খরচের চাপ এত বেশি থাকবে সে সঞ্চয় তেমন একটা হবে না। কর্মক্ষেত্রে নানান সমস্যা দেখা ... বিশদ
স্বাধীন ভারতে অর্থনৈতিক পরিকল্পনা গ্রহণের সময় থেকে ১৯৫১ থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত ভারতে কেন্দ্র ও রাজ্যের সমস্ত সরকারই কার্যত ব্যাপক রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ ও নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে বিদেশি শিল্পের প্রতিযোগিতা থেকে দেশীয় শিল্পকে বাঁচানোর জন্য সংরক্ষণমূলক নীতি ও লাইসেন্স প্রথা কার্যকর করেছিল। মূলত এই কারণেই ১৯৫১-৯১ পর্যন্ত ৪০ বছরের সময়কালে দেশে প্রকৃত বার্ষিক আর্থিক সমৃদ্ধির হার (জিডিপি) গড়ে ৪ শতাংশের কম ছিল। ভারতে আর্থিক সমৃদ্ধির হার উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে আর্থিক উদারীকরণোত্তর সময়কালে। ১৯৯২-৯৩ থেকে ১৯৯৯-২০০০ সময়কালে গড়ে বার্ষিক প্রায় ৬.৫ শতাংশ হারে প্রকৃত আর্থিক সমৃদ্ধি বৃদ্ধি পায়। দশম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার সময়কালে (২০০২-০৭) গড়ে বছরে প্রায় ৭.৬ শতাংশ ছিল প্রকৃত আর্থিক সমৃদ্ধির হার। একাদশ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় (২০০৭-০৮ থেকে ২০১১-১২) এটি ছিল বার্ষিক গড়ে ৭.৫ শতাংশ। ২০১৩ ও ২০১৪ আর্থিক বছরে প্রকৃত জিডিপি সমৃদ্ধির হার যথাক্রমে ৫.৫ শতাংশ ও ৬.৮ শতাংশ।
পরবর্তীকালে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সময়কালে বিমুদ্রাকরণের সময় পর্যন্ত প্রথম তিনটি আর্থিক বছরে দেশের প্রকৃত জিডিপি সমৃদ্ধির হার উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়ে। ২০১৫, ২০১৬ ও ২০১৭ আর্থিক বছরে দেশের জিডিপি সমৃদ্ধির হার দাঁড়ায় যথাক্রমে ৭.৪ শতাংশ, ৮ শতাংশ, ৮.২ শতাংশ। কিন্তু বিমুদ্রাকরণ পরবর্তী সময়ে দেশের জিডিপি সমৃদ্ধির হার যথেষ্ট কমেছে। ২০১৮ ও ২০১৯ অর্থ বছরে দেশের প্রকৃত জিডিপি সমৃদ্ধির হার যথাক্রমে ৭.২ শতাংশ ও ৬.৮ শতাংশ। কিন্তু বর্তমান অর্থ বছরে (২০২০) প্রকৃত জিডিপি সমৃদ্ধির হার আরও কমে ৫ শতাংশ দাঁড়াবে বলে দাবি করেছে ভারতের রিজার্ভ ব্যাঙ্ক থেকে শুরু করে ভারতের আর্থিক সমীক্ষা, এমনকী বিশ্ব-ব্যাঙ্ক ও আইএসএফ-এর মতো আন্তর্জাতিক সংস্থা। মোদ্দা কথা, ২০১৯ সালে বিশ্বে সমস্ত দেশের মধ্যে মোট আর্থিক (নমিনাল) জিডিপি’র নিরিখে ভারতের সপ্তম থেকে পঞ্চম স্থানে উঠে আসার পশ্চাতে মুখ্য নির্ণায়ক ভূমিকায় কাজ করেছে ১৯৯১ সালের আর্থিক উদারীকরণ নীতি ও তার বাস্তবায়ন। স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন আসবে, উদারীকরণ পরবর্তী সময়ে ভারতের সমস্ত কেন্দ্রীয় সরকার কি দেশের জিডিপি সমৃদ্ধির ঊর্ধ্বমুখী গতিকে সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়ন করতে পেরেছে?
