খরচের চাপ এত বেশি থাকবে সে সঞ্চয় তেমন একটা হবে না। কর্মক্ষেত্রে নানান সমস্যা দেখা ... বিশদ
চিকিৎসা বিজ্ঞানে বিশ্বে এগিয়ে থাকা এবং অত্যন্ত কম জনসংখ্যার দেশ হওয়া সত্ত্বেও ইতালি, আমেরিকা, জাপান, ফ্রান্স, জার্মানি এবং ইংল্যান্ড করোনা ভাইরাস মোকাবিলায় নাকানিচোবানি খেয়েছে। তার অন্যতম প্রধান কারণ করোনাকে ছোট করে দেখা এবং অবশ্যই তাদের জীবনযাত্রা। হু হু করে বেড়েছে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা। ওই সমস্ত দেশ এই মুহূর্তে করোনা আক্রমণের স্টেজ থ্রি ও ফোর দশায় অবস্থান করছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রথম থেকে প্রতিরোধ গড়ে তুললে জাপান, আমেরিকা ও ইউরোপের দেশগুলিকে এই খেসারত হয়তো দিতে হতো না।
ভারতে এই আক্রমণ কিছুটা পরে শুরু হওয়ায় আমাদের সামনে একটা সুযোগ রয়েছে। প্রতিরোধ গড়ে তোলার সুযোগ। এই মুহূর্তে ভারতে করোনা স্টেজ টু পর্বে রয়েছে। এখনও ‘কমিউনিটি ট্রান্সমিশন’ শুরু হয়নি। এখনও পর্যন্ত যাঁরা এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন বা আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কায় আইসোলেশনে রয়েছেন তাঁদের প্রায় প্রত্যেকেরই সুনির্দিষ্ট ইতিহাস রয়েছে। অর্থাৎ তাঁরা হয় বিদেশে আক্রান্ত হয়ে এদেশে এসেছেন অথবা আক্রান্তদের সঙ্গে সরাসরি সংস্পর্শে এসেছেন। কিন্তু, তৃতীয় স্টেজটাই ভয়ঙ্কর। মানুষ নিজের অজান্তেই এই ভাইরাসের শিকার হবেন এবং অন্যকেও বিপদের মুখে ঠেলে দেবেন। তাই সতর্ক না হলে দেশজুড়ে নেমে আসবে ভয়াবহ বিপর্যয়।
এমনই এক সঙ্কটের মুখে গোটা দেশকে করোনার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়ে লড়াইয়ের ডাক দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও এরাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সমস্ত ভেদাভেদ ভুলে দল, মত, ধর্ম নির্বিশেষে সকলকে এই সঙ্কট মোকাবিলায় শামিল হতে বলেছেন। প্রধানমন্ত্রী আগামী ২২ মার্চ, রবিবার সকাল ৭টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত প্রত্যেককে স্বেচ্ছায় ঘরে বন্দি রাখার ডাক দিয়েছেন। অনেকেই বলছেন, প্রধানমন্ত্রীর এই ডাক আসলে আসন্ন জটিল পরিস্থিতি মোকাবিলার একটা ‘ট্রায়াল ভার্সান’। মারণ ভাইরাস করোনার বিরুদ্ধে গোটা দেশকে ঐক্যবদ্ধ করার ডাক। মানুষকে সচেতন করার ডাক। বিপদকে হাল্কা করে না দেখার ডাক।
এ লড়াই এক অন্য ধরনের লড়াই। এতদিন সমস্ত লড়াই আমরা লড়েছি রাস্তায় নেমে, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে। সলিল চৌধুরীর সুরে সুর মিলিয়ে গেয়েছি, ‘পথে এবার নামো সাথী পথেই হবে পথচেনা।’ পথে নেমেই আমরা লড়াইয়ের সঙ্গীকে চিনেছি। কিন্তু, এবার সম্পূর্ণ ভিন্ন লড়াই। বলতে গেলে উলোটপুরাণ। পথকে পরিহার করে নিজেদের গৃহবন্দি করার লড়াই। বিচ্ছিন্ন করে রাখার লড়াই। রাস্তা, সমাজ, ক্লাব, অফিস, কোর্টকাছারি, সব কিছু থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলতে পারলেই আসবে কাঙ্খিত জয়। তাই আগামী দু’ তিনটি সপ্তাহ যে কোনও মূল্যে সমস্ত কিছু থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে আটকে রাখতে হবে চার দেওয়ালের মধ্যে।
