খরচের চাপ এত বেশি থাকবে সে সঞ্চয় তেমন একটা হবে না। কর্মক্ষেত্রে নানান সমস্যা দেখা ... বিশদ
বহু পুণ্যকর্ম এবং বীরত্বাদি অনেক সদ্গুণ থাকিলে তবে সাম্রাজ্যলাভ সম্ভব হয়। ব্রহ্মানুভূতিও এইরূপ বহু সাধনার ফলে মেলে। তাহা হাসিয়া খেলিয়া পাওয়া যায় না। সাম্রাজ্যলাভের সঙ্গে মোক্ষপ্রাপ্তির তুলনা করা হইয়াছে। ভাষার উপর অধিকার, শব্দপ্রয়োগে নৈপুণ্য, শাস্ত্র ব্যাখ্যায় চাতুর্য, আর কাব্য-অলঙ্কারাদিতে পাণ্ডিত্য, বিদ্বান্ ব্যক্তিগণের ভোগ্যবস্তুপ্রাপ্তির সহায়ক হইতে পারে। এসকল কিন্তু মুক্তি লাভের সহায়তা করে না।
আত্মস্বরূপ অবিজ্ঞাত থাকিলে শাস্ত্রপাঠ নিষ্ফল হয়। আর আত্মস্বরূপ বিজ্ঞাত হওয়ার পর শাস্ত্রধ্যয়ন নিষ্প্রয়োজন হইয়া পড়ে।
শাস্ত্রপাঠের দ্বারা ব্রহ্মবিষয়ে অপ্রত্যক্ষ জ্ঞান হইতে পারে। কিন্তু শাস্ত্রপাঠের দ্বারা জ্ঞাত তত্ত্ব যদি জীবনে অনুভূত না হয়, ব্রহ্মের সহিত একাত্মবোধ না জন্মে, তাহা হইলে শাস্ত্রপাঠ ব্যর্থ হইয়া যায়। আর যে সাধক ব্রহ্মস্বরূপ অনুভব করিয়াছেন, তাঁহার শাস্ত্রপাঠের প্রয়োজন থাকে না। মহাবনের সদৃশ বিভিন্ন শাস্ত্রসমুদায় চিত্তে সংশয় উৎপাদনের কারণ হইয়া থাকে। অতএব বিচারশীল ব্যক্তিগণ যত্নের সহিত শ্রবণমননাদি সহায়ে আত্মার স্বরূপ অবগত হইবেন। অজ্ঞানরূপ সর্পের দ্বারা আহত ব্যক্তির বেদপাঠে বা শাস্ত্রপাঠে কী ফললাভ হয়? আর মন্ত্র বা ঔষধের দ্বারাই বা তাহার কী উপকার হয়? একমাত্র ব্রহ্মজ্ঞানরূপ ঔষধের দ্বারা তাহার মরণের হাত হইতে মুক্তিলাভ সম্ভব। ঔষধ পান না করিয়া কেবল ‘ঔষধ’-শব্দ উচ্চারণ, করিলে রোগ সারে না। অপরোক্ষানুভূতি ব্যতীত কেবল ‘ব্রহ্ম’-শব্দের উচ্চারণের দ্বারা মুক্তিলাভ হয় না।
দৃষ্টপদার্থসমূহের মিথ্যাত্ব নিশ্চয় না করিয়া, আত্মার স্বরূপ না অনুভব করিয়া কেবলমাত্র জিহ্বাদ্বারা বাহ্যশব্দের উচ্চারণের ফলে (‘আমি ব্রহ্ম’ এইরূপ বলার দ্বারা) মানুষের মুক্তিলাভ কিরূপে সম্ভব হইতে পারে? [অর্থাৎ কখনও সম্ভব নয়]। প্রতিদ্বন্দ্বী শক্রকে বিনাশ না করিয়া এবং রাজ্যলক্ষ্মী এবং রাজকোষ ও সৈন্যাদি আয়ত্তে না আনিয়া কেবলমাত্র ‘আমি রাজা’ এই শব্দের উচ্চারণের দ্বারা কেহ রাজা হইতে পারে না।
ভূগর্ভে রক্ষিত ধনরত্নাদি পাইতে হইলে প্রথমে যেমন যে ব্যক্তি উহার সন্ধান জানেন তাঁহার উপদেশ প্রাপ্তির এবং পরে ভূমিখননের, ধনের উপর স্থাপিত প্রস্তরাদির অপসারণের এবং ধনাদি স্বয়ং গ্রহণের প্রয়োজন হয়, কেবল শব্দ করিলে অর্থাৎ ‘ধন তুমি এস’ বলিয়া ডাকিলে ধনলাভ হয় না, সেইরূপ মায়ানির্মুক্ত নিজের শুদ্ধ স্বরূপ অবগত হইতে হইলে ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষের নিকট উপদেশ প্রাপ্তির পর মনন-ধ্যানাদির প্রয়োজন হয়। কেবল তর্কবিচারের দ্বারা আত্মানুভূতি হয় না।
রোগ হইতে আরোগ্য-লাভের জন্য যেমন নিজেকে ঔষধসেবনাদি করিতে হয়, সেই প্রকার ভববন্ধন হইতে মুক্তিলাভের জন্য উপযুক্ত সাধনসমূহ অবলম্বন করা বিচারশীল ব্যক্তিগণের কর্তব্য।
আজ তুমি যে প্রশ্ন করিয়াছ, তাহা অতি উত্তম। এইরূপ প্রশ্ন শাস্ত্রজ্ঞ ব্যক্তিগণের দ্বারা সমর্থিত, অতি সংক্ষিপ্ত অথচ গভীর ভাবপূর্ণ এবং মুমুক্ষু ব্যক্তিগণের জ্ঞাতব্য। হে প্রিয় শিষ্য, তোমাকে যাহা বলিতেছি, তাহা মনোযোগ-সহকারে শ্রবণ কর। ইহা শ্রবণের ফলে তুমি অচিরে সংসারবন্ধন হইতে মুক্তিলাভ করিবে। অনিত্য বস্তুসমূহে তীব্র বৈরাগ্য মোক্ষলাভের প্রধান কারণ বলিয়া কথিত হয়। ইহার পর মোক্ষলাভের অন্যান্য সহায়ক—শম, দম, তিতিক্ষা ও শ্রুতিবিহিত কর্মসমূহের নিঃশেষে ত্যাগ।
স্বামী বেদান্তানন্দ অনুদিত শঙ্করাচার্যের ‘বিবেকচূড়ামণি’ থেকে