ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব দেব ভূত দেখছেন। তৃণমূল কংগ্রেসের ভূত। ছ’মাস আগে মমতার রাজ্যে জোড়াফুলের ঝড়ে তাঁর বঙ্গজ কাউন্টারপার্টদের চোখে সর্ষেফুল দেখতে হয়েছিল। সেটা ছিল ক্ষমতা দখলের স্বপ্নভঙ্গের হাহাকার। ত্রিপুরায় সেই তৃণমূলের কাছেই ক্ষমতা হারানোর ভয়ে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন বিজেপির মুখ্যমন্ত্রী। তা না-হলে ২০২২-এর বিধানসভা ভোটের এক-দেড় বছর আগে থেকেই কেউ তৃণমূলের নিধনযজ্ঞ শুরু করে দেয়? তাও এমন প্রকাশ্যে? নির্বিচারে এবং আদালতের নির্দেশকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে! ত্রিপুরায় ২৫ নভেম্বর রাজধানী আগরতলা-সহ বেশ কয়েকটি পুরসভার ভোট। তাই ক্ষমতা ধরে রাখতে উন্মত্ত, হিংস্র হয়ে উঠেছে গেরুয়া বাহিনী। তাদের দলকে ‘যোগ্য সঙ্গত’ করছে বিপ্লবের পুলিস। চারবছর আগে রাষ্ট্রশক্তিকে পূর্ণমাত্রায় ব্যবহার করে ত্রিপুরায় প্রথমবারের জন্য ক্ষমতা দখল করেছিল বিজেপি। ২৫ বছরের বাম অপশাসনের স্মৃতি ভুলিয়ে দিয়ে রাজ্যকে উন্নয়নের পথে এগিয়ে নিয়ে যাবেন তরুণ মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব দেব—সেদিন এমনটাই ভেবেছিলেন ত্রিপুবাসী। কিন্তু সেই আশা ভাঙতে সময় লাগেনি। গত চারবছরের ইতিহাস ও তথ্য বলছে, মোদির শাসনে দেশ আর বিপ্লবের শাসনে ত্রিপুরা সামগ্রিক অবক্ষয়ের বিচারে হাতে হাত ধরে চলছে। দেখতে দেখতে আরও একটা নির্বাচন ঘাড়ের কাছে নিঃশ্বাস ফেলায় পরাজয়ের আতঙ্কে কাঁটা হয়ে রয়েছে বিপ্লব বাহিনী। একথা ঠিক, ত্রিপুরায় বামেদের অবস্থা অনেকটা পশ্চিমবঙ্গের মতোই। তাদের মিছিল-মিটিংয়ে লোক হলেও ভোটের বাক্সে এখনও বিশ্বাসযোগ্যতা তৈরি হয়নি। কংগ্রেসের অবস্থা তথৈবচ। তাদের পক্ষে নিজস্ব শক্তিতে বা বামেদের সঙ্গে জোট বেঁধে হয়তো কিছু করা সম্ভব নয়। এই রাজনৈতিক অঙ্কে একফালি পরিষ্কার আকাশ দেখছিলেন বহু অপকীর্তির নায়ক বিপ্লব দেব। কিন্তু তৃণমূল যেন সব ওলটপালট করে দিয়েছে। মমতার গড় বাংলায় জয়ের রণডঙ্কা বাজিয়ে যেদিন আগরতলায় পা রেখেছিলেন জোড়াফুলের নেতারা, কার্যত সেই শুরুর দিন থেকেই শুরু হয়েছে তাঁদের উপর নির্মম হামলা। ত্রিপুরায় বিপ্লব দেবের জল মাপতে যেদিন তৃণমূলের পরামর্শদাতা আই প্যাকের প্রতিনিধিরা আগরতলায় পা রেখেছিলেন সেদিনই করোনা বিধির অছিলায় তাঁদের শহরে ঢুকতে বাধা দেওয়া হয়। তারপর থেকেই একের পর এক ঘটনা, হামলা আক্রমণ। বিরোধী কণ্ঠরোধের আপ্রাণ প্রচেষ্টা। দিনের আলোয় এমন বেপরোয়া হামলা সেখানে সন্ত্রাসের পরিবেশ তৈরি করেছে। অথচ তৃণমূল-সহ বিরোধী প্রার্থীদের নিরাপত্তার যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার দায়িত্ব ত্রিপুরা পুলিস এবং প্রশাসনকে নেওয়ার জন্য শীর্ষ আদালতের নির্দেশ ছিল। যা হেলায় অমান্য করা হচ্ছে বলে অভিযোগ। সঙ্গত কারণেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, ত্রিপুরার পরিস্থিতি অগ্নিগর্ভ। বিরোধীদের গণতান্ত্রিক অধিকার খর্ব করা হচ্ছে পদে পদে।
