উপার্জন বেশ ভালো হলেও ব্যয়বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে সঞ্চয় তেমন একটা হবে না। শরীর খুব একটা ... বিশদ
জম্মুতে দু’ একটা দিন বিশ্রাম নেওয়ার পর হাতে যদি সময় থাকে তাহলে কলকাতায় না ফিরে আরও এক দেবীতীর্থে অনায়াসেই যাওয়া যেতে পারে। সেই তীর্থভূমি হল চামুণ্ডা ক্ষেত্র। ইনিও হিমালয়ের নয় দেবীর এক অন্যতমা দেবী।
এবার পথ নির্দেশিকা দিই। জম্মু থেকে ট্রেনে অথবা বাসে পাঠানকোট। পাঠানকোট থেকে ঘণ্টা চারেকের বাস জার্নিতে ধরমশালায়। তবে হাওড়া কলকাতার দিক থেকে এলে ট্রেনের সুবিধার জন্য অমৃতসর হয়েই আসা ভালো।
ধরমশালায় দুটি ভাগ। একটি হল লোয়ার ধরমশালা অপরটি আপার ধরমশালা। ম্যাকলয়েডগঞ্জ ও ফরসিথগঞ্জ হল আপার ধরমশালায়। বর্তমানে তিব্বতীয় প্রভাবে গড়ে ওঠা এই শহরটি ছোট তিব্বত বা লিটল লাসা নামে পরিচিত। তিব্বতীয় ধর্মগুরু দালাই লামার নিবাসস্থল বলে এর মান্যতা ও গুরুত্ব অনেক।
ধরমশালায় থাকার জায়গার অভাব নেই। অন্তত একটা দিন এখানে থেকে নামগিয়াল মঠ দর্শন করে যেতে হবে মাত্র দু’কিমি দূরে ভাগসুনাগে। ধরমশালা ও ভাগসুনাগ প্রকৃতির স্বর্গোদ্যান। এখানকার অধিষ্ঠাতা দেবতা হলেন ভাগসুনাগ। কয়েকধাপ সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে দর্শন করতে হয়। এই মন্দিরে নন্দীমূর্তি সহ অনেকগুলো ছোট ছোট দেবদেবীর মূর্তিও আছে। আবার পিছনদিকে আছে পিতলের কৃষ্ণমূর্তি।
মন্দিরের বাইরে আছে প্রকৃতিদত্ত পবিত্র পানীয়জলের অমৃতধারা। প্রায় ছয়-সাতটি মুখ দিয়ে সেই ধারা কলকল করে নির্গত হচ্ছে। তবে এখানকার প্রধান আকর্ষণ হল ভাগসুপ্রপাত। বেশ কিছুটা উচ্চস্থানে এক সুন্দর নির্জনে ভাগসুপ্রপাতের অবস্থান বর্ণনাতীত।
একটা দিন ধরমশালার পথে পথে পরিব্রজন করে পরদিন সকালেই রওনা হওয়া যাক চামুণ্ডা নন্দীকেশ্বরে। লোয়ার ধরমশালা থেকে বাসে মাত্র পঁচিশ কিমি। নয় দেবীর অন্যান্য স্থানগুলির চেয়েও দারুণ রমণীয় এই দেবীক্ষেত্র।
শিব ও শক্তির মিলিত ক্ষেত্র এই দেবস্থান। বাণগঙ্গার তীরে অবস্থিত এই ক্ষেত্রের নৈসর্গিক সৌন্দর্যের তুলনা নেই। খুবই ছোট্ট জায়গা। এখানে থাকার জন্য অনেক হোটেল, লজ ও ধর্মশালা আছে। আমি অবশ্য মন্দির কমিটির যাত্রী নিবাসে উঠেছিলাম।
প্রথমেই বাণগঙ্গায় স্নান সেরে যাত্রীরা পিণ্ডিরূপী দেবী চামুণ্ডাকে দর্শন করেন। তাতেই দেবীর রুপোর চোখমুখ বসানো। দেখলে ভক্তিতে মাথা নত হয়ে আসে। মূল মন্দিরের সামনে হোমকুণ্ড। একটি বিশাল ঘণ্টাও ঝুলছে ঘরের মধ্যে। বাইরের অংশে বজরঙ্গবলী হনুমানের দণ্ডায়মান সুবিশাল মূর্তিটিও দেখবার মতো।
