ছিল না। ইউপিএ গঠনের পরের সপ্তাহেই ২২ মে শপথ নিয়েছিলেন মনমোহন সিং। মূলত বামপন্থীদের কাঁধে ভর করেই ইউপিএ’র পথ চলা শুরু। অথচ ২০০৮ সালে সেই বামপন্থীরা অদ্ভুতভাবে নাকে কাঁদুনি কেঁদে ইউপিএ ভেঙে বেরিয়ে গিয়েছেলেন। যদিও জোটের ভাঙন শুরু হয় ক্ষমতায় আসার দু’বছরের মধ্যেই টিআরএসের সমর্থন প্রত্যাহারের মধ্যে দিয়ে। এরপর ইউপিএ ছাড়ে ভাইকোর এমডিএমকে। আর ২০০৮-এ জোট ছেড়ে বেরিয়ে যায় সিপিএম তথা বামপন্থীরা। সেই যাত্রায় সরকারকে সঙ্কট থেকে বাঁচিয়ে ছিলেন দু’জন। মুলায়ম সিং যাদব ও প্রয়াত সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়। সিপিএম নামক হার্মাদ দলটা সেদিন ইউপিএ’র ত্রাতা হয়ে দাঁড়ানোর অপরাধে সোমনাথবাবুকে বহিষ্কার করেছিল। সেই আক্ষেপ বুকে নিয়েই সোমনাথবাবুর মৃত্যু হয়েছে। আর মুলায়ম সিং যাদবের দলের নিয়ন্ত্রণ আজ পুত্র অখিলেশের হাতে। প্রিয়াঙ্কা গান্ধী সহ কংগ্রেস নেতৃত্ব চাইলেও উত্তরপ্রদেশে জোট করতে রাজি নন মুলায়ম-পুত্র। কারণটা কী? অখিলেশ যাদবের পরামর্শদাতাদের বক্তব্য, এই মুহূর্তে রাহুল-প্রিয়াঙ্কার সঙ্গে জোট করে লড়লে উত্তরপ্রদেশে বিরোধী শক্তিরই ক্ষতি। রাষ্ট্রীয় লোকদল পর্যন্ত প্রিয়াঙ্কার প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছে। আসলে একটার পর একটা আঞ্চলিক শক্তি তাদের অভিজ্ঞতা দিয়ে বুঝতে পারছে কংগ্রেসের সঙ্গে যাওয়া মানে সাড়ে সর্বনাশ। পাঞ্জাবে কেজরিওয়ালের আপও শতাব্দী প্রাচীন দলটার সঙ্গে হাত মেলানোর চেয়ে একা লড়তে এত উৎসাহী কেন? কেন জোট করে মহারাষ্ট্রে সরকার গড়লেও বর্ষীয়ান শারদ পাওয়ার রাহুল- প্রিয়াঙ্কার সমর্থনে একটি বাক্যও উচ্চারণ করছেন না। আর পশ্চিমবঙ্গের কথা না হয় বাদই দিন। কে না জানে এরাজ্যে কংগ্রেসের সঙ্গে জোট করে লড়া মানে নিজের রাজনৈতিক ভিত্তিটাকে আরও সঙ্কটে ফেলা। সিপিএম তথা বামেদের এখন উভয়সঙ্কট। তাই সব জেনেও বার বার দলটা পাঁকে পা ডুবিয়ে মরছে।
কিন্তু রাস্তায় নেমে নরেন্দ্র মোদির মতো শক্তিশালী পরিশ্রমী নেতার মুখোমুখি লড়তে দেশ তাই একজন স্ট্রিট ফাইটার খোঁজে। আর এই মুহূর্তে এই লড়াইয়ের পক্ষে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের চেয়ে আদর্শ মুখ আর কে আছেন। তাই মুম্বই, গোয়া যেখানেই তিনি যান একরাশ খোলা বাতাস, একটা অদম্য লড়াইয়ের সঙ্কল্প সঙ্গে যায়। মুম্বইয়ের অনেক ঠোঁটকাটা বিদ্বজ্জনকেও তাঁর সামনে হাজির হয়ে বলতে হয়, আপনার উপরই দেশের আস্থা। পারলে আপনিই পারবেন প্রতিমুহূর্তে গণতন্ত্রের এই নির্মম হত্যা রুখে দিতে। এই আস্থা ও বিশ্বাসটা অর্জন করতে হয়। বংশানুক্রমে কিংবা কোনও দৈব আশীর্বাদে মেলে না। মমতা তা পেরেছেন। দিদাকে দেখতে যাওয়ার অছিলায় লড়াইয়ের ময়দান ছেড়ে মাঝে মাঝেই ইতালি পালিয়ে গেলে ওই বিশ্বাস হারিয়ে যায়। আর ফেরে না। গুরুতর অসুস্থ জেনেও সোনিয়া গান্ধীকে এই কঠিন সময়ে সভানেত্রী করে রাখার একটাই অর্থ, এখানে পরিবার আগে তারপর দল ও দেশ। পরিবার সর্বস্ব এমন দলের পক্ষে মোদি বিরোধী জোটের মুখ হওয়া কি আর সম্ভব। তাই সব আঞ্চলিক দলকে এক হতে হবে। তারপর ভোটের ফল বেরলে ঠিক হবে নেতৃত্ব দেবে কে। নাহলে পচাশামুকে পা কাটবে, লাভের লাভ কিছুই হবে না।