খরচের চাপ এত বেশি থাকবে সে সঞ্চয় তেমন একটা হবে না। কর্মক্ষেত্রে নানান সমস্যা দেখা ... বিশদ
এই কেনাবেচার খেলায় মহারাষ্ট্র রাজ্যটাকে এখনও তেমনভাবে অবশ্য কব্জা করতে পারেননি মো-শা জুটি। তবে কোনওদিন পারবেন না, এটা ভাবা ভুল। টোপ মারার প্রক্রিয়া অবিরত চলছে। আমরা জানি, বীরেরা কখনো দমে যান না। স্কটল্যান্ডের রাজা রবার্ট ব্রুসের মতো চেষ্টার পর চেষ্টা করে যাওয়ার অন্য নামই তো হল বীরত্ব! সুতরাং কেউ যদি ভাবেন, বীরত্ব আধ ছটাক কম পড়ল, তাহলে তিনি নিতান্তই আহাম্মক। কয়েকদিন আগেই মহারাষ্ট্র বিধানসভায় দাঁড়িয়ে বিজেপির প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী তথা বর্তমান বিধায়ক সুধীর মুঙ্গানিতোয়ার বলেছেন, একদিন না একদিন মহারাষ্ট্রের মাটিতেও জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়ার মতো নেতার সন্ধান আমরা পাব। সেদিন বিজেপি-শিবসেনা আবার ভাই ভাই হয়ে উঠবে। সেই সঙ্গে অবশ্য তিনি এটাও স্বীকার করে নিয়েছেন যে, বিজেপি শিবসেনার সঙ্গে প্রতারণা করেছে। একেই বুঝি বলে বীরত্ব।
সেই বীরত্বেরই সাম্প্রতিকতম নিদর্শন হল মধ্যপ্রদেশ। আবার অন্যের ঘর ভেঙে সরকার গড়ার খেলা শুরু হয়েছে সেখানে। সেই একই চিত্রনাট্য। বিরোধী দলের বিধায়কদের তুলে নিয়ে গিয়ে দামি রিসর্টে রেখে রফা পর্ব চলা। দরদাম ঠিক করা। ঘোড়া কেনাবেচা কাজ, ভোটে হারি নাহি লাজ। জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়াকে তুলে নিয়ে একটা বড় দাঁও মেরেছে বিজেপি। কত বড় দাঁও, সেটা অবশ্য ভবিষ্যতেই বোঝা যাবে। সত্যিই কি জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়া কংগ্রেসের একটা বড় শক্তিকে ভেঙে নিয়ে বেরিয়ে আসতে পারবেন? সবটাই নির্ভর করছে দরদামের উপর।
কিন্তু জ্যোতিরাদিত্যর বিজেপি শিবিরে তড়িঘড়ি লাফিয়ে পড়ার পিছনে ঘুরছে অন্য একটি কাহিনিও। সেটি হল ইয়েস ব্যাঙ্কের প্রতিষ্ঠাতা রানা কাপুরের সঙ্গে জ্যোতিরাদিত্যর যোগাযোগ। মুম্বইয়ের বিখ্যাত আকাশচুম্বী ভবন ‘সমুদ্র মহল’। এখানকার ফ্ল্যাটের দাম পঞ্চাশ কোটি টাকার ওপর। এখানে বিখ্যাত সব মানুষের বাস। এক সময় এখানকার ফ্লাটে থাকতেন নীরব মোদি এবং বিজয় মালিয়া। থাকেন ইনফোসিসের নন্দন নিলেকানি, বেদান্ত গ্রুপের প্রতীক আগরওয়াল সহ সমাজের বড় বড় ব্যক্তিত্ব। এখানেই আগে ছিল গোয়ালিয়রের রাজাদের নিজস্ব প্রাসাদ। সেটি ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে তৈরি করেছিলেন মাধবরাও সিন্ধিয়ার দাদু। একসময় এখানেই বছরের অনেকটা সময় কাটাতেন সিন্ধিয়া পরিবারের সদস্যরা। এই প্রাসাদেই বিজয়রাজের সিন্ধিয়ার কোল আলো করে জন্ম নিয়েছিলেন মাধবরাও