উপার্জন বেশ ভালো হলেও ব্যয়বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে সঞ্চয় তেমন একটা হবে না। শরীর খুব একটা ... বিশদ
সেই কাহিনীর সূত্রপাত হয়েছিল হেস্টিংসের বেলভেডিয়ারের বাড়িতে। অন্যান্য নানাবিধ সমস্যার পাশাপাশি সুন্দরী নারীর প্রতিও হেস্টিংসের দুর্বলতা ছিল অপরিসীম। নারী-প্রীতি তাঁকে বহুবার বহু সমস্যায় ফেলেছে। মেরি গ্র্যান্ডের পাশাপাশি তিনি আর এক নীলনয়না সুন্দরী ব্যারন ইমহফের স্ত্রী মেরিয়ান ইমহফের প্রেমেও প্রবল ভাবে পাগল হয়ে উঠেছিলেন।
পরস্ত্রী ইমহফকে কাছে পাওয়ার জন্য তিনি ব্যারনকে বাধ্য করেছিলেন সস্ত্রীক বেলভেডিয়ারে বাড়িতে বসবাস করতে। ব্যারন খুব ভালোভাবেই জানতেন তাঁর স্ত্রীর প্রতি হেস্টিংসের দুর্বলতার কথা, কিন্তু তিনি বড়লাটের আদেশ কোনওভাবেই অমান্য করার সাহস দেখাতে পারেননি।
এই বাড়িতে আসার কয়েকমাস পরেই হেস্টিংস ব্যারনকে কোম্পানির কাজে মাদ্রাজে পাঠিয়ে দেন। আবার কেউ কেউ বলেন স্বয়ং ব্যারন মনের দুঃখে স্ত্রী মেরিয়ানকে ছেড়ে দূরে কোথাও চলে গিয়েছিলেন। হয়তো তিনি ভেবেছিলেন, বউ হারালে আবার বউ পাওয়া যাবে, কিন্তু বড়লাটের কোপে প্রাণটা গেলে স্থায়ী ঠিকানা হবে গ্রেভইয়ার্ডে।
ব্যারন কোথায় গিয়েছিলেন তা সঠিক ভাবে জানা না গেলেও মেরিয়ানকে নিজের মতো করে পেতে হেস্টিংসের সামনে এরপর আর কোনও বাধা রইল না। ব্যারন উধাও হওয়ার পর থেকে প্রায় প্রতিদিনই গভীর রাতে বেলভেডিয়ার দোতলার ঘরটি হেস্টিংস ও মেরিয়ানের কলহাস্যে মুখরিত হয়ে উঠত।
সাতটা বছর মেরিয়ান ইমহফ এই বাড়িতেই বসবাস করেছিলেন। সন ১৭৭৭। হেস্টিংস তাঁর নতুন ঘরনি মেরিয়ান ইমহফকে নিয়ে উঠে এলেন হেস্টিংস হাউসে। বড়লাট মনের মতো করে তাঁর এই প্রাসাদটিকে সাজিয়েছিলেন। আরণ্যক পরিবেশে মাথা উচুঁ করে দাঁড়িয়ে থাকা এই প্রাসাদটির সৌন্দর্যের কথা তখন মানুষের মুখে মুখে ফিরত। ওয়ারেন হেস্টিংসের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও শ্যালক মিঃ ম্যাক্রাবি তাঁর এক বন্ধুকে একটি চিঠিতে লিখেছিলেন—‘জ্যোৎস্নাভরা চাঁদনি রাতে সাদা ধবধবে এই বাড়িটির আশ্চর্য ঔজ্জ্বল্য রীতিমত চোখ ধাঁধিয়ে দেয়।’
১৭৭৭ থেকে ১৭৮৪— হেস্টিংস হাউসে মোট সাত বছর সস্ত্রীক বড়লাট বসবাস করেছিলেন। ১৭৮৪ খ্রিষ্টাব্দের মাঝামাঝি সময়ে মিসেস হেস্টিংস দেশে ফিরে যান এবং পরের বছর দেশে ফেরেন ওয়ারেন হেস্টিংস। আর তার কয়েক বছর পর থেকেই শুরু হল যত কিছু সমস্যা। হেস্টিংস হাউস হয়ে উঠল জমজমাট ভূতের আড্ডাখানা। কিন্তু কেন? তার পিছনে রয়েছে একটা করুণ ইতিহাস, এক অতৃপ্ত আত্মার প্রতিশোধ নেওয়ার কাহিনী।
হেস্টিংস দেশে ফিরে যাওয়ার আগে তাঁর এই বিশাল সম্পত্তি অর্থাৎ হেস্টিংস হাউস দান করেন তাঁর স্ত্রী মেরিয়ান ইমহফের প্রথম পক্ষের পুত্র (ব্যারন ইমহফের ঔরসজাত) জুলিয়াস ইমহফকে।
হেস্টিংস স্বদেশে ফিরে যাওয়ার তিনবছর বাদে ১৭৮৮ সালে জুলিয়াস রাইটারের চাকরি নিয়ে ভারতে আসেন। ১৭৮২ সালে তিনি রাইটার থেকে মুর্শিদাবাদের কালেক্টর হন। পরবর্তীকালে জুলিয়াস ইমহফ প্রোমোশন পেয়ে মেদিনীপুরের ম্যাজিস্ট্রেট হিসাবেও কাজ করেছিলেন।