গদি হারানোর ভয়ে আতঙ্কিত ত্রিপুরার গেরুয়া সরকার যে সত্যিই সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশও অমান্য করছে রবিবারের ঘটনাতেই তা পরিষ্কার। তৃণমূলকে ঠেকাতে গেরুয়া বাহিনী এতটাই বেপরোয়া হয়ে উঠেছে যে রবিবার দু’বার তারা থানায় সশস্ত্র হামলা চালিয়েছে। তৃণমূলের অভিযোগ, দলদাস পুলিসের সামনেই দাপিয়ে বেড়িয়েছে দুষ্কৃতীরা। থানায় ঢুকে হয়েছে গাড়ি ভাঙচুর, মারধর। এমন ন্যক্কারজনক ঘটনার প্রেক্ষিতে নিন্দার ভাষা নেই। আশ্চর্যজনকভাবে গ্রেপ্তার করা হয়েছে তৃণমূলের যুবনেত্রী সায়নী ঘোষকে। সায়নীর বিরুদ্ধে ‘খুনে প্ররোচনা’ দেওয়ার মামলা দিয়েছে বিপ্লবের পুলিস। ‘খেলা হবে’ বলার অপরাধেই কি এমন ফরমান? প্রশ্ন উঠছে। একটি রাজ্যের পুরসভা নির্বাচনের আগেই যা-সব ঘটছে তা সেখানকার সুস্থ গণতান্ত্রিক পরিবেশ রক্ষার দৃষ্টান্ত হতে পারে না। তৃণমূল শীর্ষ আদালতের দ্বারস্থ হয়েছে। স্বাভাবিক কারণেই ত্রিপুরার ঘটনা নিয়ে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক স্তরে তৎপরতা শুরু করেছে তৃণমূল। হামলার প্রতিবাদে দিল্লিতে তৃণমূল সাংসদরা সঙ্গত কারণেই ধর্নায় বসেছেন।
আসলে যে-কোনও প্রকারে বিরোধীদের, বিশেষত তৃণমূলের রাজনৈতিক প্রচার কর্মকাণ্ডে বাধাসৃষ্টিই বিপ্লব প্রশাসনের এখন ধ্যানজ্ঞান। ‘খেলা হবে’ একটি জনপ্রিয় রাজনৈতিক স্লোগান। বাংলার নির্বাচনে এই রাজনৈতিক স্লোগানটি বিশেষ মাত্রা পেয়েছিল। এই স্লোগানের ভূতও বিপ্লব বাহিনীকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে। বোঝাই যাচ্ছে এই স্লোগানটাও তাঁরা সহ্যই করতে পারছেন না। তাই স্লোগান দেওয়ার অপরাধে ত্রিপুরাতে আক্রমণের শিকার হচ্ছেন তৃণমূলের সমর্থকরা। এমন ঘটনা কল্পনা করা সত্যি কষ্টসাধ্য। সর্বোপরি অবাধ ও শান্তিপূর্ণ প্রচার কর্মসূচি যাতে বাধা না-পায় সে-ব্যাপারে আদালতের স্পষ্ট নির্দেশ থাকলেও বিপ্লবের রাজ্যে তা যেন নিছকই কথার কথা। এর জন্য তাদের কোনও লজ্জা, বিকারও নেই। প্রতিপক্ষের একটি রাজনৈতিক স্লোগান সহ্য করার মানসিকতাটুকুও হারিয়ে বসেছে গেরুয়া বাহিনী! বরং যেন ‘বেশ করেছি’ মনোভাব ওই সরকারের। এমন মনোভাব গণতন্ত্রের পক্ষে বিপজ্জনক। প্রশ্ন হল, এসব নষ্টামি করে কি শেষপর্যন্ত গদি রক্ষা হবে? কারণ বিপ্লব দেবের অপশাসনে বিরক্ত ত্রিপুরার জনগণের মধ্যে ‘ধীর কিন্তু দৃঢ় পদক্ষেপে’ জনপ্রিয় হচ্ছে দিদির দল।