উপার্জন বেশ ভালো হলেও ব্যয়বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে সঞ্চয় তেমন একটা হবে না। শরীর খুব একটা ... বিশদ
মৃত ভাইয়ের আত্মার সঙ্গে কথা বলে শিশিরকুমারের বিক্ষুব্ধ মন কিছুটা হলেও শান্ত হয়েছিল এবং এইসময় থেকেই তিনি আরও প্রবল ভাবে মেতে উঠলেন প্রেতচর্চা ও ঈশ্বরের উপাসনায়। আর তখনকার পরিবেশ এবং পরিস্থিতি ছিল প্রেতচর্চার পক্ষে খুবই অনুকূল। তবে শুধু পরিবেশ ও পরিস্থিতি নয় মহাত্মা শিশিরকুমারের ভাগ্যদেবীও সেইসময় তাঁর প্রতি অতি মাত্রায় সুপ্রসন্ন ছিলেন।
শিশিরকুমারের সঙ্গে প্রখ্যাত চিকিৎসক, অধ্যাত্মবিশারদ ও ন্যাশনাল স্পিরিচুয়্যালিস্ট অ্যাসোসিয়েশন অব চার্চেস-এর প্রতিষ্ঠাতা ডক্টর জেমস মার্টিন পিবলস-এর পূর্ব পরিচয় ছিল। তিনি মহাত্মার স্পিরিচুয়্যাল ম্যাগাজিনের একনিষ্ঠ পাঠক ছিলেন। শিশিরকুমারের এই ম্যাগাজিনের ভূয়সী প্রংশসা করে বহু চিঠিও তিনি লিখেছিলেন। তিনি যে ওই ম্যাগাজিনটি খুব মনযোগ সহকারে পড়তেন তার প্রমাণ পাওয়া যায় একটি চিঠির বিশেষ এই অংশটির ওপর নজর রাখলে। তিনি লিখছেন, ‘its contents are interesting, instructive and very valuable. I read it with a great degree of pleasure.’
দুজনের মধ্যে নিয়মিত চিঠির আদানপ্রদান থাকলেও তাঁদের তখনও মুখোমুখি সাক্ষাৎ হয়নি। আমেরিকায় অধ্যাত্মবিদ্যার প্রবল চর্চা শুরু হয়েছে জেনে শিশিরকুমার সেদেশে যাবেন বলেও মনস্থ করেছিলেন। কিন্তু নানা কারণে তিনি সেইসময় যেতে পারেননি। কিন্তু তাঁর সঙ্গে জে এম পিবলসের সাক্ষাৎ ঘটল এই কলকাতার বুকেই। ১৯০৭ সালের ৪ জানুয়ারি স্বয়ং পিবলস কলকাতায় এলেন। তিনি যতীন্দ্রমোহন ঠাকুরের আতিথ্য গ্রহণ করে উঠেছিলেন টেগোর ক্যাসেলে। কলকাতায় থাকাকালীন সাহেবের সঙ্গে শিশিরকুমারের নিয়মিত দেখাসাক্ষাৎ হতো। শুধু তাই নয় শিশিরকুমার পাশে থাকার ফলে পিবলসের পক্ষে ভারতে প্রেতচর্চার প্রচার ও প্রসারের কাজটি আরও সহজ হয়েছিল। খুব সম্ভবত মহাত্মা শিশিরকুমার ঘোষ তাঁর সাপ্তাহিক অমৃতবাজার পত্রিকাকে ডক্টরের প্রচারের কাজে ব্যবহার করেছিলেন।
