শ্রীশ্রীবাবামণি বলিলেন,—এই দুইজন মহাপুরুষের মধ্যে যদি তুলনা শুরু করে, নিশ্চয় তোমার প্রবৃত্তি হবে প্রথমোক্ত মহাপুরুষকে ছোট এবং শেষোক্ত মহাপুরুষকে বড় বল্তে। যুক্তি দেখাবে—উনি হচ্ছেন, নাসিকা-কুঞ্চনকারী ছুৎমার্গ, আর ইনি হচ্ছেন, সর্ব্বজীবে সমদর্শী প্রেমিক। কিন্তু এতে তোমার বিপদ আছে। হয়ত গণিকার মুখে হরিনাম শুনেও প্রথমোক্ত মহাপুরুষের প্রাণে দিব্য প্রেমেরই সঞ্চার হ’ত, অনিত্যদেহ-বিশিষ্টা গণিকাকে উপেক্ষা ক’রে নিত্যবস্তু নাম তাঁকেও হয়ত সমাধিস্থ কত্ত, এতটা গভীর, এতটা নিবিড় প্রেমরসসঞ্চার তাঁর হৃদয়েও হয়ত আছে। কিন্তু হরিনামকে উপলক্ষ্য ক’রে মানুষ যে গণিকাকেই দেখতে যায়, গণিকারই সংশ্রব পেতে চায়, মানুষের সেই পাপকে, সেই দুর্ব্বলতাকে প্রতিবাদের আঘাতে দূর করা, তিনি লোকহিত তথা ভগবানের কাজ ব’লে মনে করেছেন। তাই তিনি সর্ব্বজীবে সমদর্শী হ’য়েও চান যে, মানুষ শুদ্ধদেহে শুদ্ধ মনেই হরিনাম করুক বা হরিকথা বলুক, নিজের কর্ণসুখের জন্য হরিনাম-গান না শুনে ভগবানের প্রীতি উদ্দেশ্য ক’রেই শুনুক; ভগবানের নামের দোহাই দিয়ে আহৃত অর্থ সাধারণ মানুষের ভোগ পরিতৃপ্তিতে ব্যয়িত না হ’য়ে ভগবানের সেবায় লাগুক। সুতরাং তার পক্ষে পরমপ্রেমিক হ’য়েও এরূপ নিমন্ত্রণ রক্ষার কোন উপায় নেই। কে কি উদ্দেশ্যে কোন্ কাজটী করেছেন, চিন্তা করলে আর সাধুনিন্দার পাপে পড়তে হয় না। আমি যে মহাপুরুষদের কথা তোমাদের বললাম, তাঁর মধ্যে প্রথমোক্ত মহাপুরুষের শিষ্যানুশিষ্যদের আচরণ এবং কর্ম্ম দেখলে অবাক্ হ’তে হবে যে, বৈষ্ণব-নামধারীদের ভিতর থেকে ব্যভিচারকে তাঁরা কিভাবে ঝেটিয়ে বিদায় করেছেন। শিষ্যপ্রশিষ্যদের সংকীর্ত্তি থেকে এরূপ বিচার করা চলে যে, প্রথমোক্ত মহাপুরুষ থিয়েটারে গৌরলীলা অভিনয় দেখতে অস্বীকার ক’রে আদর্শনিষ্ঠারই পরিচয় দিয়েছেন। তাঁর জীবন থেকে তোমরা এই উপদেশ নিতে পার যে, সিদ্ধ-মহাপুরুষেরও যখন আদর্শ-নিষ্ঠা প্রয়োজন, তখন আমাদের মত সামান্য মানবের পক্ষে কোনো যুক্তিতেই আদর্শ পরিত্যাগ সঙ্গত হবে না। অর্থাৎ দু’জনের মধ্যে তুলনা ক’রে শ্রেষ্ঠ নিকৃষ্টের বিচারে সময় ও প্রতিভার অপচয় না ক’রে পৃথক ভাবে ধ’রে কার জীবন থেকে আমরা কতটুকু কুশল আহরণ কত্তে পারি, সেই চেষ্টাই করা কর্ত্তব্য।
অপর একটী প্রসঙ্গে শ্রীশ্রীবাবামণি বলিলেন,—মহাপুরুষদের জাতি-বিচার কত্তে যেও না। মহাপুরুষ’ই একটা আলাদা জাতি। নরহরি ঠাকুর, সাধক রামপ্রসাদ প্রভৃতি ছিলেন বৈদ্যের ছেলে। কিন্তু তাঁরা নিজেরা বৈদ্য ছিলেন না, —ছিলেন মহাপুরুষ। বুদ্ধদেব, জিন মহাবীর, গুরু-নানক প্রভৃতি ক্ষত্রিয়ের ঘরে জন্মেছিলেন, কিন্তু নিজেরা কেউ ক্ষত্রিয় ছিলেন না,—ছিলেন মহাপুরুষ। নরোত্তম দাস ঠাকুর, দাস রঘুনাথ গোস্বামী, স্বামী বিবেকানন্দ প্রভৃতি ছিলেন কায়স্থের ছেলে। কিন্তু তাঁরা নিজেরা কায়স্থ ছিলেন না,—ছিলেন মহাপুরুষ। বলদেব বিদ্যাভূষণ খন্ডাইতকুলে জন্মেছিলেন, কিন্তু নিজে খন্ডাইত ছিলেন না, —ছিলেন মহাপুরুষ। উদ্ধারণ ঠাকুর জন্মেছিলেন সোনার বেনের ঘরে, ঝড়ুঠাকুর জন্মেছিলেন ভুঁইমালীর ঘরে, কবীর সাহেব আর ঠাকুর হরিদাস জন্মেছিলেন মুসলমানের ঘরে, কিন্তু জাতিতে এঁরা কেউ সোনার বেনে, ভুঁইমালী বা মুসলমান ছিলেন না, —ছিলেন মহাপুরুষ। দাদুজী আর রোহিদাসের কি কেউ জাতি জিজ্ঞাসা করেছে? সবাই তাঁদের মহাপুরুষ ব’লেই পুজো করেছে।
শ্রীশ্রীবাবামণি বলিলেন, —উপাস্যের চরণে অকুণ্ঠ আত্মসমর্পণই মহাপুরুষের প্রকৃত জন্মস্থান।
স্বরূপানন্দ পরমহংস দেবের ‘অখণ্ডনসংহিতা’ (৪র্থ খণ্ড) থেকে