নরসিমা রাওয়ের প্রধানমন্ত্রিত্বের সময়কালে (১৯৯১-৯৬) দেশের প্রকৃত জিডিপি সমৃদ্ধির হার গড়ে বার্ষিক ৬.৫ শতাংশ ছিল। অথচ ১৯৫১-৯১ পর্যন্ত দেশের জিডিপি সমৃদ্ধির হার গড়ে বার্ষিক ৪ শতাংশের কম ছিল। নিঃসন্দেহে নরসিমা রাওয়ের সময়কালে ভারতে যে আর্থিক উদারীকরণের দরজা খুলে দেওয়া হয়েছিল তার সুষ্ঠু বাস্তুবায়নের ফলে দেশে প্রকৃত আর্থিক সমৃদ্ধির হার উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছিল। এর পরবর্তী সময়ে কেন্দ্রে অস্থায়ী সরকারের আমলে দেশের জিডিপি সমৃদ্ধির হার বেশ কিছুটা কমেছিল। পরবর্তীতে ১৯৯৯-২০০৪ সময়কালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ির আমলে দেশের প্রকৃত জিডিপি সমৃদ্ধির হার গড়ে বার্ষিক ৬ শতাংশের বেশি বৃদ্ধি পায়।
ইউপিএ আমলে (১ এবং ২) মনমোহন সিং-এর প্রধানমন্ত্রিত্বের সময় (২০০৪-০৫ থেকে ২০১৩-১৪) ভারতের প্রকৃত জিডিপি সমৃদ্ধির হার গড়ে বার্ষিক ৭.৭ শতাংশ ছিল। কিন্তু ২০০৭-০৮ থেকে শুরু হওয়া সারা বিশ্বে বিরাট আর্থিক মন্দার প্রভাব ভারতে বিশেষ প্রভাব বিস্তার করেনি। ইউপিএ আমলে সারা বিশ্বে আর্থিক মন্দার প্রভাবে শুধুমাত্র ২০০৮-০৯ অর্থ বছরে ভারতের প্রকৃত জিডিপি সমৃদ্ধির হার ৩.০৯ শতাংশে নেমে এসেছিল। কিন্তু তৎকালীন সময়ে ভারতের অর্থনৈতিক কাঠামো (বিশেষ করে সঞ্চয় ও বিনিয়োগ) যথেষ্ট শক্তিশালী হওয়ায় ঠিক পরবর্তী আর্থিক বছরে (২০০৯-১০) ভারতের প্রকৃত জিডিপি সমৃদ্ধির হার আবার বেড়ে দাঁড়ায় ৭.৮৬ শতাংশ। ইউপিএ আমলের শেষ দিকে দুটি অর্থ বছরে (২০১২ ও ২০১৩) ভারতের প্রকৃত জিডিপি সমৃদ্ধির হার বেশ কিছুটা কমলেও তা ৫ শতাংশের বেশি ছিল। মনমোহন সিং সরকারের প্রধানমন্ত্রিত্বের ১০ বছর সময়কালে ২০০৯, ২০১২ ও ২০১৩ অর্থ বছর ব্যতিরেকে অন্যান্য প্রতিটি অর্থবর্ষে ভারতের প্রকৃত জিডিপি সমৃদ্ধির হার প্রায় ৭ শতাংশ থেকে ৮.৫ শতাংশের মধ্যে ছিল। ভারতের অর্থনৈতিক কাঠামো যথেষ্ট শক্তিশালী থাকার দরুন ইউপিএ আমলের ১০ বছরে দেশের প্রকৃত জিডিপি সমৃদ্ধি গড়ে বার্ষিক ৭.৭ শতাংশ হারে বেড়েছিল।
অর্থনৈতিক উদারীকরণ পরবর্তী সময়ে মোদি সরকারের আমলে ভারতে প্রকৃত জিডিপি বৃদ্ধির গতিশীলতা বজায় রয়েছে কি? বিমুদ্রাকরণের সময় পর্যন্ত প্রথম তিনটি আর্থিক বছরে নিঃসন্দেহে দেশে জিডিপি সমৃদ্ধির ঊর্ধ্বগামী গতিশীলতা বজায় ছিল। কিন্তু বিমুদ্রাকরণ পরবর্তী সময়ে ভারতে প্রকৃত জিডিপি বৃদ্ধির গতিশীলতা ক্রমশ উল্লেখযোগ্যভাবে নিম্নগামী। বিমুদ্রাকরণের অর্থবর্ষে (২০১৭) যেখানে দেশের প্রকৃত জিডিপি সমৃদ্ধির হার ছিল ৮.