উপার্জন বেশ ভালো হলেও ব্যয়বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে সঞ্চয় তেমন একটা হবে না। শরীর খুব একটা ... বিশদ
‘কলিকাতা শহরের চারদিকেই ঢাকের বাজনা শোনা যাচ্চে, চড়কির পিঠ সর সর কচ্চে, কামারেরা বান, দশলকি, কাঁটা ও বঁটি প্রস্তুত কচ্চে—; সর্বাঙ্গে গয়না, পায়ে নূপুর, মাতায় জড়ির টুপি, কোমরে চন্দ্রহার, সিপাহ পেড়ে ঢাকাই শাড়ি মালকোচা করে পড়া, তারকেশ্বরে ছোবান গামচা হাতে বিল্বপত্র বাঁদা সুতা গলায় যত ছুতোর, গয়লা, গন্ধ বেণে ও কাঁসারির আনন্দের সীমা নাই— ‘আমাদের বাবুদের বাড়ি গাজন’।’
উৎসবকে ঘিরে সাধারণ মানুষের যে উদ্দীপনা আর আনন্দ তারই খুঁটিনাটির প্রাঞ্জল বর্ণনা আমরা হুতোমের নকশায় পাই।
‘গাজন তলায় সজোরে ঢাকঢোল বেজে উঠল, সকলে উচ্চস্বরে ‘ভদ্দেশরে শিবো মহাদেব’ বলে বলে চিৎকার করতে লাগল; বাবু শিবের সন্মুখে ভূমিষ্ঠ হয়ে প্রণাম কল্লেন।— বড় বড় হাত পাখা দু’পাশে চলতে লাগল, বিশেষ কারণ না জানলে অনেকে বোধ কত্তে পারত যে, আজ বাবু বুঝি নরবলি হবেন। অবশেষে বাবুর দু’হাত একত্র করে ফুলের মালা জড়িয়ে দেওয়া হল। বাবু কাঁদ কাঁদ মুখ করে রেশমি রুমাল গলায় দিয়ে এক ধারে দাঁড়িয়ে রইলেন, পুরোহিত শিবের কাছে— ‘বাবা ফুল দাও, ফুল দাও’, বারংবার বলতে লাগল, বাবুর কল্যাণে এক ঘটি গঙ্গাজল পুনরায় শিবের মাতায় ঢালা হল...’
বাংলায় ইংরেজ শাসন চালু হলে ছিন্নমূল মানুষের পাশাপাশি প্রতাপশালী ‘বাবু’ নামক এক নতুন শ্রেণীর উদ্ভব ঘটেছিল। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রাজত্বকাল শুরু হওয়ার পর থেকেই ক্রমশ এঁরা অদৃশ্য হয়ে বিদায় নিল। পরিবর্তে তৈরি হল ইংরেজদের বদান্যতায় নতুন ধনী সম্প্রদায়। রাজা মহারাজা উপাধি নিয়ে অট্টালিকা, জুড়ি গাড়ি, দাসদাসী আর মোসাহেব নিয়ে এই নব্যবাবু কূল যত্রতত্র ছড়িয়ে পড়লেন। আমোদ প্রমোদই ছিল এই সম্প্রদায়ের একমাত্র কর্ম। এই বিলাসী বাবুকূল সম্বন্ধে হুতোম বলেছেন—‘বাবু মাত্রই ধনী কিন্তু ধনী হইলেই বাবু হয় না।’ হুতোমের নকশায় বলা হয়েছে, ‘বাঙালী আমোদ গেঁড়ে’। তাই সবকিছুতেই তাঁদের আনন্দ আর আহ্লাদ। সেকালের যে কোনও উৎসবই ছিল বাবুকেন্দ্রিক। তাই তাঁদের কথা ঘুরে ফিরে এসেছে হুতোমের নকশায়। হুতোমের বর্ণনায়— ‘রাস্তায় লোকারণ্য, চারদিকে ঢাকের বাদ্যি, ধুনোর ধোঁ আর মদের দুর্গন্ধ। সন্ন্যাসীরা বাণ, দশলকি, সূতোশোন, সাপ, ছিপও বাঁশ কুড়ে একবারে মরিয়া হয়ে নাস্তে নাস্তে কালীঘাট থেকে আসচে।... চড়ক গাছ পুকুর থেকে তুলে মোচ বেন্ধে মাথায় ঘি কলা দিয়ে খাড়া করা হয়েচে। ক্রমে রোদ্দুরের তেজ পড়ে এলে চড়কতলা লোকারণ্য হয়ে উঠল। শহরের বাবুরা বড় বড় জুড়ী, ফেটিং ও স্টেট ক্যারেজে নানারকম পোষাক পড়ে চড়ক দেখতে বেরিয়েচেন।... এ দিকে চড়তেলার টিনের ঘুরঘুরী, টিনের মহুরি দেওয়া তালতা বাঁশের বাঁশী। হলদে রং করা বাঁখারির চড়ক গাছ, ছেড়ে ন্যাকড়ার তইরি গুরিয়া পুতুল, শোলার নানাপ্রকার খেলনা, পেল্লাদে পুতুর, চিত্তির করা হাঁড়ি বিক্রি কত্তে বসেচে।... একজন চড়কী পিঠে কাঁটা ফুড়ে নাচতে নাচতে এসে চড়ক গাছের সঙ্গে কোলাকুলি কল্লে— খৈয়ে করে তাকে উপরে তুলে পাক দেওয়া হতে লাগল।... চড়কী প্রাণপণে দড়ি ধরে কখন ছেড়ে, পা নেড়ে ঘুত্তে লাগল। ...একজনের পিঠ ফুড়ে ঘোরানো হচ্চে, হাজার লোকে মজা দেকচেন!’