সিন্ধিয়া। পরবর্তীকালে সেটি বিক্রি করে দেওয়া হয়। সেটি ভেঙে সেখানে বেশ কয়েকটি হাইরাইজ বিল্ডিং তৈরি হয়। এখানে জ্যোতিরাদিত্যর দুটি ফ্ল্যাট আছে। তার মধ্যে একটি ডুপ্লেক্স। সেটিতে ভাড়া থাকতেন ইয়েস ব্যাঙ্কের রানা কাপুর। ইডির পক্ষ থেকে এই ফ্ল্যাটটিতে রেইড করা হয়। তারপরেই গ্রেপ্তার করা হয় রানা কাপুরকে। রানা গ্রেপ্তার হওয়ার একদিন পরই হঠাৎ করে বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়া বিজেপিতে যোগ দেন। বিরাট একটা রহস্য কিন্তু পুরো গল্পটার মধ্যেই লুকিয়ে আছে। রানার গ্রেপ্তারের পরই হঠাৎ পটভূমিকার বদল হয়েছে। সেই রহস্য খুঁজে আনতে গেলে আজ আর একবার ডাকতে হবে ব্যোমকেশ বক্সিকে।
মধ্যপ্রদেশ সরকার ফেলে দিয়ে সেখানে বিজেপি সরকার গঠন করতে পারবে কিনা, এটা একটা প্রশ্ন। সেটা রাজনৈতিক সক্ষমতার প্রশ্ন। কিন্তু তারপরেও একটা পাল্টা প্রশ্ন থেকে যায়, সেটা আদর্শগত নৈতিকতার প্রশ্ন। জনগণের দ্বারা নির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতার স্বার্থে ভেঙে দিয়ে নিজেরা সরকার গঠন করে বিজেপি কার্যত জনগণেশের ম্যান্ডেটটাকেই অপমানিত করছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে বারবার প্রশ্ন উঠছে, কেন্দ্রে ক্ষমতায় থাকার জোরে, অর্থের জোরে এভাবে সরকার ভেঙে দিলে, ভোটের দরকার কি সত্যিই আর থাকে? গণতন্ত্রের মর্যাদা কি আর থাকে? মানুষের কাছে রাজনীতিকদের শ্রদ্ধা পাওয়ার মতো কিছু কি আর থাকে? মুখে বারবার নৈতিকতার কথা বলাটা তখন মিথ্যা প্রহসনের মতো শোনায়। সম্ভ্রম বলে আর কিছু থাকে না। সম্ভ্রমকে জুতোর সুখতলা বানিয়ে ক্ষমতার দিকে এগিয়ে যাওয়ার নামই কি
তবে রাজনীতি? অসহায় মানুষ তাঁর গণতান্ত্রিক অধিকারের অমর্যাদা দেখে আজ এই কথাই ভাবছেন!
এখানেই শেষ নয়, আরও আছে বাকি! এর মধ্যেই বিশ্বজুড়ে মহামারীর মতো ছড়িয়ে পড়েছে এক নতুন রোগ, করোনা। এই মারণ ভাইরাস যেভাবে ছড়িয়ে পড়ছে, তাতে অনায়সেই একে বলা যেতে পারে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ। বায়োলজিক্যাল ওয়্যারফেয়ার। আমরা জানি না, কে বা কারা এই জৈব অস্ত্র তৈরি করেছেন! কাদের বিরুদ্ধেই বা ব্যবহারের পরিকল্পনা ছিল! কিন্তু আমরা জানি ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের গল্প। ১০২ বছর আগে লেখা মেরি শেলির সেই ভয়ঙ্কর উপন্যাস আজ যেন অন্যরূপে মানবসমাজে অভিশাপ হয়ে নেমে এসেছে। মানুষই আজ মানুষের একমাত্র শত্রু। এখনই বড় প্রতিরোধ গড়ে তুলতে না পারলে বড় ক্ষতি হয়ে যাবে। শুধু গোমূত্র দিয়ে যাঁরা একে ঠেকানোর পরিকল্পনা করছেন, তাঁরা মানবিকতার বড় শত্রু। তাই যদি হতো, তবে মোদিজি তাঁর বিদেশ সফর বাতিল করতেন না। এক বোতল গোমূত্র নিয়েই তিনি বিদেশ সফরে বেরিয়ে পড়তেন। সুতরাং এইসব অবৈজ্ঞানিক এবং অস্বাস্থ্যকর প্রয়াস বন্ধ করতে অবিলম্বে উদ্যোগ নিক মোদি সরকার।