সুনাগরিক হতে গেলে দরকার সচেতনতা। প্রতিটি বাঙালি, প্রতিটি গুজরাতি, প্রতিটি মারাঠি, প্রতিটি পাঞ্জাবি অর্থাৎ সকলের সামনে আজ সুনাগরিক হিসেবে নিজেদের প্রমাণ দেওয়ার পরীক্ষা। সেই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে গেলে আমাদের দিতে হবে সচেতনতার প্রমাণ। অত্যন্ত জরুরি প্রয়োজন ছাড়া বাইরে বের হওয়া যাবে না। যত কষ্টই হোক এই ক’টা দিন ঘরের কাজ নিজেদেরই সামলে নিতে হবে। চিকিৎসকদের পরামর্শ মতো প্রতিটি পর্বে পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখতে হবে। কোনও একটি পর্বকে অস্বীকার করা মানেই বিপদ ডেকে আনা। বিপদ নিজের, বিপদ পরিবারের, বিপদ সমাজের এবং সর্বোপরি দেশের। তাই আমাদের সামনে সুনাগরিক হয়ে ওঠার
যে পরীক্ষা এসেছে, তাতে সকলকে সসম্মানে
উত্তীর্ণ হতেই হবে।
কথায় আছে, কারোও সর্বনাশ তো কারোও পৌষ মাস। সঙ্কটের মুহূর্তে আমজনতার উপর যখন সর্বনাশের ছায়া ক্রমশ গাঢ় হচ্ছে তখনই কালোবাজারির পৌষ মাসের শুরু। একথা বারে বারে প্রমাণিত হয়েছে, মানুষ যখন বিপদে পড়ে কালোবাজারির তখন রমরমা হয়। দেশের এমনই এক সঙ্কটময় মুহূর্তে মুনাফাখোরদের পরিস্থিতির সুযোগ নেওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষায় ছেদ পড়েনি। বরং দিন দিন সে করোনার ছোবলের চেয়েও আরও বিষাক্ত, আরও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে। এতদিন কালোবাজারি চলছিল করোনা মোকাবিলায় অতি প্রয়োজনীয় মাস্ক, হ্যান্ড স্যানিটাইজার, হ্যান্ড ওয়াশ নিয়ে। স্টেজ থ্রিতে পা রাখার সঙ্কটময় মুহূর্তে যখনই গৃহবন্দি করে রাখার পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে তখনই ঊর্ধ্বমুখী হতে শুরু করেছে নিত্যপ্রয়োজনীয় চাল, আলু, ডাল, তেলের দাম। পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে অধিক মুনাফা
লাভের ট্র্যাডিশন সঙ্কটময় মুহূর্তেও বিদ্যমান। লড়াই এর বিরুদ্ধেও।
প্রধানমন্ত্রীর জাতির উদ্দেশে ভাষণের কথা প্রচার হতেই সোশ্যাল মিডিয়া ছেয়ে গেল ‘লক ডাউনে’র বার্তায়। সব কিছু বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা। আতঙ্ক তৈরি করে মানুষকে আরও বেশি করে চাপে ফেলার চেষ্টায় সদাসর্বদা মত্ত একটা শ্রেণী। তবেই না নেওয়া যাবে পরিস্থিতির সুযোগ। সোশ্যাল মিডিয়া যেমন অনেক কিছু ফিরিয়ে দেয়, তেমনই কেড়েও নেয়। সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে বহু মানুষ তাঁদের হারিয়ে যাওয়া আত্মীয়কে ফিরে পেয়েছেন, বিপদ সম্পর্কে সতর্ক হয়েছেন। আবার করোনার