উপার্জন বেশ ভালো হলেও ব্যয়বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে সঞ্চয় তেমন একটা হবে না। শরীর খুব একটা ... বিশদ
লরেটো কলেজের ইংরেজি অনার্সের এই প্রাক্তনী নিজে ইংরেজি, হিন্দি, বাংলার পাশাপাশি জানেন ফরাসি এবং জার্মান ভাষার মতো দু-দুটি ইউরোপীয় ভাষা। স্নাতক হওয়ার পর প্রথমে কিছুদিন যুক্ত ছিলেন বিবিসি বাংলা-র সঙ্গে। কিন্তু চাকরি ভালো লাগেনি। হতে চেয়েছিলেন স্বনির্ভর। চেয়েছিলেন ট্রান্সলেটর এবং ইন্টারপ্রেটার হিসাবে নিজের কর্মজীবনকে এগিয়ে নিয়ে যেতে। সেই লক্ষ্যেই তৈরি করলেন ‘মনো ট্রান্সলেশন ব্যুরো’। ১৯৮৯ সালের ৩ জুন পথচলা শুরু করে মালবিকার এই সংস্থা। নিজে অনুবাদের কাজ তো করেনই। সেই সঙ্গে আছেন নানা ভাষার বিশেষজ্ঞরা। সংস্থার প্যানেলে নথিবদ্ধ সেইসব ভাষাবিদরা ভাষান্তর করেন নানা নথি, তথ্য বা সাহিত্যকর্ম। ’৮৪ সালে বার্নপুর থেকে মালবিকার পরিবার দক্ষিণ কলকাতার ত্রিকোণ পার্কে পৈতৃক বাড়িতে এসে থিতু হয়। বর্তমানে অবশ্য সেই নিবাস পাল্টে গিয়েছে প্রবাল চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে বিবাহের সূত্রে। প্রবালবাবু নিজেও এক সময় একটি সর্বভারতীয় ইংরেজি দৈনিকের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এখন তিনিই স্ত্রীর মূল উৎসাহদাতা।
মালবিকার ঝুলিতে আছে বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য অনুবাদ কর্ম। পরিণীতা ছবির চিত্রনাট্য রচনার প্রয়োজনে শরৎবাবুর বাংলা রচনার অনুবাদ করেন তিনি। সেই ইংরেজি অনুবাদের বিশেষ সংস্করণ প্রকাশ করেছিল পেঙ্গুইন। অস্কারের শর্টফিল্ম বিভাগে ২০০৫ সালে পুরস্কৃত ছবি Born into Brothels-এর জন্যও দোভাষীর কাজ করেছেন মালবিকা।
এছাড়াও শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়-এর বেশ কিছু কালজয়ী উপন্যাসের ইংরেজি অনুবাদ করেছেন এই অনুবাদক। যেগুলি জায়গা পেয়েছে পেঙ্গুইন প্রকাশিত শরৎ এবং বঙ্কিম অমনিবাসের বিভিন্ন সংস্করণে। শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের দশটা গল্পের ইংরেজি অনুবাদ ‘The Skrelet dusk and other stories’-এর কারিগরও মালবিকাই।
রবি ঠাকুরের অতিথি, দেনাপাওনা, নষ্টনীড়, খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন, কাবুলিওয়ালা, স্ত্রীর পত্র ইত্যাদি একাধিক ছোটগল্পের সংকলন ফ্রন্টপেজ প্রকাশিত ‘Tagore’s Best Short Stories’-এর ইংরেজি সংস্করণের নির্মাতা মালবিকা চট্টোপাধ্যায়, বিভিন্ন সময়ে দো-ভাষী এবং অনুবাদক হিসাবে কাজ করেছেন ব্রিটিশ হাইকমিশন, ভারতীয় প্রতিরক্ষা বাহিনী এবং দেশি-বিদেশি একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার জন্য।
তবে তাঁর সংস্থা শুধুমাত্র অনুবাদকর্ম বা দোভাষীর কাজই করে না, তৈরি করে আগামী দিনের ভাষাবিদদেরও। তাই মনোট্রান্সলেশন ব্যুরোতে আছে অনলাইন ভাষা শিক্ষার ব্যবস্থা। ব্যক্তিগতভাবে শিখতে চাইলে যোগাযোগ করিয়ে দেওয়া হয় ভাষা শিক্ষকদের সঙ্গেও।