হুতোম দেশীয় মানুষের কথা দেশীয় ভঙ্গিতেই বলেছেন। আসলে এই রচনার মধ্য দিয়ে তিনি তৎকালীন সামাজিক অবক্ষয়ের চিত্র তুলে ধরেছেন। ব্যঙ্গ ও বিদ্রুপের তীক্ষ্ণতায় বিঁধতে চেয়েছেন হুজুগে বাবু সম্প্রদায়কে।
হুতোমের চড়ক বর্ণনা শেষ হচ্ছে নববর্ষের প্রসঙ্গ দিয়ে। ‘ইংরেজরা নিউ ইয়ারের বড় আমোদ করেন। আগামীকে দাড়াগুয়া পান দিয়ে বরণ করে ন্যান— নেশার খোঁয়ারির সঙ্গে পুরাণকে বিদায় দেন। বাঙালিরা বছরটি ভালো রকমেই আর খাড়াবেই শেষ হোক, সজনে খাড়া চিবিয়ে ঢাকের বাদ্দি আর রাস্তার ধুলো দিয়ে পুরাণকে বিদায় দেন।’
সাড়ম্বরে চড়ক উদযাপন করার পর, পরের দিন ‘মনে’ রাখার মতো আর সেরকম তাগিদ দেখা যেত না। ফলে, নববর্ষ গার্হস্থ উৎসব হিসেবেই রয়ে গেল। হুতোমের কথা অনুযায়ী সেই আদ্দিকাল থেকেই এই খাতাওয়ালারাই বাঁচিয়ে রেখেছেন নববর্ষকে। এই খাতাতেই লেখা শুরু হয় নতুন বছরের লেনদেন, বাকি-বকেয়ার হিসেব-নিকেশ। পঞ্জিকা কিনে ব্যবসায়ীরা লাল খাতায় আর লক্ষ্মী-গণেশ পুজো দিয়ে শুরু করতেন নতুন বছর। পুজো-আচ্চা ছাড়া খাওয়া-দাওয়ার এক বিশেষ গুরুত্ব আছে নতুন বছরে পদার্পণের শুভ মুহূর্তে। আর ছিল স্বপরিবারে পেট পুরে মধ্যাহ্ন ভোজন। কোথাও ৫২ পদে ভূরিভোজ কোথাও আবার ৪২ পদে। শুরু হত বাবুর বাড়ির ‘মোচ্চব’! বাড়ির বউ-মেয়েদের দম ফেলার সময় থাকত না। সকাল সকাল স্নান সেরে নতুন শাড়ি, নাকে নথ, আর পায়ে নূপুর পরে ঝমঝমিয়ে বেড়াচ্ছে তারা— সারা বাড়ি। শুধু তাই নয়, যে বাবু সারা মাস নেশা করেন, গণিকালয়ে পড়ে থাকেন তিনিও নতুন বছরে ঘরে ছুটে আসেন— ‘কর্মশেষে নববর্ষে বাবু ঘরে আসে/ হাতে মিষ্টি, ইসেন্স শিশি আর পাঁজি পাশে।’
বাঙালির সাধারণ পরিবারেও বরণ করা হত নতুন বছরকে। ছোট আদালতের উকিল, সেকশন রাইটার, তেলি, ঢাকাই কামার পাড়াগেঁয়ে জমিদার সবার মনেই ফুর্তি আর ধরে না। কেন না বাঙালির নববর্ষ আসছে যে!
তনুশ্রী কাঞ্জিলাল মাশ্চরক