উপার্জন বেশ ভালো হলেও ব্যয়বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে সঞ্চয় তেমন একটা হবে না। শরীর খুব একটা ... বিশদ
‘এই নারী নির্যাতন বন্ধ হোক’— এই শিরোনামে সম্পাদকীয়তে লেখা হয়— ‘নির্ভয়া থেকে আসিফা— কমবয়সি মহিলাদের উপর বর্বর অত্যাচারের কাহিনী দেশজুড়ে অব্যাহত রয়েছে। ....কাঠুয়া ও উন্নাওয়ের ঘটনা কিন্তু তার চেয়েও সাংঘাতিক। ইতিমধ্যেই দেশের সীমানা পেরিয়ে বিদেশেও ওই দুই গণধর্ষণের কাহিনী লোকের মুখে মুখে ঘুরছে।’ (বর্তমান, ২১.০৪.২০১৮) লক্ষণীয় ‘কমবয়সি’ আর ‘গণধর্ষণ’ শব্দ দুটি যা কিনা সাম্প্রতিক নারী নির্যাতনের সদ্যজাত দস্তুর। ইদানীং ধর্ষকরা এভাবেই ধর্ষণের, নির্যাতনের পথ প্রস্তুত করছে। মনস্তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখলে বলা যায় রুচি-স্বাদেরও বদল যেমন হয়— তেমনি আছে সহজলভ্যতা ও একসঙ্গে মজা লোটার আনন্দও।
ওই একই সম্পাদকীয়তে লেখা হয়, ‘গরিব ঘরের নাবালিকা মেয়ে সম্ভ্রান্ত শিক্ষকের বাড়িতে পরিচারিকার কাজ নিয়ে গিয়েছিল। ঘটনাটি ২০১২ সালের মে মাসের। কিন্তু নিরাপত্তার বদলে ওই প্রতিষ্ঠিত শিক্ষকটি নাবালিকা পরিচারিকাকে বারবার ধর্ষণ করে। ...দীর্ঘ প্রায় ছ’বছর মামলা চলার পর শিক্ষকে ফাঁসির সাজা শোনাল তমলুকের আদালত। বিচারক সঞ্চিতা সরকার কামদুনি মামলারও বিচারক ছিলেন। সেই দিক দিয়ে এই রায়ের তাৎপর্য অপরিসীম।’ তবে পকসো (Protection of Child from Sexual Offence) আইনে শাস্তি আরও কঠোরতর করতে হবে। না হলে আইনের ফাঁক গলে অপরাধীরা পালিয়ে যাবে।
আবার অশুভ স্পর্শেরও শিকার কোলের শিশুরাও। পাড়া প্রতিবেশী, চেনা-অচেনা, কাকু-জেঠুদের সামান্য স্পর্শ, ছোঁয়াতেও আতঙ্কিত তারা। সামান্য চকোলেট, বিস্কুট, আইসক্রিমের লোভে নিষ্পাপ সরল কোলের শিশুরা অন্যের কোলে চড়ে বসছে নির্দ্বিধায়। ফলত যা সর্বনাশ হবার হয়ে যাচ্ছে অজ্ঞাতসারে। বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ‘ক্রাই’ (CRY)-এর রিপোর্ট জানাচ্ছে— ‘ভারতে প্রতি ১৫ মিনিটে একটি শিশুকে যৌন নিগ্রহ করা হচ্ছে।’ আরও জানা যাচ্ছে যে ২০১৬ সালে ‘পক্সো’ আইনে নথিভুক্ত অপরাধের ঘটনার বিশ্লেষণ করে এক-তৃতীয়াংশ অপরাধই শিশুদের উপর যৌন অত্যাচার। ২০০৬ সালে যেখানে শিশুদের বিরুদ্ধে অপরাধের ১৮ হাজার ৬৯৭টি ঘটনা নথিভুক্ত হয়েছিল, ২০১৬ সালে তা বেড়ে হয়েছে ১ লক্ষ ৬ হাজার ৯৫৮।
এই হাড়হিম করা গা শিউরে ওঠা পরিসংখ্যান সমাজে শিশুসুরক্ষা ও নিরাপত্তার বিষয়টিকে প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিচ্ছে। পথশিশুদের অবস্থা তো আরও ভয়াবহ ও অমানবিক। নারী নির্যাতনের সন্ত্রাস আজ গ্রাস করেছে সারা দেশকে।
রবীন্দ্রনাথের ‘যোগাযোগ’ উপন্যাসের কুমু মধুসূদনের সঙ্গে অনিচ্ছাসত্ত্বেও শারীরিকভাবে মিলিত হয়ে চেয়েছিল প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ষণের, শ্লীলতাহানির চিহ্নগুলো চন্দন-গোলা জলে ধুয়ে ফেলার জন্য। মহাভারতে পাণ্ডব-পত্নী দ্রৌপদীও এমনটাই চেয়েছিলেন। দুঃশাসনের রক্তে স্নান করে শুদ্ধ হতে, কেশদাম ধৌত করতে। মহাশ্বেতাদেবীর ‘দ্রৌপদী’ গল্পের দ্রৌপদী অবশ্য এমনটা পারেনি। বরং তার অসহায় করুণ অবস্থা— ‘নড়তে গিয়ে ও বোঝে এখনও ওর দু’ হাত দু’ খুঁটোয় এবং দু’ পা দু’ খুঁটোয় বাঁধা। ...নীচে চটচটে কী যেন। ওরই রক্ত।’ মহাশ্বেতাদেবীর ‘দ্রৌপদী’-র মতো কাঠুয়া, উন্নাও, কামদুনি, নির্ভয়াকাণ্ডের মেয়েরা শুধুই রক্তাক্ত হয়েছে, শোণিত অবগাহনে শুদ্ধ হতে পারেনি, চন্দন-গোলা জলে মুছে ফেলতে পারেনি পৈশাচিক বর্বরোচিত অত্যাচারের গণধর্ষণের ক্ষতবিক্ষত চিহ্ন। আসলে শরীর থেকে ক্ষত মুছতে চাইলেও মনের গ্লানি মোছে না। মহাশ্বেতাদেবী কয়েক দশক আগে প্রতি চুয়ান্ন মিনিটে নারী নির্যাতন, শ্লীলতাহানির কথা লিখেছিলেন। আর এখন তা ‘ক্রাই’-এর রিপোর্ট অনুযায়ী প্রতি ১৫ মিনিটে ঘটছে। নারী নির্যাতনের সন্ত্রাস কি এভাবেই বারবার রক্তাক্ত করবে গোটা নারীসমাজকে? আর সময় শুধুই মেপে চলবে যাবতীয় নির্যাতনের ঘটনা?
সুমিত তালুকদার