এই সবের ফাঁকেই চলছে ব্যাঙ্কের পতন। মুম্বইয়ের পিএমসি ব্যাঙ্কের হাল আমরা দেখেছি। ভেঙে পড়েছে। পিএমসির পর ইয়েস ব্যাঙ্ক। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠেছে, এরপর কোন ব্যাঙ্ক? তালিকায় আছে অনেকগুলি ব্যাঙ্ক। ধীরে ধীরে আরও কয়েকটি ব্যাঙ্কই অচিরে ভেঙে পড়তে পারে। মানুষ তাহলে টাকা রাখবেন কোথায়? ব্যাঙ্ক তাহলে তাঁকে কতটুকু গ্যারান্টি দিতে পারে? সরকারকে এই পরিস্থিতিতে অসহায় দেখাচ্ছে। দিল্লির অশান্তির সময় যেমন সরকার লুকিয়ে পড়েছিল, এখনও চুপ করে পরিস্থিতির দিকে নজর রাখছে আর রামনাম জপছে। রামনামে উদ্ধার পাওয়া যে যায় না, তা আমরা জানি। কিন্তু রাজনীতি সেটা জানে না। এই অসহায়তার মধ্যে আর যাই দেখি সরকারকে খুব একটা সাহসী দেখাচ্ছে না। এনআরসি, সিএএ, শাহিনবাগ নিয়ে দিল্লির সংঘর্ষ, ব্যাঙ্কিং সিস্টেমের একটু একটু করে ভেঙে পড়া, অর্থনীতির ক্রমেই ঘুমিয়ে পড়া, এই সবকটা দুর্বিপাক একের পর এক আমাদের জীবনকে বিপর্যস্ত করে তুলছে। এর পিছনে বারবার সরকারের ব্যর্থতাই উঠে এসেছে।
এখানেই আমার মনে হল ’‘মেঘনাদ বধ কাব্যে’র সঙ্গে একটা প্রাসঙ্গিক তুলনা। যুদ্ধের সময় যেমনভাবে রাবণের কাছে একের পর এক খারাপ সংবাদ পৌছে দিতেন ভগ্নদূত। আজ প্রতিদিন যেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির কাছে কোনও এক ভগ্নদূত একের পর এক খারাপ খবর পৌঁছে দিচ্ছেন। পরের পর খারাপ খবর, ব্যর্থতার খবর, রাজকার্যে পরাজয়ের খবর। আর তিনি যেন নীরবে নিজের মনেই বলে চলেছেন, ‘একে একে শুখাইছে ফুল এবে, নিবিছে দেউটি’। এই প্রলাপ-বিলাপ অবশ্য কতটা সত্য আমরা সঠিকভাবে জানি না।
কবিচন্দ্রের রামায়ণে বলা হয়েছে, ‘রাজার পাপে রাজ্য নষ্ট, প্রজা কষ্ট পায়’ এবং ‘তোর পাপে মজিল রাজা লঙ্কার বসতি’। এই রকম পংক্তি অবশ্য মাইকেলের লেখাতেও আছে। মন্দোদরি সমস্ত পরিস্থিতির জন্য রাবণকে অভিযুক্ত করে বলছেন, ‘হায় নাথ, নিজ কর্ম-ফলে, মজালে রাক্ষসকুলে, মজিলা আপনি।’ পাপপুণ্যের বিচার অবশ্য এক একজনের কাছে এক একরকম। বিজেপি খুব ধার্মিক দল, শাস্ত্র মানে, পুরাণ মানে, গীতা, রামায়ণ, মহাভারত মানে। এতে অবশ্যই অন্যায়ের কিছু নেই। কিন্তু রাজার পাপে রাজ্যের এবং প্রজার ক্ষতি হয়, এই আপ্তবাক্যটি তারা কি মানে? নাকি, শুধু নিজেদের সুবিধাটুকু বা স্বার্থরক্ষার অংশটুকু মানে। স্বীকার না করলেও হয়তো মানে। কেননা তারা তো দেখছে, একটা একটা করে ফুল শুকিয়ে যাচ্ছে। নিভে যাচ্ছে প্রত্যাশার দীপ।