উপার্জন বেশ ভালো হলেও ব্যয়বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে সঞ্চয় তেমন একটা হবে না। শরীর খুব একটা ... বিশদ
কুরুক্ষেত্র থেকে এবার রওনা দেওয়া যাক হরিদ্বারের পথে। এ পথে দু’তিন ঘণ্টা অন্তর বাস মেলে কুরুক্ষেত্র থেকে। তবে শাকম্ভরী দেবীতীর্থ দর্শন করতে গেলে সাহারানপুরেই নেমে পড়া ভালো।
এখানে নামী-দামি অনেক হোটেল লজ আছে। থাকা না থাকা সময়ের ব্যাপার। সাহারানপুরের ‘বেহট আড্ডা’ থেকে শাকম্ভরীর বাস ছাড়ে।
শিবালিক পর্বতমালার কোলে অরণ্যের শোভা সৌন্দর্যের মাঝখানে বীরখেত নামে এক সুবিশাল প্রান্তরের ধারে বাস থেকে নেমে শাকম্ভরী বা শাকুম্ভরী তীর্থে যেতে হয়। এখানে ভূরাবাবার একটি মন্দির আছে। শাকম্ভরী এখান থেকে মিনিট দশেকের হাঁটাপথ।
ভূরাবাবা (শিব) দর্শনের পর এক বিশাল উপলাকীর্ণ গিরিনদী পার হতে হয়। বর্ষায় এর রূপ কীরকম হয় তা জানি না, তবে আমি যখন গিয়েছিলাম তখন এটি ছিল জলহীন। স্থানীয়রা একে ঝর্ণা বলে। এর দু’পাশে পাহাড়। সামনে পাহাড়।
শাকম্ভরীতে থাকার জায়গার অভাব নেই। বেশকিছু সর্বসুবিধাযুক্ত আশ্রম বা ধর্মশালা আছে এখানে।
এই তীর্থের অধিষ্ঠাত্রী দেবী শাকম্ভরী হলেন হিমালয়ের নয় দেবীর অন্যতমা। এখানে দেবীর মস্তক পতিত হয়েছিল। এই দেবীকে দর্শন করতে গিয়ে সাধু-মুখে শুনলাম শাকম্ভরী তীর্থ যে শুধুই দেবীপীঠ তা নয়, এই তীর্থে প্রজাপতি ব্রহ্মা নিরন্তর বিরাজ করছেন। পদ্মপুরাণে আছে, ব্রহ্মা পুষ্কর তীর্থে ব্রহ্মা নামে, গয়াক্ষেত্রে চতুর্মুখ নামে, কাবেরী তটে সৃষ্টিকর্তা নামে এবং শাকম্ভরীতে রসপ্রিয় নামে বিদ্যমান।
এই তীর্থ ত্রিশূলা তীর্থ নামেও খ্যাত। মহাভারতের বনপর্বে তীর্থকাণ্ডে আছে, এই তীর্থ ত্রিলোক বিখ্যাত।
এই তীর্থে সারা বছরই পুণ্যার্থীদের প্রচণ্ড ভিড় হয়। আশ্বিন চতুর্দশীর বিশাল মেলায় কয়েক লক্ষ দর্শনার্থীর সমাগম হয় এখানে।
সেরকম কোনও যোগ না থাকা সত্ত্বেও আমি প্রচণ্ড ভিড়ের মধ্যে দেবীকে দর্শন করেছি। তবে দেবী এখানে একা নন। মধ্যে দেবী শাকম্ভরী এবং তাঁর সামনেই বাল গণপতি। দেবীর ডানদিকে আরও দুই দেবী ভীমা ও ভ্রামরীর অবস্থান। আর বাঁদিকে আছেন দেবী শতাক্ষী। পাণ্ডাদের মুখে শুনলাম একই দেবী এখানে ভিন্ন নামে এবং ভিন্ন রূপে বিরাজমান।