এখানকার আর এক আকর্ষণ বাণগঙ্গার দুরন্ত জলধারার একটি ধারাকে বিশাল এক কুণ্ডের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত করা হচ্ছে। সেখানে বোটিং-এর ব্যবস্থা আছে। স্নানও করছেন কেউ কেউ।
এখানকার এই বাণগঙ্গার উদ্গমস্থল চামুণ্ডা ক্ষেত্র থেকে মাত্র দু’ কিমি দূরে অর্জুনতালে। উৎসাহ থাকলে সেই জায়গাও ঘুরে আসা যেতে পারে। সেখানেই লাখামণ্ডলে অসংখ্য লাল পাথর পাওয়া যায়। বৌদ্ধযুগের কয়েকটি মূর্তিও পাওয়া গেছে সেখানে। প্রাচীন একটি শিলালিপিও এখানে আছে।
চামুণ্ডা দেবীকে দর্শনের পর মন্দিরের ঠিক পিছনদিকেই একটি গুহার মধ্যে দর্শন করতে হয় দুঃখহরণ শিবকে। ইনি নন্দীকেশ্বর নামেই পরিচিত। এরপর বাণগঙ্গার গতিপথ ধরে খানিক এগিয়েই চামুণ্ডানিকেতনে পঞ্চানন্দ, বৈষ্ণোদেবী ও ভৈরব শিবকে দর্শন করতে হয়।
এখান থেকে বেশ কিছু দূরে স্বামী চিন্ময়ানন্দ প্রতিষ্ঠিত চিন্ময় আশ্রম। আর চার কিমি দূরে জিয়া নামে একটি গ্রামে ২০ মিটার উচ্চ ও ৬০ মিটার ব্যাসযুক্ত একটি শিলা আছে। যার নাম ‘নাগা পাণ্ডব’। চটজলদি দর্শনের ব্যাপার না থাকলে এই দুই স্থানও দেখে নেওয়া যেতে পারে।
এবার বলি চামুণ্ডা ক্ষেত্রের প্রসিদ্ধি কেন?
এই ক্ষেত্রে দেবী চামুণ্ডার অসীম প্রভাব। এমনিতে তিনি উগ্রচণ্ডী হলেও ভক্তের কাছে তিনি করুণাময়ী। এই ক্ষেত্রেরই একটু উচ্চস্থানে চণ্ড ও মুণ্ডকে বধ করেন তিনি। দৈত্যরাজ রুরুকে বধের সময় দেবী দুর্গার ললাট থেকে আবির্ভূতা হন কৌশিকী নামে এক দেবী। তাঁর আবির্ভাবে দেবীর বর্ণ কালো হয়ে যায়। তিনি তখন কালিকামূর্তিতে রুরুকে বধ করেন। এদিকে শুম্ভ ও নিশুম্ভর নির্দেশে চণ্ড ও মুণ্ড অত্যাচারের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। দেবী তখন দৈবী মায়ায় এক মোহিনী মূর্তি ধারণ করে পর্বতের উচ্চস্থানে স্বর্ণময় বেদিতে বসে মৃদু মৃদু হাসতে থাকেন। তাঁর রূপলাবণ্য দর্শনে অসুররা তাঁকে ধরতে আসে। ততক্ষণে ক্রোধিতা দেবী ভয়ঙ্করী মূর্তিতে প্রকট হন। তাঁর মুখ কালো হয়ে যায়। চোখ দুটি যেন আগুনের গোলা। লেলিহান জিভ। পরনে ব্যাঘ্রচর্ম। গলায় মুণ্ডমালা। কুঞ্চি গাত্র। ঘন মেঘের মতো কেশ। তিনি সেই ভয়ঙ্করী মূর্তিতে শত সহস্র অসুর সেনাকে ধ্বংস করতে থাকেন। এক একজনের হাত ধরে তাদের চিবিয়ে খেতে থাকেন। সব শেষে খড়্গাঘাতে চণ্ড ও মুণ্ডের শিরচ্ছেদ করে সেই মুণ্ড দুটি দেবী দুর্গাকে উপহারস্বরূপ প্রদান করলে দেবী কৌশিকীকে চামুণ্ডা নামে অভিহিত করেন। দেবী দুর্গার অংশই হলেন কৌশিকী, কালিকা ও চামুণ্ডা।
তাই আমার মনে হয় তীর্থযাত্রী ছাড়াও ডালহৌসী বা ধরমশালায় যাঁরা বেড়াতে আসেন তাঁরাও একটি রাত অন্তত এই পুণ্যভূমিতে যদি কাটিয়ে যান তো অনেক আনন্দে তাঁদের সবারই মন কিন্তু ভরে উঠবে। (ক্রমশ)