মালবিকার পারিবারিক ঐতিহ্যও যথেষ্ট সমৃদ্ধ। দাদু মনোরঞ্জন সেনগুপ্ত ছিলেন ব্রিটিশ ভারতে ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল সার্ভিসে কর্মরত। শল্যচিকিৎসক হিসাবে কর্মদক্ষতার জন্য পরাধীন ভারতে ২৪ ক্যারেটের ১৭টি মেডেল তিনি অর্জন করেছিলেন কর্মজীবনে। বাকিংহাম প্যালেস থেকে পঞ্চম জর্জ স্বাক্ষরিত ও প্রেরিত তাঁর পেনশনের নথি এখনও সংরক্ষিত আছে মালবিকাদের পরিবারের হেফাজতে। সেই আমলে একটি রোলস রয়েস গাড়ির মালিকানা ছিল এই যশস্বী চিকিৎসকের। জানিয়েছেন মালবিকা। অন্যদিকে, ঠাকুরদা হীরকচন্দ্র চৌধুরি ছিলেন অবিভক্ত ভারতবর্ষের বাংলা-বিহার ও ওড়িশার আয়কর বিভাগের কমিশনার। প্রসঙ্গত মালবিকা বলছিলেন, নিজের একক উদ্যোগে মনোট্রান্সলেশন ব্যুরো প্রতিষ্ঠিত এবং পরিচালিত হয় বলে সংস্থার নামের সঙ্গে ‘মনো’ শব্দটি রাখা হয়েছে। আবার একই সঙ্গে দাদু মনোরঞ্জনবাবুর নামের অংশ বিশেষ হিসাবেও ‘মনো’ শব্দটি সংস্থার নামের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়েছে বলে উল্লেখ করা যায়। এক ঢিলে দুই পাখি যে মালবিকা মেরেছেন এ কথা বলা যেতেই পারে। শুধু তাই নয়, দাদুর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের সুযোগও নাতনি কাজে লাগিয়েছেন পুরোদমে।
জোকার বাড়িতে বসে সম্প্রতি মালবিকা শোনালেন তাঁর সংস্থার করা দুটি উল্লেখযোগ্য ভাষান্তর পর্বের কাহিনী।
মনোট্রান্সলেশন ব্যুরো কাজ শুরুর একেবারে গোড়ার দিকে বরাত পেয়েছিল একটি কৃষি বিষয়ক চুক্তির নথি অনুবাদের। ফিনিশ ভাষায় লিখিত ওই নথিটিকে ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ করাই ছিল বরাতের একমাত্র শর্ত।
কলকাতায় বসে ফিনিশ ভাষা জানা মানুষের সন্ধান পাওয়া কঠিন জেনেও পিছিয়ে যাননি মালবিকা চট্টোপাধ্যায়। শহর তোলপাড় করে দক্ষিণ কলকাতার রাজা বসন্ত রায় রোড থেকে খুঁজে বের করেছিলেন ফিনল্যান্ডের এক মেমসাহেবকে। বিবাহসূত্রে তিনি তখন এক বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবারের গৃহবধূ। উত্তরাধিকার সূত্রে যে পরিবারটি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বংশের এক পরবর্তী প্রজন্ম বলে জানতে পেরেছিলেন মালবিকা। যাইহোক, বাঙালি পরিবারে বিয়ে হওয়া সেই শ্বেতাঙ্গিনীর নাম ছিল রীতা ক্রিস্টিনা নিউম্যান বন্দ্যোপাধ্যায়। মাতৃভাষা তাঁর ফিনিশ হলেও, ইংরেজিতে তিনি খুব বেশি সড়গড় ছিলেন না। প্রয়োজন পড়ল তাই শব্দকোষের। নাছোড় মালবিকা তখন কলকাতার সাম্মানিক কনসাল জেনারেলের সহযোগিতায় যোগাযোগ করলেন দিল্লির ফিনিশ দূতাবাসের সঙ্গে, অভিধান এল।
ফিনিশ মহিলা ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে অনুবাদ করলেন। তারপর সাজিয়েগুছিয়ে পরিপাটি করে ওই নথি সম্পূর্ণ পরিমার্জন করে অর্থবোধক করে তুললেন মালবিকা এবং সময়ের মধ্যেই তা তুলে দিলেন বরাত দেওয়া কোম্পানিটির প্রতিনিধির হাতে।
আবার আরেকবার বিশ্বকাপ ফুটবল চলাকালীন ফুটবল নিয়ে ছোট পর্দায় একটি অনুষ্ঠান তৈরি করার সময় ইতালি এবং পর্তুগিজ ফুটবলের ফুটেজের প্রয়োজন পড়ল নির্মাণকারী সংস্থার। কিন্তু বিদেশি দুই সংস্থার কাছে ইংরেজিতে চিঠি লিখে যোগাযোগে ব্যর্থ হয়ে নির্মাতারা শরণাপন্ন হলেন মনোট্রান্সলেশন ব্যুরোর। মালবিকা এবং তাঁর সহযোগীরা বিশ্বফুটবলের ওই দুই বৃহৎ শক্তির ফুটবল সংস্থার কর্তা ব্যক্তিদের সঙ্গে ইতালিয় এবং পর্তুগিজ ভাষায় চিঠি চালাচালি করে কাজের সমস্ত বাধা সরান অবলীলায়। চাহিদা মিটল নির্মাণকারী সংস্থার। তৈরি হল অনুষ্ঠান। প্রায় তিরিশ বছর ধরে নিরলস মালবিকা এভাবেই ভাষার বাধা কাটিয়ে সেতুবন্ধন করে চলেছেন বিভিন্ন ভাষাভাষীদের মধ্যে। এই কাজে ক্লান্তিহীন তিনি তাই সহজেই বলতে পারেন, ‘ভাষা নিয়ে, শব্দ নিয়ে খেলা করাটা আমার অভ্যেস। ট্রান্সলেটর বা ইন্টারপ্রেটারের কাজ আমার কাছে কেবলমাত্র জীবিকা নয়, নেশাও। ভাষা চর্চার এই কাজকে আমি ভালোবাসি। তাই হৃদয় দিয়ে কাজ করি।’