উপার্জন বেশ ভালো হলেও ব্যয়বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে সঞ্চয় তেমন একটা হবে না। শরীর খুব একটা ... বিশদ
মহাত্মা শিশিরকুমার ঘোষ। ১৮৪০ সালে যশোর জেলার মাগুরা (অমৃতবাজার) গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। কলকাতা কলুটোলা ব্রাঞ্চ স্কুল (বর্তমান হেয়ার স্কুল) থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে কিছুকাল প্রেসিডেন্সি কলেজেও পড়াশুনা করেন। এরপর তিনি আবার ফিরে যান নিজের গ্রাম পুলুয়ামাগুরায়।
পরবর্তীকালে বেশ কিছুদিন তিনি হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকার সংবাদদাতা হিসেবেও কাজ করেছিলেন। এই পত্রিকায় তাঁর লেখা নীলকর বিরোধী প্রবন্ধগুলি মানুষকে আরও ইংরেজ বিরোধী করে তুলেছিল। পরে কলকাতায় মুদ্রণের কাজ শিখে একটি কাঠের মুদ্রাযন্ত্র কিনে নিজগ্রামে সেটি স্থাপন করেন। শুরু হয় প্রকাশনার কাজ। পাক্ষিক সেই পত্রিকাটির নাম ছিল ‘অমৃত প্রবাহিণী’। বিখ্যাত অমৃতবাজার পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ছিলেন তিনি। সারা ভারতের মানুষ তাঁকে সেইসময় একডাকে চিনতেন এবং এখনও চেনেন। মহাত্মা শিশিরকুমারও একসময় প্রবলভাবে প্রেতচর্চার দিকে ঝুঁকেছিলেন। এইকারণে তিনি একটি মাসিক পত্রিকাও প্রকাশ করতে শুরু করেন। পত্রিকাটির নাম ছিল ‘হিন্দু স্পিরিচুয়্যাল ম্যাগাজিন’।
এইসময়ই শিশিরকুমার ঘোষের সঙ্গে আলাপ হয় থিওজফিক্যাল সোসাইটির দুই প্রখ্যাত কর্মকর্তা মাদাম ব্ল্যাভাৎস্কি ও কর্নেল অলকটের। তাঁদের সহায়তায় এবং তাঁর উদ্যোগেই কলকাতায় থিওজফিক্যাল সোসাইটির গোড়াপত্তন হয়। এই প্রসঙ্গে শিশিরকুমার লিখছেন, ‘আমি যখন ব্যাকুল হইয়া জ্ঞান-পথের অনুসন্ধান করিতেছি তখন শুনিলাম বোম্বাই নগরে আমেরিকা হইতে ব্ল্যাভাটস্কী নাম্নী একটি মেম ও অলকট নামক এক সাহেব আসিয়াছেন। ইঁহারা পরম যোগী সিদ্ধপুরুষ, অনেক অলৌকিক ক্রিয়াও করিতে পারেন। এই কথা শুনিয়া আমি বোম্বাই নগরে তাঁহাদের নিকট যাত্রা করিলাম ও তিন সপ্তাহকাল তাঁহাদের গৃহে বাস করিলাম। তাঁহাদের নিকট কিছু কিছু দেখিলাম ও কিছু কিছু শিখিলাম।’
একটা সময় শিশিরকুমার ঘোষ ‘তাঁদের’ অর্থাৎ প্রেতলোক সম্পর্কে আরও অনেককিছু জানবার জন্য অত্যন্ত ব্যাকুল হয়ে উঠেছিলেন। তাঁর কাছে খবর ছিল আমেরিকায় প্রেতচর্চা খুবই উন্নতি লাভ করছে। সেইকারণে তিনি আমেরিকায় যাবেন বলেও ঠিক করেছিলেন। কিন্তু যে কোনও কারণে তাঁর সেই বাসনা পূর্ণ হয়নি।
কিন্তু কেন মহাত্মা শিশিরকুমার প্রেতলোকের প্রতি এত আকৃষ্ট হয়ে পড়েছিলেন? কেন তাঁর জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছিল প্রেতচর্চা? একটি আত্মহত্যা। তাঁর অত্যন্ত প্রিয় ও স্নেহের ভাই হীরালাল হঠাৎই আত্মহত্যা করে বসেন। তিনি তাঁর এই ভাইকে নিজের প্রাণের চেয়েও বেশি ভালোবাসতেন। সেই ভাইয়ের মৃত্যুতে শিশিরকুমার প্রায় পাগলের মতো আচরণ করতে শুরু করেছিলেন। প্রিয় ভাইয়ের অকালে চলে যাওয়া তিনি কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলেন না। অন্য জগতে চিরতরে হারিয়ে যাওয়া ভাইয়ের সঙ্গে যে কোনও উপায়ে তিনি একবার যোগাযোগ করবার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু কীভাবে যোগাযোগ করা যাবে! তাঁকে কেউ একজন প্ল্যানচেট করার পরামর্শ দিয়েছিলেন। তাঁর কথামতো শিশিরকুমার প্ল্যানচেট সম্পর্কে অভিজ্ঞতা আছে এমন মানুষের সন্ধান করতে শুরু করলেন। অল্পদিনের মধ্যেই তিনি তাঁর কাঙ্খিত মানুষটির খোঁজ পেলেন।
