উপার্জন বেশ ভালো হলেও ব্যয়বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে সঞ্চয় তেমন একটা হবে না। শরীর খুব একটা ... বিশদ
ভদ্রলোকের নাম জেমস গ্রাহাম। অবস্থাপন্ন ব্যবসায়ী । ইংল্যান্ডের ডারহামশায়ারের শহরের বাইরে বেশ কটি যাঁতা পেষার কল নিয়ে তাঁর বড়সড় কারখানা। কর্মঠ মানুষ। বছরের তিনশো পঁয়ষট্টি দিনই তিনি সময় মতো কারখানায় আসেন। তবে তাঁর বাড়ি ফেরার কোনও ঠিক থাকে না। প্রায়দিনই কাজের চাপ বেশি থাকে তাই বাড়ি ফিরতেও তাঁর বেশ রাত হয়ে যায়। প্রতিদিনই কাজ শেষ হওয়ার পর কারখানা বন্ধ করে একটা জ্বলন্ত লণ্ঠন হাতে নিয়ে তিনি হেঁটেই বাড়ি ফেরেন।
সেদিন সকাল থেকেই আবহাওয়াটা মোটেই ভালো ছিল না। একে শীতকাল, তার ওপর গতকাল রাত থেকেই প্রবল তুষার পাত শুরু হয়েছে। সকালে বাড়ি থেকে বেরবার সময় তেমন কোনও সমস্যা অবশ্য হয়নি। রাস্তায় বেরিয়েই তিনি একটা গাড়ি পেয়ে গিয়েছিলেন। কারখানায় পৌঁছেই তিনি কাজ নিয়ে এতটাই ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন যে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কথা তাঁর মাথাতেই ছিলনা। সেদিন আবার কাজের চাপও যথেষ্ট ছিল। সব যখন মিটল তখন রাত এগারোটা বেজে গেছে। কারখানা বন্ধ করে, আপাদমস্তক শরীর ঢেকে লণ্ঠন হাতে তিনি রাস্তায় নেমে এলেন।
তখনও সমানতালে তুষারপাত হচ্ছে। লন্ডনের শীত মানেই দুর্ভোগ। প্রবল ঠান্ডা, রাস্তায় একটা প্রাণীকেও দেখা যাচ্ছেনা। গ্যাস লাইটের আলোগুলোও যেন ঠান্ডার চোটে আরও ক্ষীণ হয়ে জ্বলছে। রাস্তায় নেমেই গ্রাহাম বুঝতে পেরেছিলেন আজ কপালে অনেক কষ্ট আছে। আর তখনই শৈত্যপ্রবাহ হঠাৎ করে যেন আরও বেড়ে গেল। সেই কনকনে হাওয়া শরীরের সমস্ত পোশাক ভেদ করে হাড়ের ভিতরে ছোবল মারতে শুরু করল।
বিরক্ত গ্রাহাম খুব সাবধানেই পথ চলছিলেন। বেশ কিছুটা পথ যাওয়ার পর হঠাৎই তিনি দেখতে পেলেন এক ভদ্রমহিলা দ্রুত তাঁর দিকে হেঁটে আসছেন। শীতের রাতে একাকী এক মহিলাকে এই রাস্তায় দেখে গ্রাহাম বেশ অবাকই হলেন। ইতিমধ্যে সেই মহিলা প্রায় তাঁর সামনে চলে এসেছেন। অভদ্রতা জেনেও গ্রাহাম হাতের লণ্ঠনটা তুলে মহিলার মুখটা দেখার চেষ্টা করলেন। কিন্তু বৃথা চেষ্টা। তুষারের হাত থেকে বাঁচার জন্য সেই মহিলা তাঁর মাথা ও মুখ প্রায় মুড়ে ফেলেছেন।
মহিলাটি গ্রাহামের সামনে এসে বললেন, মিস্টার গ্রাহাম, আপনার সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে।
গ্রাহাম মহিলার কথা শুনে যথেষ্ট অবাক ও বিস্মিত হলেও মুখে তা প্রকাশ করলেন না, বরঞ্চ বেশ গম্ভীর ভাবেই বললেন, ম্যাডাম, আপনি কী আমাকে চেনেন! আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে আপনি আমার পূর্বপরিচিতা। কারণ আপনি আমার নামটাও জানেন। উত্তরে সেই মহিলা বললেন, অবশ্যই আমরা একে অপরকে খুব ভালোভাবে চিনি। আমি আপনাকে আমাদের বাড়িতে বহুবার দেখেছি। আপনি আমার হাতের চা খেয়ে কতবার প্রশংসা করেছেন। কিন্তু এখন সে কথা থাক। আজ আপনাকে আমার বড় দরকার। আপনি ছাড়া আর কেউ আমাকে সাহায্য করতে পারবেন না।