সঙ্গে মুরগির মাংসের হরিহর আত্মার অলীক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত করে গ্রামীণ অর্থনীতিকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিয়েছে। গুজব সর্বদাই মানুষকে বিপদের মুখে ঠেলে দেয়। আর সঠিক তথ্য মানুষকে সতর্ক করে, রক্ষা করে। তাই সঙ্কটের মুহূর্তে ভুল তথ্য ফরওয়ার্ড করে অযথা সেনসেশন তৈরির চেষ্টা থেকে বিরত থাকতে হবে। সম্ভব হলে মানুষকে সঠিক তথ্য দিয়ে নিজেকে সুনাগরিক প্রমাণের চেষ্টা করতে হবে।
করোনাকে ঘিরে প্রতিটি মানুষ আজ আতঙ্কিত। তবে অযথা আতঙ্কিত না হয়ে গড়ে তুলতে হবে প্রতিরোধ। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, জ্বর, সর্দি, কাশি হলেই হাসপাতালে ছোটার কোনও প্রয়োজন নেই। তাতে হিতে বিপরীত হতে পারে। হাসপাতালগুলিতে যত ভিড় বাড়বে ভাইরাস ছড়ানোর আশঙ্কা ততই বেশি। কারণ ভিড়ের মধ্যে সত্যিই কেউ করোনায় আক্রান্ত হলে তা থেকে বাকিদের সংক্রমিত হওয়ার আশঙ্কা প্রবল। তাই এই ধরনের উপসর্গ দেখা দিলে বাড়ির মধ্যেই নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখাই শ্রেয়। যাকে চিকিৎসকরা বলছেন, ‘সেল্ফ কোয়ারেন্টাইন’। দিন পাঁচ
সাত পরেও উপসর্গগুলি বৃদ্ধি পেলে হাসপাতালে যাওয়াই বিবেচকের কাজ হবে।
এই মুহূর্তে হাসপাতালগুলিতে রোগীর চাপ মারাত্মক। তাই চিকিৎসার পরিভাষায় যেগুলি ‘কোল্ড কেস’ সেইসব রোগীর এখন হাসপাতাল এড়িয়ে চলাই ভালো। সঙ্কট কাটার পর হাসপাতালে যান। তাতে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের উপর চাপ যেমন কমবে, তেমনি নিজেও সুরক্ষিত থাকবেন। তা না হলে একটা
রোগ সারাতে গিয়ে পড়তে পারেন করোনার
ছোবলের মুখে।
আমাদের দেশে খাদ্যদ্রব্য থেকে শুরু করে সমস্ত ধরনের পণ্য পরিবহণের প্রধান মাধ্যম ট্রাক। এক রাজ্য থেকে অন্য রাজ্যে বেশিরভাগ মালপত্র যায় ট্রাকেই। তাই ট্রাকের চালক, খালাসিদের সতর্ক নজরদারি প্রয়োজন। বিশেষ করে ধাবা ও লাইনের ধারের হোটেলগুলিতে। তাঁদের খাওয়া দাওয়া এবং মেলামেশায় কড়া নজরদারি জরুরি।
যে কোনও সৃষ্টির পিছনে থাকে যন্ত্রণা। একমাত্র কঠিন লড়াই, নিরলস সংগ্রামই পারে সঙ্কটমোচনের রাস্তা দেখাতে। গোটা দেশ, সমগ্র জাতি আজ গভীর সঙ্কটের মুখে দাঁড়িয়ে। সঙ্কটের গভীর অন্ধকারের আড়ালে রয়েছে রুপোলি আলোর হাতছানি। যে কাজটা উন্নত জাপান, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানি করে দেখাতে পারেনি, পারেনি মহাশক্তিধর আমেরিকাও, সেই কাজটাই করে দেখানোর সুযোগ এসেছে ভারতবাসীর সামনে। মাত্র তিনটি সপ্তাহ নিজেদের বিচ্ছিন্ন রেখে তামাম বিশ্বকে দেখিয়ে দিতে হবে, আমরাই পারি। আমাদের সামনে ফের জগৎসভায় ভারতের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের সুযোগ এসেছে। দেশের সুনাগরিক হিসেবে সেই সুযোগ কিছুতেই হাতছাড়া করা চলবে না। সেই লক্ষ্যপূরণের জন্য লড়াই শুরু।