উপার্জন বেশ ভালো হলেও ব্যয়বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে সঞ্চয় তেমন একটা হবে না। শরীর খুব একটা ... বিশদ
আমাদের দেশে জন্মগ্রহণ করিয়া বিচিত্রতার স্বাদের জন্য কবির চিত্তে এমন সুগভীর আকাঙ্ক্ষা কি করিয়া জাগিল, তাহা আমার কাছে বিস্ময়কর। আমাদের দেশের সমাজের জীবন নানা কারণে অত্যন্ত ক্ষুদ্র—কৃত্রিম লোকাচারের বন্ধন তো আছেই—কিন্তু ক্ষুদ্রতার আসল কারণ এদেশে কর্মক্ষেত্রে নিতান্ত সংকীর্ণ—সেইটুকুর মধ্যে মানুষের বিচিত্র শক্তিকে ভালো করিয়া ছাড় দেওয়া যায় না—তাহাতে আমাদের জীবনের লীলা ব্যাঘাত পায় বলিয়া আনন্দের অভাব ঘটে। শুধু তাই নয়। আমাদের হৃদয়ের ভাব বাহিরের ক্ষেত্রে নানারূপে আপনাকে সৃষ্টি করিতে চায়; সেই সৃষ্টি করিতে গিয়াই সে যথার্থ পরিণতি লাভ করে, সে বল পায়, তাহার বাড়াবাড়ি সমস্ত কাটিয়া যায়, সে আপনার ঠিক ওজনটি রক্ষা করিতে শেখে—এক কথায় সে রীতিমত পাকা হইয়া উঠে। কিন্তু যে সমাজে মানুষের চিত্ত বাহিরে আপনাকে প্রকাশ করিবার এমন প্রশস্ত স্থান ও বিচিত্র অধিকার না পায়, সে সমাজে ভাবুকতা আপনার পরিমাণ হারাইয়া ফেলে; হয়, সে অত্যন্ত ক্ষুদ্র হইয়া পঙ্গু হইয়া নিতান্ত গ্রাম্য হইয়া থাকে, নয় সে আপনাকে অসংগতরূপে স্ফীত করিয়া অদ্ভুত প্রমত্ততার মধ্যে ছুটিয়া যায়। যেখানে জীবনের ক্ষেত্র দূরবিস্তৃত সেখানে মানুষের কল্পনা নিয়তই সত্যের সংস্রবে আপনাকে সুবিহিত আকার দান করিতে পারে— যতদূর পর্যন্ত তাহার শক্তির অধিকার ততদূর পর্যন্ত সে ব্যাপ্ত হয় এবং কোন্খানে তাহার সীমা তাহাও আবিষ্কার করিতে তাহার বিলম্ব ঘটে না।
সংগীত, শিল্প, চিত্রকলা, সৌন্দর্য, মানুষের সঙ্গ, ভাবের আলোচনা, শক্তির স্ফূর্তি প্রভৃতি জিনিস বাহির হইতে ক্রমাগত উত্তাপ দিতে থাকিলে আমাদের প্রকৃতি যে শোভায় সৌন্দর্যে একটি আশ্চর্য বিকাশ লাভ করিতে পারে, তাহা আমরা অন্য দেশের অন্য কবিদের জীবনচরিতে দেখিয়াছি। কেবল আমাদেরই দেশে এ সকলের অভাব যে কত বড় অভাব এবং এই সকল প্রাণের উপকরণ হইতে বঞ্চিত হইয়া থাকা যে কত বড় শূন্যতা তাহা আমরা ভালো করিয়া অনুভব করিতেও পারি না।
কিন্তু মানুষের মনুষ্যত্বের আগুনকে চিরকাল ছাই চাপা দিয়া রাখা যায় না। যখনই সে বাহির হইতে খোঁচা পায় তখনই সে শিখা হইয়া জ্বলিয়া উঠিতে চায়। এই তাহার স্বাভাবিক ধর্ম। আমাদের এই বহু দিনের সুপ্তদেশ একদিন সহসা বৃহৎ পৃথিবীর আঘাত পাইয়াছে। যে পশ্চিম-মহাসমুদ্রতীরে মানুষের মন সচেতনভাবে কাজ করিতেছে, চিন্তা করিতেছে ও আনন্দ করিতেছে, সেইখানকার মানসহিল্লোল আমাদের নিস্তব্ধ মনের উপর আসিয়া যখন পৌঁছিল তখন সে কি চঞ্চল না হইয়া থাকিতে পারে? আমাদের মনের এই যে প্রত্যহম উদ্বোধনের চঞ্চলতা ইহা তো নীরব হইয়া থাকিবার নহে। যতদিন সুপ্ত ছিলাম ততদিন আপনার মনের নানা অদ্ভুত স্বপ্ন হইয়া দিব্য রাত কাটিতেছিল, কিন্তু যখন জাগিলাম, যখন শয়ন ঘরের জানালার ফাঁক এঁর মধ্য দিয়া দেখিলাম জীবনের উদার-বিস্তীর্ণ লীলাভূমিতে মানুষ দিকে দিকে আপনার বিচিত্র শক্তিকে আনন্দে পরিকীর্ণ করিয়া দিয়াছে, তখন স্বপ্নের বন্ধন ও পাথরের দেয়ালে আর তো বাঁধা থাকিতে ইচ্ছা হয় না। তখন বিশ্বের ক্ষেত্রে ছুটিয়া বাহির হইয়া পড়িবার জন্য প্রাণ ব্যাকুল হইয়া উঠে।
বিশ্বকে, মানুষের জীবনকে নানা দিক দিয়া উপলব্ধি করিবার এই ব্যকুলতাই কবি রবীন্দ্রনাথের কবিত্বকে উৎসারিত করিয়াছে, ইহাই আমাদের বিশ্বাস। আপনার জীবনের দ্বারা সম্পূর্ণরূপে যে জীবনকে পাওয়া যাইতেছে না অথচ দূর হইতে যাহার পরিচয় পাইতেছি, নিজের অন্তরের ঔৎসুক্যের তীব্র আলোকে তাঁহার দীপ্যমাণ হইয়া দেখা দেয়। কবির ব্যাকুল কল্পনার শতধা-বিচ্ছুরিত নানা বর্ণময় রশ্মিছটায় প্রদীপ্ত জগদ্দৃশ্যই আমরা তাঁহার কাব্যের মধ্যে দেখিতে পাই, একদিক হইতে যে অবস্থাকে প্রতিকূল বলিয়াই মনে করা যাইত, কবিত্বের পক্ষে তাহাও অনুকূল হইয়াছে।