২ শতাংশ, ২০১৮ অর্থবর্ষে এটি ২০১৭-এর তুলনায় ১ শতাংশ কমেছে। ২০১৯ অর্থবর্ষে ২০১৭-এর তুলনায় ১.৪ শতাংশ কমেছে। বর্তমান অর্থবর্ষে ২০১৭-র তুলনায় ৩ শতাংশেরও বেশি কমতে চলেছে। বর্তমান অর্থবর্ষে অর্থনীতির বিবর্ণ ছবি আরও দুর্বিষহ। জিডিপি সমৃদ্ধি ১১ বছরে সর্বনিম্ন। বেকারত্ব ৪৭ বছরে সর্বনিম্ন। মুদ্রাস্ফীতি ৫ বছরে সর্বাধিক। শিল্পে সমৃদ্ধি ৮ বছরে সর্বনিম্ন। পরিকাঠামো শিল্পে বৃদ্ধির হার ১৪ বছরে সর্বনিম্ন। বিদ্যুতের চাহিদা ১২ বছরে সর্বনিম্ন। বেসরকারি লগ্নি ১৭ বছরে সর্বনিম্ন। দেশে ব্যাঙ্ক লগ্নি বৃদ্ধির হার গত ৫৮ বছরে সর্বনিম্ন। মোদির আমলে বর্তমানে অর্থনীতির ৪টি ইঞ্জিন যথেষ্ট বিবর্ণ। চাহিদা কমেছে, লগ্নি কমেছে। রপ্তানি কমেছে এবং রাজস্ব আয় যথেষ্ট হ্রাসের ফলে সরকারি ব্যয় বৃদ্ধি মাত্র ৭ মাসেই রাজকোষ ঘাটতির লক্ষ্যমাত্রাকে অতিক্রম করে গিয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, ভারতে অর্থনীতির শ্লথ গতির জন্য আন্তর্জাতিক মন্দাই দায়ী। বিশ্বের সমস্ত দেশে, এমনকী চীনেরও জিডিপি বৃদ্ধির হার নিম্নগামী। প্রশ্ন হল, বিশ্বমন্দার প্রভাব তো ইউপিএ আমলেও ঘটেছিল ২০০৭-০৮ পরবর্তী সময়ে। কিন্তু সেই প্রভাব ভারতে বিশেষ মন্দা বিস্তার করতে পারেনি। কারণ সে সময়ে ভারতের অর্থনৈতিক কাঠামো (বিশেষ করে সঞ্চয় ও বিনিয়োগ) যথেষ্ট শক্তিশালী থাকায় বিশ্বমন্দার প্রভাব ভারতে বিশেষ প্রভাব বিস্তার করেনি। দাম্ভিক বিমুদ্রাকরণই ভারতের বর্তমান দুরবস্থার জন্য প্রকৃতপক্ষে দায়ী। ত্রুটিপূর্ণ জিএসটিও ভারতের অর্থনৈতিক দুর্দশা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। এমনকী আন্তর্জাতিক সংস্থাও ভারতের বর্তমান অর্থনৈতিক শ্লথগতির জন্য অনেকাংশে দায়ী করেছে অভ্যন্তরীণ কারণগুলোকেই। গত ১৯ ফেব্রুয়ারি স্বনামধন্য আন্তর্জাতিক মূল্যায়ন সংস্থা মুডিজ ইনভেস্টমেন্ট সার্ভিস জানিয়েছে ‘ভারতের অর্থনীতির বৃদ্ধি শ্লথ হয়েছে মূলত অভ্যন্তরীণ কারণে।’
মোদির আমলে গত কয়েক বছরে অর্থনীতির ক্রমাগত শ্লথগতি সত্ত্বেও বিশেষ করে ১৯৯০-এর দশকে অর্থনৈতিক উদারীকরণ নীতি বাস্তবায়নের ফলে ভারত ধারাবাহিকভাবে নিজস্ব আর্থিক সমৃদ্ধির উন্নতি ঘটিয়ে ২০১৯ সালে ব্রিটেন ও ফ্রান্সকে পিছনে ফেলে পৃথিবীর মধ্যে সপ্তম থেকে পঞ্চম অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী দেশ হিসেবে উঠে এসেছে। প্রত্যেক ভারতবাসী এ জন্য গর্বিত।