খরচের চাপ এত বেশি থাকবে সে সঞ্চয় তেমন একটা হবে না। কর্মক্ষেত্রে নানান সমস্যা দেখা ... বিশদ
কেন এত ভয়ঙ্কর হয়ে উঠল করোনা? কারণটা খুবই সহজবোধ্য। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেও এই গ্রহের এত মানুষ, এত দেশ এভাবে লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়েননি। কিন্তু গোলাগুলি না ছুটলেও, কামান না দাগা হলেও এবার যুদ্ধের ব্যাপকতা আরও অনেক বিস্তৃত। যুদ্ধটাও নয় নয় করে প্রায় দু’মাস অতিক্রান্ত। চীন ও ইউরোপকে ঘায়েল করে এবং শক্তিশালী আমেরিকাকে পর্যন্ত বেসামাল করে করোনা এবার ১৩০ কোটি মানুষের ভারতে অনুপ্রবেশ করেছে। দেশ সেই ভয়ঙ্কর যুদ্ধের নির্ণায়ক লড়াইয়ের মুখোমুখি হতেই জাতির উদ্দেশে ভাষণে রবিবার দেশজুড়ে ‘জনতা কার্ফু’ পালনের ডাক দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। ১৯৭১-এর বাংলাদেশ যুদ্ধের পর শেষ এমন কার্ফু দেখেছিলাম ১৯৯২-তে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের ঠিক পরে। তবে, সেটা ছিল শুধুই কার্ফু। জনতার ইচ্ছা অনিচ্ছার কোনও দাম ছিল না। এবার প্রধানমন্ত্রী জনতাকে নিজের ইচ্ছায় রবিবার সকাল ৭টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত ১৪ ঘণ্টা ঘরে থাকতে বলেছেন। খুব প্রয়োজন ছাড়া আগামী কিছুদিন সবাইকে স্বেচ্ছায় ঘরবন্দি থাকারও পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। বিশেষত ষাটোর্ধ্ব প্রবীণ ব্যক্তিদের। অত্যন্ত বিনীত কণ্ঠে দেশবাসীর কাছ থেকে কিছুটা সময় চেয়ে নিয়েছেন তিনি, আশা করেছেন এবারও দেশবাসী তাঁকে নিরাশ করবেন না। আসলে এই যুদ্ধের প্রাথমিক শর্তই হচ্ছে, সঙ্কল্প ও সংযম। কোনওরকম সন্দেহ হলেই নিজেকে সমাজে আলাদা করে ফেলা। যে-কোনও রকম সভা সমাবেশ, জমায়েত এড়িয়ে চলা। বারবার সাবান দিয়ে হাত ধোয়া। স্যানিটাইজার ব্যবহার করা ও মুখে মাস্ক পরা। নিজেকে বাঁচানোর
আর কোনও অস্ত্রই নেই। প্রতিষেধক তো দূর
অস্ত! আর নিজেকে তথা গোটা মানবজাতিকে বাঁচানোর এই লড়াইয়ে যাবতীয় বৈরিতা দূরে সরিয়ে সবাই এখন ঐক্যবদ্ধ।
অথচ গত তিন দশকে অস্ত্রশস্ত্র, যুদ্ধ প্রযুক্তির কম উন্নতি তো হয়নি। পরমাণুযুদ্ধ বাধলে রক্ষা মিলবে কীভাবে সেই হিসেব-নিকেশও হয়েছে বিস্তর। কিন্তু, আকস্মিক এক ভাইরাসের আক্রমণ চীন, আমেরিকা, ইউরোপকেও অসহায় এক পরিস্থিতির মুখোমুখি এনে দাঁড় করিয়েছে। একে ৪৭ নয়, অতি আধুনিক কোনও মেশিনগানও নয়, নয় ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংসকারী রাশিয়ার এস ৪০০ সিস্টেম কিংবা আধুনিক এফ ১৬-এর মতো কোনও মারাত্মক বোমারু বিমানও। ফ্রান্সের অবস্থা আবার এতই খারাপ যে বিতর্কিত রাফাল যুদ্ধবিমান তৈরিও বন্ধই হয়ে গিয়েছে। করোনার সঙ্গে লড়াইয়ে সবই আজ অর্থহীন। অস্ত্রশস্ত্র কোনও কাজেই আসছে না। মানবজাতির অস্তিত্বকে অকস্মাৎ চ্যালেঞ্জর মুখে ফেলে দিয়েছে অবতীর্ণ আপাতনিরীহ এক ফ্লু ভাইরাস।