এই পুণ্যতীর্থে শিবালিক পর্বতমালার পাদদেশে যে বিশাল প্রান্তর আজ বীরখেত নামে খ্যাত সেইস্থানে দেবী চণ্ডিকা রক্তবীজকে দমন করে ভীমা ও ভ্রামরী নাম নিয়ে ঘোরতর যুদ্ধ করে বধ করেন চণ্ড ও মুণ্ডকে।
রক্তবীজ বধের পর সমস্ত দেবতারা যখন চণ্ডিকার জয়গানে মেতে ওঠেন তখন এই পর্বতমালা ভেদ করে ভয়ঙ্কর রবে ছুটে আসে শুম্ভ ও নিশুম্ভ নামে দুই অসুর। দেবীও তখন ভীমা ও ভ্রামরী মূর্তি ধারণ করে মার মার রবে পেটাতে থাকেন অসুরদ্বয়কে। এই সময় এই বীরখেত প্রাঙ্গণে অসুরসেনাদের মোকাবিলা করার জন্য সমস্ত দেবতারা অংশগ্রহণ করেছিলেন। দেবীর পরম ভক্ত ভূরাদেব (মতান্তরে শিব) তাঁর পাঁচ সঙ্গী চঙ্গল, মঙ্গল, রোরা, ঝোড়া ও মানসিংকে নিয়ে এই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। শুম্ভ ও নিশুম্ভের বজ্রবাণে একসময় ভূরাদেবের পাঁচ সঙ্গী ভূপতিত হলে ভূরাদেব অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে একাই শত শত অসুরসৈন্যকে নিধন করতে লাগলেন। শুম্ভ ও নিশুম্ভও তখন ভূরাদেবকে লক্ষ্য করে অগ্নিবাণ নিক্ষেপ করল। সেই বাণের তেজ সহ্য করতে পারলেন না ভূরাদেব।
‘জয়দেবী’ বলে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন। ততক্ষণে দেবীর চক্র শুম্ভ নিশুম্ভকে দ্বিখণ্ডিত করেছে। যুদ্ধ শান্ত হলে রণক্ষেত্রে বিচরণ করে দেবী চণ্ডিকা ভূরাদেবের কাছে এলেন এবং তাঁকে অমৃতবারি সিঞ্চন করে জাগিয়ে তুললেন। ভূরাদেবের পাঁচ সঙ্গীও অমৃতের পরশে বলবীর্য ফিরে পেলেন এবং সকলে এই স্থানেই লীন হয়ে গেলেন দেবীর চরণে।
একবার শতবর্ষ ব্যাপী অনাবৃষ্টি দেখা দিলে স্বর্গের দেবতারা এই বীরখেতে এসে দেবী চণ্ডিকার শরণ নেন।
দেবী তখন শতচক্ষু হয়ে সহস্রধারায় তাঁর করুণাবারি ঝর্ণার আকারে নির্গত করতে থাকেন। তারই প্রভাবে পৃথিবী আবার সুজলা-সুফলা হয়। বনস্পতি প্রাণ ফিরে পায়। নদী নালা সমুদ্র ভরে ওঠে। ওই সময়েই দেবী তাঁর শরীর থেকে শাক উৎপন্ন করে সমস্ত জীবের প্রাণ রক্ষা করেন।
দেবী শতচক্ষুবিশিষ্টা হন বলে শতাক্ষী এবং শরীর থেকে শাক উৎপন্ন করেছিলেন বলে শাকম্ভরী নামে প্রসিদ্ধি লাভ করেন।
হরিদ্বারের যাত্রীরা হরিদ্বার থেকে গাড়ি নিয়ে অথবা বাসে সাহারানপুরে এসে এই দেবীতীর্থ দর্শন করতে পারেন। স্থানটি অতীব মনোরম। দিনে দিনে দর্শন করে আবার হরিদ্বারে ফেরা যায়।
(চলবে)
অলংকরণ : সোমনাথ পাল