জগতের ইতিহাসে এমন কতকগুলি আশ্চর্য উদাহরণ দেখা যায় যে ক্ষেত্রে নিছক জৈবিক প্রবৃত্তিসম্পন্ন ‘পশু-মানুষে’র রূপান্তর ঘটেছে স্বচ্ছ ভাগবত জ্ঞান ও দৈবী করুনাসম্পন্ন ‘দেবতা-মানুষে’। সাম্প্রতিক কালের বিখ্যাত নাট্যকার গিরিশচন্দ্র ঘোষের কথা মনে পড়ে। পূর্বে তিনি ছিলেন ঘোর যথেচ্ছাচারী। কিন্তু শ্রীরামকৃষ্ণের সংস্পর্শে তাঁর চরিত্রে এল অদ্ভূত রূপান্তর, জীবনধারা সম্পূর্ণ পরিবর্তিত হয়ে গেল। পূর্ণ পশুপ্রবৃত্তির অবস্থা হতে তিনি লাভ করলেন এক শুদ্ধ-সত্ত্ব অবস্থা, যেথায় প্রতিমুহূর্তে তাঁর অনুভব হতো ভগবানের সান্নিধ্য। পুরাকালের দস্যু রত্নাকারের কাহিনী স্মরণ হয়। সংসার প্রতিপালনের অন্য কোন উপায় না দেখে, দস্যুবৃত্তি দ্বারা সে জীবিকা নির্বাহ করত। মহাজ্ঞানী নারদঋষি একদিন পথে তার কবলে পড়লেন। নারদ তাকে মৃদু ভর্ৎসনা করে বললেন, “তুমি বলছ তোমার পরিবারবর্গের জন্য এইসব পাপ তোমায় করতে হয়; আচ্ছা, তুমি কি মনে কর আজ পর্যন্ত নরহত্যার দ্বারা যে বিপুল পাপভার তোমার জমা হয়েছে, তার কোন অংশ তোমার আত্মীয়স্বজন কেউ গ্রহণ করবে? যাও জিজ্ঞাসা করে এস।” দস্যু রত্নাকর এভাবে কখনো চিন্তা করেনি। নারদ না পলায়ন করেন এই সম্বন্ধে নিশ্চিত হওয়ার জন্য তাঁকে একটি গাছের সঙ্গে বেঁধে সে গৃহে চলে গেল। ডাকাতি ও নরহত্যা করে কিভাবে সে জীবিকা নির্বাহ করে তা পিতা, মাতা ও স্ত্রী প্রত্যেকের কাছে বিবৃত করে জিজ্ঞাসা করল, “তোমরা কি আমার পাপের অংশ নেবে?” কিন্তু তাদের প্রত্যেকেই এই ধরণের কথা বলল, “আমাকে পালন করা তো তোমার কর্তব্য। তুমি কিভাবে টাকা রোজগার কর, তা আমাদের জানার দরকার কি? তোমার পাপের কোন অংশও আমরা গ্রহণ করব না।” তাদের নিষ্করুণ উত্তরে মর্মাহত দস্যুর চৈতন্যোদয় হলো। সে যে জীবন যাপন করছিল তা কত নিরর্থক ও দোষযুক্ত তা সে স্পষ্ট দেখতে পেল। সত্যপথ অনুসরণ করবার জন্য প্রাণে তার প্রবল আকাঙ্ক্ষা জাগল। নারদের কাছে দ্রুত ফিরে এসে সে তাঁর বন্ধন খুলে দিল এবং তাঁকে গুরুত্বে বরণ করে ধর্ম শিক্ষা দিতে সানুনয় প্রার্থনা জানাল। এই দস্যু রত্নাকরই তপস্যার প্রভাবে বিশুদ্ধাত্মা মহামুনি বাল্মীকিতে রূপান্তরিত হয়েছিলেন।
পাশ্চাত্য দেশে এই ঘটনার একটি উজ্জ্বল উদাহরণ হচ্ছেন সেণ্ট ফ্রান্সিস। খ্রীঃ দ্বাদশ শতাব্দীর শেষভাগে ইটালীর এসিসিতে ফ্রান্সিসের জন্ম হয়। তিনি নগরীর বিলাসী যুবকদলের নেতা ছিলেন। তাঁর বন্ধুরা তাঁকে ‘ব্যসন-রাজ’ বলে অভিহিত করত; কিন্তু তাঁর জীবনে অকস্মাৎ এক বিরাট পরিবর্তন এল ও তিনি শুচিতা, ভগবদ্জ্ঞান ও আর্তসেবার জীবন বেছে নিলেন।
এই আধ্যাত্মিক রূপান্তর কেমন করে ঘটে? পুরানো হতে যে নতুন ব্যক্তিত্বের উদ্ভব হয় তা দেখলে মনে হয় যে তা যেন সম্পূর্ণ অন্য এক শ্রেণীর। তার পূর্ববর্তীর সঙ্গে কোন মিল থাকে না বললেই চলে। অবশ্য দেহের দিক থেকে তাদের ভিত্তি একই থাকে কিন্তু আভ্যন্তর ভাব অর্থাৎ মনোবৃত্তি সম্পূর্ণ পরিবর্তিত হয়। এরূপ পরিবর্তন কি প্রণালীতে আসে?
প্রাচীন যোগাচার্য পতঞ্জলি একটি সূত্রে বলেছেন “সৎ ও অসৎ কর্মসমূহ প্রকৃতির পরিণামের সাক্ষাৎ কারণ নয়। প্রকৃতির বিবর্তনে তারা কেবল প্রতিবন্ধকগুলিকে নষ্ট করে মাত্র, যেমন কৃষক জলস্রোতের গতিপথের অবরোধ অপসারণ করলে জল আপন স্বভাবেই চলে যায়। এভাবেই এক শ্রেণী হতে অপর শ্রেণীর ক্রমবিকাশ সাধিত হয়।”
এই সূত্র সম্বন্ধে মন্তব্য করতে গিয়ে স্বামী বিবেকানন্দ ‘রাজযোগ’ গ্রন্থে বলেন— “ভূমিতে সেচ দিবার জল পূর্ব হইতেই ক্ষেত্রের নিকটবর্তী জলাশয় আছে,কেবল ‘আল’-এর বাধার দরুণ ঐ জল ক্ষেতে আসিতে পারিতেছে না। কৃষক এই সকল আল খুলিয়ে দেয় আর মাধ্যাকর্ষণ শক্তির সহায়ে জল আপনা হইতেই প্রবাহিত হয়। সেইরূপ প্রত্যেক মানুষের মধ্যেই সব শক্তি ও উন্নতি পূর্ব হইতেই নিহিত রহিয়াছে। পূর্ণতাই মানুষের স্বভাব, উহা কেবল বদ্ধ হইয়া আছে এবং আপন গতি লাভ করিতে পারিতেছে না। যদি কেহ বাধা অপসারণ করিতে পারে, তবে স্বভাবগত ঐ পূর্ণতা নিজ শক্তিবলে অভিব্যক্ত হইবেই। যাহাদিগকে আমরা পাপী বলিয়া থাকি, এই বাধা অপসারিত হইবার সঙ্গে সঙ্গেই তাহারা সাধু হইয়া যায়।
‘ধ্যান ও প্রার্থনা’ থেকে