উপার্জন বেশ ভালো হলেও ব্যয়বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে সঞ্চয় তেমন একটা হবে না। শরীর খুব একটা ... বিশদ
শিহোর থেকে কয়েক মাইল দূরে তাঁর ভাগ্নে হৃদয়ের জন্মভিটে ফুলুই শ্যামবাজার। গ্রামবাংলার এক অতি সাধারণ গ্রাম। হৃদয়কে সঙ্গে নিয়ে সেখানে নটবর গোস্বামীর অনুরোধে তাঁদের বেলটে গ্রামের বাড়ীতে শ্রীরামকৃষ্ণ গিয়েছিলেন। শিহোরের লোকেরা গৌর-নিতাইকে উপহাস করতো। গ্রামবাসীরা কীর্ত্তনীয়দের লাঠি বাঁশ নিয়ে তাড়া করতো আর খোল কেড়ে ভেঙে দিত। নটবর গোস্বামীর ব্যবস্থাপনায় গৌরাঙ্গ ভাবে বিভোর হয়ে শিহোরে সংকীর্ত্তনে নামেন শ্রীরামকৃষ্ণ। সংকীর্ত্তন হল ‘আমার গৌরাঙ্গ নাচে ইত্যাদি। ভক্ত নটবর গোস্বামীর অনুরোধে রামজীবনপুরের বিখ্যাত কীর্তনিয়া ধনঞ্জয় দে এলেন। শ্রীরামকৃষ্ণ তুলসী প্রণাম করে তুলসীর মহিমা প্রচার করলেন, যাদের ঘরে নারায়ণশিলা আছে তাদের তুলসীর মালা দিলেন। জনসাধারণের জীবনে ধর্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনলেন। শিহোরের দিগিম্বর ব্যানার্জী দরিদ্র ছিলেন। ঠাকুর তাঁকে তুলসীর মালা দিয়ে বলেছিলেন— “এটি নাও জপ করো, আর প্রত্যহ খোল করতাল নিয়ে হরিনাম করো, তাতে মঙ্গল হবে, কলিযুগে হরিনাম সার। এ করলে ধ্যান-যাগ যজ্ঞের ফল হবে।” শ্রীরামকৃষ্ণের আশীর্বাদে দরিদ্র দিগিম্বর ধনী জমিদার হয়েছিলেন, তবুও নিত্য খোল করতাল নিয়ে হরিনাম করতেন।
কীর্ত্তনানন্দে বিভোর শ্রীরামকৃষ্ণ সেখানে মহাপ্রভুর জন্য চিহ্নিত উচ্চ আসনে গিয়ে সমাধিস্থ হয়ে পড়লেন। গোস্বামী ব্রাহ্মণেরা দেখলেন মালা-তুলসী নেই, চন্দন তিলক নেই, এমনকি উপবীতও নেই অথচ শ্রীরামকৃষ্ণ বসলেন চৈতন্যের আসনে। তর্ক বিতর্ক শুরু হয়ে গেল। শ্রীরামকৃষ্ণ ব্রহ্মজ্ঞানী শুনে গোস্বামীরা পরীক্ষা করতে এসেছিলেন, কিন্তু মালা তিলক নেই দেখে বললেন—“নারকেলের বেল্লো আপনিই খ’সে গেছে।”
গৌরাঙ্গের আসনে বসাতে স্থানীয় বৈষ্ণবেরা ঘোরতর বিবাদ শুরু করলো। শ্রীরামকৃষ্ণ গোস্বামীদের বিবাদ দেখে নটবরকে বললেন, গোস্বামীদের সর্দারকেই নিমন্ত্রণ করে নিয়ে আসতে। সর্দার আসতেই চিরঅভিমানহীন রামকৃষ্ণ, অমানীরও মানদাতা ঠাকুর, তাঁকে সাদর সম্ভাষণ করলেন।
গোস্বামীদের এক নেতার কিঞ্চিৎ বেদান্ত পড়া ছিল। তাই ঠাকুরকে জিজ্ঞেস করলেন বেদান্তে ব্রহ্মকে নিরাকার রূপহীন গুণহীন নিরাকার বলে, তাঁকে নিয়ে আবার কীর্ত্তন কেন? সিংহবিক্রমের মাধুর্য্যে শ্রীরামকৃষ্ণ এইবার প্রতি-আক্রনণ করে বললেন গ্রামের এই সাধারণ, কৃষ্ণগতপ্রাণ গোস্বামী ব্রাহ্মণদের সম্মুখে নিরাকার তত্ত্ব বলার অধিকার তাঁকে কে দিল? ভক্ত গোস্বামীরা ভক্তিস্বরূপ শ্রীগৌরাঙ্গের সাক্ষাৎ উপস্থিতি অনুভব করে শ্রীরামকৃষ্ণপদে লুণ্ঠিত হলেন। এবং ‘মহাত্মার নিন্দা করেছি’—এই অনুতাপে অশ্রুবিসর্জন করলেন। গ্রামে প্রবেশের পূর্বেই শ্রীরামকৃষ্ণ শ্রীচৈতন্যের দর্শন পেয়েছিলেন। শ্রীরামকৃষ্ণের আগমনের সংবাদ পেয়ে নিকটবর্তী গ্রাম থেকে অনেকগুলি সঙ্গীতের দল এলো। তাদের গানে সুর মিলিয়ে তিনিও দিবারাত্র গাইতেন এবং মাঝে মাঝে সমাধিস্থ হয়ে পড়তেন। কীর্ত্তনে শ্রীকৃষ্ণ ও গোপীদের দিব্যদর্শনে বার বার তিনি কৃষ্ণভাবে ভরপুর। তাঁর মনে হতো তাঁর ভাব-মন-তনু শ্রীকৃষ্ণ চরণে জড়িয়ে আছে। পরে শ্যামবাজারের সাধারণ মানুষের সঙ্গে শ্রীরামকৃষ্ণ তাদের ঘরে গিয়েছিলেন।
শ্যামবাজারে প্রথম ঈশান মল্লিকের বাড়ীতে কীর্ত্তনে নেমেছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণ। তারপর সাতদিন সারা রাত কীর্ত্তনে সাধারণ মানুষই এলেন। তাঁরা ধর্ম, কর্ম, সমাধি কিছুই বোঝেন না। ‘কামার, কুমোর, বেনে, তাঁতি, তেলী, চাষা’ বড় জোর নামমাত্র কায়স্থ ব্রাহ্মণ—এঁদের মধ্যে সাতদিন সাত রাত ধরে হরিনামের বন্যা আনলেন শ্রীরামকৃষ্ণ।
স্বামী জিতাত্মানন্দের ‘শ্রীরামকৃষ্ণদর্শন’ থেকে