চীন মুলুক থেকে কয়েকমাস আগেই এর উৎপত্তি। ইবোলা, নিপা, সার্স, জিকা, প্লেগ, ক্যান্সার, টিবি পেরিয়ে এখন মানবজাতির সামনে মৃত্যুদূত হয়ে হাজির এই ‘চীনা ভাইরাস’। যদিও এর মারণ ক্ষমতা ৩ থেকে ৫ শতাংশের বেশি নয়। তবে, সংক্রমণ ছড়ানোর বিপজ্জনক প্রবণতা অন্যদের চেয়ে অনেকটাই বেশি। বিশেষ করে ৬০ থেকে ৭০ বছরের প্রবীণদের বিপদ বেশি। করোনা তাই অনায়াসেই প্রাণ নিচ্ছে দুর্বল ফুসফুসের প্রবীণ নাগরিকদের। বছরের শুরুতেই এই যুদ্ধের সূচনা চীন থেকে হলেও এখন তার এপিসেন্টার বিস্তৃত হয়েছে বিস্তীর্ণ ইউরোপে। ইতালি, স্পেন, ফ্রান্স, ব্রিটেনের অবস্থা সঙ্গীন। ইরানেও ক্রমাগত মৃত্যু বাড়ছে। আবার স্বাস্থ্যব্যবস্থা অত্যন্ত উন্নত হলেও ইতালিতে প্রায় মড়ক লেগে গিয়েছে। রোজ কয়েকশো মানুষ মারা যাচ্ছে সেখানে। স্পেনের অবস্থাও ভয়ঙ্কর! ব্রিটেনেও আক্রান্ত হয়েছে কয়েক হাজার মানুষ। সবমিলিয়ে বিশ্বজুড়ে মৃতের সংখ্যা দশ হাজার পেরিয়ে গিয়েছে। টনকটা নড়েছে সেই কারণেই। বেশ কিছুদিন ধরেই আশঙ্কা ছিল, আকস্মিক পরমাণু যুদ্ধ বাধলে পৃথিবীটাই অবলীলায় ধ্বংস হয়ে যাবে। কিন্তু, না। এক ভয়ঙ্কর জৈববিষ তথা জীবাণু যে গোকুলে বেড়ে চীনের গবেষণাগার থেকে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়বে এবং মানবজাতির অস্তিত্বের সামনে এত বড় একটা প্রশ্নচিহ্ন ঝুলিয়ে দেবে, তা দুঃস্বপ্নেও কেউ ভাবেনি।
অথচ, ইঙ্গিত একটা ছিলই। ভবিষ্যৎদ্রষ্টারা নানা হিসেব-নিকেশও করছিলেন। বিগত ১৭২০-তে প্লেগ। ১৮২০-তে কলেরা। ১৯২০-তে স্প্যানিশ ফ্লু। আর তার ঠিক ১০০ বছর পেরিয়ে এই ২০২০-তেই বা বিশ্বব্যাপী এক মহামারী বাকি থাকে কেন? ঠিক তাই হল। বছরের শুরু থেকেই চীনের উহানে শুরু এই মারণ ভাইরাসের তাণ্ডব। গত ২৩ জানুয়ারি কমিউনিস্ট চীন তার বজ্রকঠোর প্রশাসনিক পদক্ষেপে গোটা উহানকে যদি দেশের বাকি অংশ থেকে আলাদ করে না দিত, তাহলে এতদিনে পরিস্থিতি সে-দেশের পক্ষে আরও ভয়ঙ্কর হতো। চীন কিছুটা সামলে নিলেও ইউরোপের অবস্থা কিন্তু ক্রমেই খারাপ হচ্ছে। ইতালি ও স্পেন দুটি দেশের অবস্থা এক কথায় ভয়ঙ্কর। সেখানে এই রোগটি স্টেজ-৩ ছাড়িয়ে গিয়েছে। অর্থাৎ শুধু বিদেশিদের কাছ থেকেই তা ছড়াচ্ছে না, গোটা কমিউনিটি বা সম্প্রদায়ই আক্রান্ত হচ্ছে। কিছু বিশেষজ্ঞ আবার বলছেন, এই জৈবযুদ্ধ নাকি আসলে চীন ও আমেরিকার বাণিজ্যিক লড়াইয়ের ফল। ভুললে চলবে না, চীন কিন্তু এখন আর সোশ্যালিস্ট দেশ নয়। আমেরিকার মতোই বেনিয়া। আমেরিকাতেও এই মারণ ভাইরাস ভালোরকমই থাবা বসিয়েছে। শতাধিক মানুষ মারা গিয়েছে সেখানে। আক্রান্তও কয়েক হাজার নরনারী। প্রথমটায় নাকি ট্রাম্প প্রশাসন তেমন আমলই দেয়নি। ফলে পরিস্থিতি দ্রুত খারাপ হয়। দেরিতে হলেও এখন আক্কেল গুড়ুম হয়ে গিয়েছে বিশ্বের সর্বাপেক্ষা ক্ষমতাধর দেশটির।