ডক্টর পিবলস যে বছর কলকাতায় এলেন তখন শিশিরকুমারের এই সাপ্তাহিক ম্যাগাজিনটি কলকাতায় যথেষ্ট জনপ্রিয় ছিল। ১৮৬৮ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি অর্থাৎ প্রতিষ্ঠার দিন থেকেই শিশিরকুমার তাঁর পত্রিকার মাধ্যমে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করেছিলেন। তিনি অত্যাচারী শাসকদের বোঝাতে পেরেছিলেন সেই চরম সত্যটি— The pen is mighter than the sword। আর তার ফলে তাঁকে পড়তেও হয়েছিল রাজরোষে। ১৮৬৮ খ্রিস্টাব্দে শিশিরকুমার সহ কয়েকজনের বিরুদ্ধে মামলা শুরু করে ব্রিটিশ সরকার। এইসময় তাঁদের পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন মনোমোহন ঘোষ। শিশিরকুমার মুক্তি পেলেও দণ্ডিত হন চন্দ্রনাথ ঘোষ ও রাজকৃষ্ণ মিত্র।
সে কথা থাক! তবে শিশিরকুমারের এই অহেতুক কৌতূহল, ‘তাঁদের’ জগতে অনধিকার প্রবেশে ‘তাঁরা’ বোধহয় মোটেই খুশি ছিলেন না। হয়তো তাই মাত্র পঁচিশ বছর বয়েসে অকালে ঝরে যেতে হল তাঁর অত্যন্ত প্রিয় পুত্র পয়সকান্তিকে।
পুত্রশোকে অত্যন্ত কাতর হয়ে পড়েছিলেন মহাত্মা শিশিরকুমার। প্ল্যানচেটে বসে তিনি তাঁর প্রয়াত পুত্র পয়সকান্তির সঙ্গে কথা বলেছিলেন কিনা সে তথ্য বা খবর আমাদের হাতে আজ নেই। তবে এইসময় তিনি জানতে পেরেছিলেন শিকাগো শহরের দুই বোন মৃত ব্যক্তিদের ছবি আঁকেন এবং এর জন্য তাঁদের সেই অচেনা প্রয়াত মানুষটির কোনও ছবির প্রয়োজন হয় না। শিকাগোর ব্যাঙ্কস পরিবারের এই দুই বোন সেইসময় ওখানে ‘Banks sisters’ নামেই পরিচিত ছিলেন। তাঁদের এই অলৌকিক ক্ষমতার কথা জানতে পেরে শিশিরকুমার তাঁর প্রয়াত পুত্রের ছবি তাঁদের দিয়ে আকাবেন বলে মনস্থ করলেন।
শিকাগো শহরে শিশিরকুমারের এক পরিচিত বন্ধু থাকতেন। মহাত্মা তাঁকে চিঠি লিখে ব্যাঙ্কস বোনেদের দিয়ে তাঁর মৃত পুত্রের ছবি এঁকে দেওয়ার অনুরোধ করলেন। সেই ভদ্রলোকের আবার এইসব অলৌকিক ব্যাপার-স্যাপারে বিন্দুমাত্র বিশ্বাস ছিল না। তিনি চিঠি পেয়েই তার উত্তরে লিখলেন, আমি এইসব বুজরুকিতে একদম বিশ্বাস করি না। তাই আমি আপনার অনুরোধ রাখতে পারলাম না। আমাকে ক্ষমা করবেন।
বন্ধুর চিঠি পড়ে অতিশয় হতাশ হয়েছিলেন শিশিরকুমার। তবু তিনি আবার সেই বন্ধুকে কাতর মিনতি করে আরও একটি চিঠি লিখে বলেন, আপনি দয়া করে আমার এই অনুরোধটা রক্ষা করুন। এই ছবি আঁকতে যা খরচ হবে তা আমি অগ্রিম আপনাকে পাঠিয়ে দেব।
মহাত্মার এই চিঠি পড়ে ভদ্রলোকের মনটা কিছুটা হলেও আর্দ্র হয়েছিল। তিনি লিখলেন,আপনি চিন্তা করবেন না, আমি আপনার পুত্রের ছবি ব্যাঙ্কস ভগ্নীদের দিয়ে আঁকিয়ে দেব। তবে আপনার পুত্রের একটা ছবি আমাকে পাঠিয়ে দেবেন। আমি ছবিটা আমার কাছেই রেখে দেব। তাঁরা ছবি এঁকে দেওয়ার পর আমি সেই ছবির সঙ্গে মিলিয়ে দেখব।
(ক্রমশ)