জুলিয়াস তাঁর স্ত্রী ও তিন সন্তান উইলিয়ম, চার্লস এবং জনকে নিয়ে হেস্টিংস হাউসেই বসবাস করতেন। এই বাড়িতেই তাঁর তিন পুত্র অপঘাতে মারা যায়।
বড় ছেলে উইলিয়মের বয়স তখন দশ বছর। চমৎকার মায়াবী এক আলোমাখা বিকেলে সে হেস্টিংস হাউসের কম্পাউন্ডে খেলছিল। হঠাৎই শুরু হল প্রবল ঝড়। ধুলোয় ঢেকে গেল চর্তুদিক। সেইসময় উইলিয়ম দেখতে পেল দীর্ঘদেহী এক মানুষকে। সেই ছায়া মূর্তির তীব্র ঘৃণাভরা চাউনিতে শিউরে উঠেছিল দশ বছরের উইলিয়াম। প্রবল ভয় পেয়ে সে ছুটতে শুরু করে। কোনওক্রমে ঘরে ঢুকে সে লুটিয়ে পড়েছিল মাটিতে।
সেদিন রাতেই উইলিয়াম প্রবল জ্বরে আক্রান্ত হল। এরপর সে বেঁচেছিল মাত্র তিনদিন। এই মৃত্যুর কিছুদিন বাদেই ওই কম্পাউন্ডে উইলিয়মের পরের ভাই চার্লসকে নিয়ে বেড়াতে বেরিয়েছিলেন এক মহিলা। তিনি ছিলেন চার্লসের আয়া। চার্লসও আর ঘরে ফিরতে পারেনি। হেস্টিংস হাউসের পাতকুয়োতে কোনওভাবে পড়ে গিয়ে সেদিন তার মৃত্যু হয়। আয়া সঙ্গে থাকা সত্ত্বেও কীভাবে চার্লস কুয়োতে পড়েছিল সে রহস্যের উন্মোচন আজও হয়নি।
জুলিয়াসের ছোটপুত্র জন অবশ্য কিছুদিন পৃথিবীতে থাকার সুযোগ পেয়েছিলেন। বেশ বড় হওয়ার পর কোনও গুপ্ত আততায়ীর হাতে তাঁর প্রাণ যায়।
তিন পুত্রকে অকালে হারিয়ে খুবই ভেঙে পড়েছিলেন জুলিয়াস। তিনি তাঁর সৎ পিতা ওয়ারেন হেস্টিংসকে পরবর্তীকালে একটি করুণ চিঠি লিখেছিলেন—‘In the grounds between Hasting’s House and the Judge’s court my three children William, Charles and John lie buried...’
উইলিয়ম যে দীর্ঘদেহী ছায়ামূর্তিকে দেখে ভয় পেয়ে প্রবল জ্বরে আক্রান্ত হয়েছিল তাঁর পরিচয় পরবর্তীকালে কিছুটা হলেও আমরা জানতে পেরেছি। হেস্টিংসের ঘনিষ্ঠ বন্ধুবান্ধব ও সেই ছায়ামূর্তিকে গভীর রাতে জাজেস কোর্টের প্রাচীরের কাছে যাঁরা ঘোরাফেরা করতে দেখেছেন, তাঁরা বলতেন, তিনি আর অন্য কেউ নন, মেরিয়ান ইমহফের প্রথম পক্ষের স্বামী ব্যারন ইমহফ। অনেকেই মনে করতেন মেরিয়ানকে কাছে পাবার জন্য অতি সুকৌশলে ব্যারনকে এই পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিয়েছিলেন হেস্টিংস। তাই পরপার থেকে হেস্টিংস ও মেরিয়ানের ওপর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য অশরীরী ব্যারন মাঝে মাঝেই ছুটে আসতেন হেস্টিংস হাউসে।
এখন এই হেস্টিংস হাউসেই গড়ে উঠেছে টিচার্স ট্রেনিং কলেজ। যখন এখানে হস্টেল ছিল, তখন সেখানকার আবাসিকরাও মাঝেমাঝেই নিশি রাতে ঘোড়ার খুরের খট, খট শব্দ শুনতে পেতেন। শুধু তাই নয় মাঝরাতে ওই বাড়ির হলঘরে দীর্ঘদেহী এক ছায়ামূর্তিকে ঘোরাফেরা করতে দেখেছেন অনেকেই।
পুরনো কলকাতার ইতিহাস ও সরকারি নথিপত্রে এই হেস্টিংস হাউসের কুখ্যাতির কথা লিপিবদ্ধ আছে। সেখানে বলা হয়েছে ‘ For calcutta tradition connects the ‘House’ with a famous ghost.’