গ্রাহাম বললেন, নিশ্চয়ই আমি আপনাকে সাহায্য করব। তবে সেইসব কথা তো দিনের বেলায় আমার কারখানায় এসেও বলতে পারতেন। আজ এরকম দুর্যোগ, তারপর রাতটাও কম হয়নি। সময় নির্বাচনটা আপনার সঠিক হয়নি।
মহিলা বললেন, দিনের আলো আমি এখন একদম সহ্য করতে পারিনা। আমি জানি আপনি রোজই প্রায় এইসময় বাড়ি ফেরেন। তাই আজই আমি আপনার সঙ্গে দেখা করতে এলাম।
গ্রাহাম মৃদু হেসে বললেন, এসেই যখন পড়েছেন তখন বলুন আপনার দরকারটা। তারপর দেখব কীভাবে সাহায্য করতে পারি। কিন্তু আপনার মাথা মুখ যেভাবে ঢেকে রেখেছেন তাতে আমি আপনাকে চিনতে পারছি না। আপনার নামটা যদি জানান তাহলে আমার কথা বলতে সুবিধা হয়।
মহিলা বললেন আমার নাম মিস লি।
নামটা শুনে চমকে উঠলেন জেমস গ্রাহাম। তিনি বললেন, মিস লি, আপনি তো আজ থেকে মাস ছয়েক আগে আমাদের বন্ধু মার্ক সার্পের সঙ্গে পালিয়ে গিয়েছিলেন। মার্ক কেমন আছে। আপনারা কী আবার ফিরে এসেছেন।
মিস লি বললেন না, আমি কারও সঙ্গে পালাইনি। গত ছমাস ধরে আমি এই শহরেই রয়েছি। তবে এখন বড় কষ্টে আছি আমি। আপনি দয়া করে আমাকে বাঁচান।
কে ছিলেন এই মিস লি! তাঁর কথা জানতে হলে আমাদের একবার ঘুরে আসতে হবে ডারহামশায়ারের চেস্টার লি স্ট্রিট থেকে। এই এলাকাতেই বসবাস করেন জেমস গ্রাহামের ঘনিষ্ট বন্ধু মিস্টার ওয়াকার। বিত্তশালী মানুষ। বিশাল দুর্গের আকারের না হলেও তাঁর বাড়িটা নেহাৎ ছোট নয়। অর্থ, প্রতিপত্তি থাকলেও ওয়াকারের স্ত্রী ভাগ্য মোটেই সুখের নয়। বেশ কয়েক বছর আগে খুব ঘটা করে এক সুন্দরী মেয়েকে তিনি বিয়ে করেছিলেন। কিন্তু বিয়ের কিছুদিন বাদেই তাঁর স্ত্রী কয়েকদিন ভুগেই মারা যান। তারপর থেকেই ওয়াকারের একাকী দিনযাপন শুরু হয়েছে। মাঝেসাঝে বন্ধুবান্ধবরা বাড়িতে আড্ডা মারতে এলেও তাঁরা বিদায় নেওয়ার পর পুরো বাড়িটা যেন তাঁকে গিলে খেতে আসে। প্রবল নিসঙ্গতায় ক্রমশ ডুবে যাচ্ছিলেন তিনি। ঠিক এমন সময় তাঁদেরই দূর সম্পর্কের এক আত্মীয়া মিস লি তাঁর সঙ্গে দেখা করতে বাড়িতে আসেন। সহায় সম্বললহীন অবস্থায় মিস লি সেইসময় পথে পথে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। তিনি মিঃ ওয়াকারের কাছে নিজের দুর্দশার কথা জানিয়ে আশ্রয় চাইলেন।
ওয়াকার বললেন, তুমি আমার বাড়িতে অবশ্যই থাকতে পার। এতবড় বাড়িতে আমি আর একা থাকতে পারছি না। আমার বাড়িতে এতগুলো ঘর রয়েছে তুমি যে কোনও একটা ঘরে থাক। তবে তোমাকে নিজের হাতে এই ঘর-গৃহস্থালির সমস্ত কাজ সামলাতে হবে।
মিস লি ওয়াকারের প্রস্তাবে এককথায় রাজি হয়ে গেলেন। কদিনের মধ্যেই নারীর হাতের পরশে আবার আগের চেহারা ফিরে পেল চেস্টার লি স্ট্রিটের ওয়াকারের বাড়িটি। কিন্তু লি-র কপালে সেই সুখ দীর্ঘস্থায়ী হল না। যেমন ভাবে তিনি একদিন এই বাড়িতে এসেছিলেন ঠিক সেইভাবেই এক বিকেলে কোথায় যেন হারিয়ে গেলেন সেই সুন্দরী মেয়েটি।