এইসময় শোকস্তব্ধ শিশিরকুমার পাশে পেলেন প্রখ্যাত সাহিত্যিক প্যারীচাঁদ মিত্র বা টেকচাঁদ ঠাকুরকে। তিনি তখন কর্মোপলক্ষে যশোরে বসবাস করতেন। সাহিত্যচর্চার পাশাপাশি সেইসময় প্রেতবিশারদ হিসাবেও তিনি যথেষ্ট খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। নিজের বাড়িতে প্রায় নিয়মিত তিনি তাঁর বন্ধুদের নিয়ে প্ল্যানচেটের আসর বসিয়ে আত্মাদের সঙ্গে কথা বলতেন। সেই আসরে থাকতেন নাট্যকার দীনবন্ধু মিত্র, শ্রীশচন্দ্র বিদ্যারত্ন, সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, সাব-জজ গিরিশচন্দ্র ঘোষের মতো প্রখ্যাত মানুষজন। শোনা যায় তাঁরা সকলেই প্রেতাত্মা-চর্চায় যথেষ্ট সাফল্য লাভ করেছিলেন। সেই দলের নেতা প্যারীচাঁদ মিত্রের তত্ত্বাবধানেই শুরু হল শিশিরকুমার ঘোষের প্রেতচর্চার শিক্ষা এবং অল্পদিনের মধ্যে তিনিও এ ব্যাপারে পারদর্শী হয়ে উঠেছিলেন।
প্যারীচাঁদের কাছে প্রেতচর্চার পাঠ সম্পূর্ণ করে শিশিরকুমার নিজের বাড়িতেই তাঁর অন্যান্য ভাইদের নিয়ে প্ল্যানচেটের আসর বসাতে শুরু করলেন। মহাত্মার মেজভাই হেমন্তকুমার ও অপর এক ভাই মতিলাল মূলত এই আসরের মিডিয়াম হতেন। কখনও-সখনও মহাত্মার তৃতীয় পুত্র পয়সকান্তি ও কনিষ্ঠা কন্যা সুহাসনয়নাকেও এই দায়িত্ব সামলাতে হতো।
পর পর তিনদিন প্ল্যানচেটে বসে ভাই হীরালালের আত্মাকে ডেকে আনার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলেন শিশিরকুমার ও তাঁর ভাইরা। চতুর্থদিনে তাঁরা আবার প্ল্যানচেটে বসলেন। সেদিনের আসরের মিডিয়াম ছিলেন হেমন্তকুমার। বদ্ধ ঘরে তাঁরা টেবিলের সামনে বসে একাগ্র মনে হীরালালের কথাই ভাবতে শুরু করলেন। এইভাবে বেশ কিছুক্ষণ কেটে যাওয়ার পর শিশিরকুমার লক্ষ করলেন হেমন্তকুমার ঠকঠক করে কাঁপছেন। তিনি বুঝতে পারলেন হেমন্তের শরীরে কোনও আত্মা ভর করেছেন। তিনি তাড়াতাড়ি একটা সাদা খাতা ভাইয়ের সামনে রেখে তাঁর হাতে একটা পেন্সিল গুঁজে দিলেন।
বেশ খানিকক্ষণ নীরবতার পর হেমন্তকুমার তাঁর হাতে ধরা পেন্সিলটি দিয়ে খাতার ওপর আওয়াজ করতে শুরু করলেন।
আওয়াজ শুনেই শিশিরকুমার বুঝতে পারলেন আত্মা কথা বলতে চাইছেন, তিনি জিজ্ঞাসা করলেন— তুমি কি হীরালালের আত্মা?
— কাগজে লেখা হল হ্যাঁ।
মহাত্মা জানতে চাইলেন, তুমি এখন কোথায়?
কাগজে উত্তর পেলেন, আমি এখন যেখানে আছি সেই জায়গাটা বেশ মনোরম।
— গত তিনদিন ধরে তোমাকে আনবার চেষ্টা করছি। তুমি আসছিলে না কেন?
— আমাকে অনেক নিম্নশ্রেণীর আত্মা তোমাদের কাছে আসতে বাধা দিচ্ছিল।
— আজ কী করে এলে?
— তোমাদের ছেড়ে এসে আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। আজ তোমাদের কাছে আসব বলে সব বাধা পার করে চলে এসেছি। তোমরা ভালো থেকো। আমার এখানে থাকতে খুব কষ্ট হচ্ছে। আমি চলি। এই কথাগুলি লেখার পরই হঠাৎই হেমন্তকুমার অস্ফুটে কেঁদে উঠলেন এবং চেয়ার থেকে পড়েও যাচ্ছিলেন। শিশিরকুমার নিজের আসন ছেড়ে কোনওরকমে উঠে ভাইয়ের পতন রোধ করলেন।
সেদিন প্রাণাধিক প্রিয় ভাইয়ের আত্মার সঙ্গে কথা বলে খুবই মানসিক শান্তি পেয়েছিলেন শিশিরকুমার ঘোষ।
(ক্রমশ)