আমাদের দেশের অবস্থা কিন্তু চীন বা ইউরোপের মতো শোচনীয় না-হলেও যথেষ্ট উদ্বেগজনক। কারণ, এখনও পর্যন্ত এদেশে বাইরে থেকে আসা লোকেরাই মূলত আক্রান্ত বা কেরিয়ার হলেও ভারত ঘনবসতিপূর্ণ দেশ হওয়ায় ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কটা সবসময়ই বেশি। তার উপর এখানে ৯০ থেকে ৯৫ শতাংশ মানুষই অত্যন্ত গরিব। তাদের পক্ষে ভিড় এড়িয়ে কয়েক মিটার দূরত্ব বজায় রেখে দৈনন্দিন কাজকর্ম ও চলাফেরা করা মোটেই সম্ভব নয়। যে-কোনও দিন শিয়ালদহ বা হাওড়া স্টেশন ঘুরলেই দেখা যাবে কাতারে কাতারে মানুষ বাদুড়ঝোলা হয়ে এ-শহর থেকে ও-শহরে যাওয়া-আসা করছে। তাই তাদেরকে যথেষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে মারণ করোনার মোকাবিলা করতে বলা একেবারেই অবান্তর প্রস্তাব।
প্রযুক্তির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে কত রকম সরঞ্জাম বেরিয়ে গিয়েছে তার কোনও ইয়ত্তা নেই। অথচ, যেই আমাদের জীবনদীপকে নেভাতে করোনা নামক ভাইরাসটি উদ্যত, সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়ে গিয়েছে কৃত্রিম আকাল। সামান্য মাস্ক আর হাত জীবাণুমুক্ত রাখার স্যানিটাইজার নিয়েও কালোবাজারি ব্যবসা চলছে। অথচ, একমাস আগেও অর্থাৎ ২৪ ফেব্রুয়ারি পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমতবান মানুষ প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন ভারত সফরে এসেছিলেন তখনও আমাদের দেশ কিন্তু এত ঐক্যবদ্ধ ছিল না। রাজধানী দিল্লির অভিজাত এলাকাতেই ধর্মের নামে, সম্প্রদায়ের নামে মানুষ একে অপরের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। রক্তাক্ত হয়েছিল দিল্লির রাজপথ। এমনকী, অফিস ফেরতা ভারতীয় গোয়েন্দা ব্যুরোর তরুণ কর্মী অঙ্কিত শর্মাকেও রেহাই দেয়নি ধর্মোন্মাদ জল্লাদেরা। একের পর এক ছুরির ঘায়ে তাঁকে মৃত্যুমুখে ঠেলে দিয়ে পথের পাশে নালায় ফেলে দেওয়া হয়েছিল। আর ওই ঘটনার ঠিক একমাস পরে আজকের অবস্থাটা কী রকম? ভেদাভেদের, বিভাজনের, সম্প্রদায়ে সম্প্রদায়ে রং বাছাবাছির কোনও সুযোগ নেই কারও কাছে। গত দু’সপ্তাহে এই উপগ্রহের সবচেয়ে বুদ্ধিমান প্রজাতিটির এই উপলব্ধিই হয়েছে যে আমরা সবাই এক। একটা আপাত নিরীহ ভাইরাস ধনী নির্ধন হিন্দু মুসলমান ক্রিশ্চান বৌদ্ধ যাবতীয় আকচা-আকচিকে দূরে সরিয়ে গোটা মানবজাতিকে এক সুতোয় গেঁথে দিয়েছে। যুদ্ধ, বিশেষত বিশ্বযুদ্ধ সবাইকে এক সমতলে এনে দাঁড় করায়। এটাই সবচেয়ে বড় শিক্ষা। করোনা ভাইরাসও এই ২০২০-তে কম্পিউটার ও প্রযুক্তি-ওস্তাদ মানবজাতিকে এক পংক্তিতে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। এ বড় কম শিক্ষা নয়।
যে ধর্মস্থান নিয়ে আমরা ক্রমাগত আস্ফালন করি, আজ সেগুলি সবই বন্ধ। মক্কা মদিনা শুনশান! ভ্যাটিকানে ভক্ত বাড়ন্ত। বেলুড় দক্ষিণেশ্বর তারাপীঠেও ভক্তের সমাগম প্রায় নেই। অতন্দ্রপ্রহরীর মতো জেগে আছে শুধু হাসপাতালগুলি। ঘুমিয়ে পড়েছে ধর্ম, জেগে আছে শুধু হাসপাতাল আর বিজ্ঞান। মনুষ্যত্বের জয় হোক। ভাইরাসকে হারিয়ে মানবজাতির জয় ঘোষিত হোক। এই প্রত্যয় নিয়েই শুধু একটি কথা বলে যাই, গুজবে কান দেবেন
না, গুজব ছড়াবেন না, এই কঠিন মুহূর্তে আমরা সকলেই যেন দায়িত্বশীল নাগরিকের মতোই আচরণে অভ্যস্ত হয়ে উঠি।